নৈরাজ্যের পূজারী নাকি অনিচ্ছুক বিপ্লবী— এ জোকার কেমন জোকার?

ভেবেছিলাম দেখতে যাব না। ছোটবেলা থেকে আমি ডিসি কমিকসের ভক্ত, সুতরাং সবকটি মূল প্লট সম্বন্ধেই খানিক জানাবোঝা আছে। ব্যাটম্যানের বিচরণক্ষেত্র আমেরিকার ‘গথাম শহর’। ‘সাদাকালো, জঞ্জালে ভরা মিথ্যে কথার শহরে’ ‘ভালো ছেলে’দের মসিহা বলতে গেলে ‘দ্য ডার্ক নাইট’। তবে, প্রত্যেক শার্লকের একজন মরিয়ার্ট থাকে। ব্যাটম্যানের ক্ষেত্রে ‘জোকার’। অন্ধকার জগতের ‘রাজ-বিদূষক’। চরিত্রটি আত্মপ্রকাশ করেছিল ১৯৪০ সালে ‘ব্যাটম্যান’ প্রথম সংখ্যায়। তারপর বহু জল গড়িয়েছে…

এই জোকার যে-সে জোকার নয়। তিনি নিছক লোক হাসাতে আসেননি মার্কেটে। তাকে বুঝতে হলে ব্যাটম্যানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটা বোঝা জরুরি। ‘ব্রুস ওয়েন’ শিল্পপতির ছেলে, যার বাবাকে গথাম শহরের একরকম মালিক বলা যেতে পারে। ছোট থেকে সে দেখে আসছে, ধীরে ধীরে শহরটা চলে যাচ্ছে অন্ধকার জগতের হাতে। এখানে দিনদুপুরে পুলিশ ঘুষ খায়, রাত্রে কোকেনের পেটি চালান যায় বিচারপতির ঘরে। অর্থনীতির অবস্থা খারাপ। প্রমাদ গুনছেন ‘ভালো’ বিনিয়োগকারীরাও। এমত অবস্থায় খুন হন ব্রুসের বাবা-মা। সুতরাং, গথামের হাল ফেরাতে কয়েক বছর পর ফিরে আসে ব্রুস। কালো মুখোশের আড়ালে। আমাদের মনে রাখতে হবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার পৃথিবীটার কথা। যুদ্ধ-মৃত্যু, প্রেম নেই, বেঁচে থাকার গ্যারান্টিই নেই। অর্থনৈতিক মন্দা, ট্রমা ও সিনিসিজম তখন হাওয়া-বাতাসে উড়ছে। সেই ধোঁয়াটে, কালো ঠুলি পড়া আকাশেই উড়তে শুরু করল ব্যাটম্যান।

আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অন্তর্দ্বন্দ্বে সারাক্ষণ ভোগে ব্রুস ওয়েন। তবুও সে লড়ে যায় ‘দুর্নীতিমুক্ত স্বাভাবিক মৃত্যুর’ গ্যারান্টি চেয়ে। আর এই লড়াইতে তার প্রধান প্রতিপক্ষ ‘জোকার’। ব্যাটম্যান যেখানে গথামের ঘুষপেটিয়া পুলিশদের জব্দ করার ফন্দি আঁটে, ‘জোকার’ হাসতে হাসতে সেখানে কয়েকশো লোককে স্রেফ উড়িয়ে দেয় বোমায়। ‘পাগলের’ অভিধানে ‘যুক্তি, অর্থ, কারণ’ এই শব্দগুলির বসবাস করে না। মানুষ মারার সাপলুডো খেলতে খেলতে নিজেকে ‘বিধাতা’ ভেবে ফেলছে সে। স্বাভাবিকতার সামাজিক বুনিয়াদের প্রতি ওপেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে অ্যান্টিথিসিস হয়ে উঠছে জোকার। দুনিয়াটা যার কাছে হেসে উড়িয়ে দেওয়ার বস্তু।

এহেন চরিত্রকে গল্পে বাঁধা সহজ না। ইতিহাস নেই বললেই চলে। তবুও অতীতের খানিক আবছা একটি ছবি পাওয়া যাবে এলান মুরের লেখা ‘দ্য কিলিং জোক’ কমিক্সটিতে। এক অসফল কমেডিয়ান ধীরে ধীরে অন্ধকারে হারিয়ে ফেলে নিজেকে। অবচেতনের রাক্ষসটা নগ্ন হয়ে বেরিয়ে আসে আলোয়…

এবার সিনেমায় ফেরা যাক। সিনেমার টেকনিকাল দিককে এই লেখায় সযত্নে সরিয়ে রাখাই ভালো। পাঠক শুরু থেকেই বুঝতে পারছেন, এই লেখার উদ্দেশ্য আলাদা। যাহোক, ‘জোকার’ এখনও পর্যন্ত বলা যেতে পারে, টড ফিলিপসের সেরা ছবি। নির্দেশক দর্শককে দুরুদুরু বক্ষে হলে বসিয়ে রাখবেন টানা দু ঘণ্টা। নাম-ভূমিকায় হোয়াকিম ফিনিক্স যেন ঢুকে গিয়েছেন চরিত্রটির ভেতর।

চল্লিশ বছরের ‘আর্থার ফ্লেক’ গথাম শহরের হারবার্ট সরকার। যার জীবন আসলে একটা কুৎসিত মজা। আর্থার হাসতে হাসতে কাঁদে, কাঁদতে কাঁদতে হাসে। ডিপ্রেশন কুরে কুরে খায় তার মতো হেরে যাওয়া মানুষগুলোকে। কেউ তো শোনে না তাদের কথা। শহুরে বাবুদের রোশনাইয়ে চাপা পড়ে দৈনন্দিন ছিলেছেঁড়া যন্ত্রণা। মানসিক প্রতিবন্ধকতার খিল্লি ওড়ায় বিকিয়ে যাওয়া মিডিয়া। অসহায়তার চক্রব্যূহে পড়ে ধীরে ধীরে নিজেকে হারায় আর্থার। ‘সমাজ-রাষ্ট্র-মানবিকতা’ ইত্যাদি সংজ্ঞার বদল ঘটে আমূল…

ব্যাটম্যান ও সুপারম্যান-- দুইয়েরই জন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে। একজন ১৯৩৯-তে আত্মপ্রকাশ করছে, এবং আরেকজন ১৯৪০ সালে। ‘গথাম’ ও ‘মেট্রোপলিস’ কিন্তু নিউ ইয়র্ক শহরেরই প্যারোডি। গথামের ভেতর বাসা বাঁধছে অপরাধ জগৎ, আর মেট্রোপলিসে হানা দিচ্ছে বাইরের শত্রুরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজরজার দুই সুপারহিরো। যুদ্ধবিধ্বস্ত আমেরিকায় উগ্র দেশপ্রেমের বার্তা বহন করে দুজনেই। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ছবিটা অন্তত আমাদের বর্তমান সময়ে খুবই চেনা। শুধু বর্তমান সময়ই বা বলি কেন, কুখ্যাত বা বিখ্যাত সত্তরের দশকে রুপোলি পর্দা কাঁপানো সেই ‘অ্যাংরি ইয়াং ম্যান’-কে মনে পড়ে?

সে যাহোক, এই সুপার হিরোর উল্টোদিকে আপাতভাবে ‘জোকার’ নৈরাজ্যের পূজারী। তার হাসিটা আসলে মানবসভ্যতাকে নিয়ে একটা অসভ্য খেউর। এই সিনেমাতে সে অনিচ্ছুক বিপ্লবী। অরাজনীতির মুখোশের আড়ালেও রাজনৈতিক হয়ে উঠছে আর্থার ফ্লেক। ধরা যাক, ‘ওয়েন-এন্টারপ্রাইজেস’ যদি বর্তমানের ‘রিলায়েন্স’ হয়, তাহলে সিনেমার যুক্তিতে ‘জোকার’ তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো খেটেখাওয়া মানুষের বলগাহীন আক্রোশ। কিন্তু সত্যিই কি তাই?

নৈরাজ্যকে ক্ষমতায় পর্যবসিত হতে দেখা যাবে ফরাসি বিপ্লবে। জোকারও তো ক্ষমতাই চেয়ে এসেছে বরাবর। মূল কমিকস অনুযায়ী। বিশৃঙ্খলাকেও একভাবে (এককভাবেও কি?) নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা। নিজের মতাদর্শটি মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে বোঝানোর ক্ষমতা। সুতরাং এক সাইকোপ্যাথের স্বপনচারণকে, সমাজবদলের আকাঙ্ক্ষা বলা যেতে পারে কি না, জানা নেই…

বরং সিনেমার শেষ দৃশ্য খানিক আশাবাহী।যেখানে কার্যকারণের বাইরে বেরিয়ে একটি খুন করে আর্থার। হয়ত সেখান থেকেই প্রকৃত ‘অর্থহীনতার’ যাত্রা শুরু। কিংবা অনর্থহীনতার…