“যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে/ সহস্র শৈবাল দাম বাঁধি আসি তারে…” রবীন্দ্রনাথের এই পঙক্তির সঙ্গে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। নদীর উপমার মধ্যে দিয়ে সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রবাহমানতার ছবি তুলে ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, এমনই আশ্চর্য সংকট হাজির মহাসাগরগুলির দোরগোড়ায়। চলতি শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়েই সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে উপমহাসাগরীয় (Trans-Oceanic Current) জলপ্রবাহ বা সমুদ্রস্রোত, জানাচ্ছেন গবেষকরা। যা সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রকে তো বটেই, প্রভাবিত করবে গোটা পৃথিবীর জলবায়ুকে।
গত মঙ্গলবার বিজ্ঞান পত্রিকা ‘নেচার জার্নাল’-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুযায়ী, ক্রমশ স্রোত হারাচ্ছে আটলান্টিক মেরিডিওনাল ওভারটার্নিং কারেন্ট(Atlantic Meridional Overturning Current) বা ‘এএমওসি’। কী এই ‘এএমওসি’? একটু খুলে বলা যাক। আসলে সমুদ্র বা মহাসাগরকে পৃথক পৃথক প্রকাণ্ড জলাধার বলে বাহ্যিক দিক থেকে মনে হলেও, ক্রমাগত জলের ধারা প্রবাহিত হয় এক মহাসাগর থেকে অন্য মহাসাগরে। না, শুধু সূর্য বা চন্দ্রের জন্য সৃষ্ট জোয়ার-ভাটা নয়, আর তার নেপথ্যে রয়েছে উষ্ণতার তারতম্য। সেটা কেমন?
ভারত মহাসাগরের কথাই ধরা যাক। ভারত মহাসাগরের মধ্যবর্তী অঞ্চল অবস্থিত বিষুব রেখার ওপর। আবার দক্ষিণাঞ্চল গিয়ে ছুঁয়েছে আন্টার্কটিক পরিমণ্ডলকে। স্বাভাবিকভাবেই তাই ভারত মহাসাগরের উত্তরের জলরাশির তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে, দক্ষিণে কম। ফলে, দক্ষিণ মহাসাগর থেকে ভারি ও ঠান্ডা জলস্রোত পশ্চিম ভারত মহাসাগরে অবস্থিত অস্ট্রেলিয়াকে ছুঁয়ে উত্তরে চলে আসে। উত্তাপ সংগ্রহ করে, তা আবার আফ্রিকা উপকূল ঘেঁসে ফিরে যায় কুমেরু সাগরে বা আন্টার্কটিক সার্কেলে।
একই ধরনের জলস্রোত দেখা যায় আটলান্টিক মহাসাগরের বুকেও। যা একদিকে নিয়ন্ত্রণ করে আর্কটিক ও আন্টার্কটিক অঞ্চলের বরফ গলনের হার। তেমনই নিয়ন্ত্রণ করে দুই আমেরিকা, ইউরোপ এবং আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলের জলবায়ু, বিভিন্ন সমুদ্রের জলের ঘনত্ব, জলে লবণের পরিমাণকেও। এইসকল বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রও। এই বিশেষ সমুদ্রস্রোতই পরিচিত ‘এএমওসি’ নামে।
সাম্প্রতিক সময়ে ক্রমশ বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে ক্রমশ উষ্ণতার পার্থক্য কমে চলেছে দুই মেরু এবং বিষুব অঞ্চলের মধ্যে। ত্বরান্বিত হওয়া এই জলবায়ু সংকটই ক্রমশ বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আটলান্টিকের সেই উপমহাসাগরীয় স্রোতের সামনে। এই পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তুলছে ইউরোপের অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ। কোথাও কোথাও উষ্ণতা ছুঁয়েছে ৪৫-৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই উষ্ণতাবৃদ্ধির ফলেই অবলুপ্তির প্রমাদ গুনছে কনভেয়ার বেল্ট বা আটলান্টিকের উপমহাসাগরীয় সমুদ্রস্রোত।
অবশ্য এই প্রথম নয়। আজ থেকে ১২-১৩ হাজার বছর আগে, দ্রুত হিমবাহ গলনের জন্যেও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ‘এএমওসি’। দুই গোলার্ধের তাপমাত্রা পরিবর্তিত হয়েছিল ১০-১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ইতি পড়েছিল হিমযুগে। এবার আবারও সেই একই পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে চলেছে পৃথিবী। অবশ্য এবার তার পরিণতি হতে পারে আরও ভয়ঙ্কর। দুই গোলার্ধে সঞ্চিত বরফের চাদর সম্পূর্ণ অবলুপ্ত হতে পারে উষ্ণতাবৃদ্ধির ঠেলায়।
২০০৪ সাল। আটলান্টিকের সমুদ্রস্রোত হ্রাস পাওয়ার ঘটনা প্রথম নজর কেড়েছিল বিজ্ঞানীদের। উপমহাসাগরীয় স্রোতের প্রকৃতি বিশেষভাবে নিরীক্ষণ করতে শুরু করেছিল একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা। ২০১৯ সালে সেই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই রাষ্ট্রপুঞ্জ জানিয়েছিল চলতি শতাব্দীর শেষ থেকেই দুর্বল হতে শুরু করবে আটলান্টিকের স্রোত। ২১০০ সাল নাগাদ তা সম্পূর্ণ থেমে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। তবে কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণা শোনাচ্ছে আরও ভয়াবহ ভবিষ্যতের কথা। বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণে না-এলে আর হয়তো এক-দু-দশকের মধ্যেই গতি হারাতে শুরু করবে আটলান্টিক। একুশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে স্থিতাবস্থায় পৌঁছাবে মহাসাগরীয় জলরাশি। ইতিমধ্যেই এই নতুন গবেষণা চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে পরিবেশবিদদের কপালে…
Powered by Froala Editor