জোড়াসাঁকো ছাড়িয়ে গণেশ টকিজ-এর রাস্তার মোড়ে চোখ চালালেই পেল্লায় বাড়িখানা চোখে পড়বে। আকাশছোঁয়া প্রাসাদ। সেই বিশাল সাতমহলের একতলা জুড়ে দোকান। ‘মহাত্মা এন্ড কোং।’ ইংরাজি বাংলা আর দেবনাগরী হরফে সাইনবোর্ড। কেমিস্টস এন্ড ড্রাগিস্টস। মুখের মাস্কটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। তাই কিন্তু-কিন্তু করে ঢুকেই পড়লাম দোকানে। ক্যাশ-কাউন্টার থেকে একটি এন-১৫ মুখোশের বিল পকেটে রাখতে রাখতে চোখ পড়ে চারপাশে। তাকের উপর রবীন্দ্রনাথের একটি ফটোগ্রাফ। সেই ছবির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে এক বয়স্ক ভদ্রলোক। দৃশ্যটা দেখেই অনেককিছু হুড়মুড়িয়ে মনে পড়ে যায়। কাঁটা দিয়ে উঠল গায়ে...
রবীন্দ্রনাথ তখন মৃত্যুশয্যায়। শান্তিকেতন ছেড়ে রয়েছেন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। দীর্ঘদেহী সুঠাম শরীরকে কোনোদিন স্পর্শ করেনি ব্যাধি, সেই দেহ ক্রমশ কঙ্কালসার। যেন মিশে গিয়েছে বিছানায়। স্বনামধন্য ডাক্তাররা কবিকে দেখে যাচ্ছেন একে একে। বিধান রায়, নীলরতন সরকার, ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু ভালো হয়ে উঠছেন না তিনি। অনেক জল্পনার পর চিকিৎসকমণ্ডলী ঠিক করলেন, অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। বাদ সাধলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু ‘রোগী’র আপত্তি মানতে নারাজ চিকিৎসকেরা। অবস্থার অবনতি হচ্ছে ধীরে ধীরে। শেষে রথী ঠাকুরের অনুমতি নিয়েই কবিকে তোলা হল অস্ত্রোপচারের টেবিলে।
কিন্তু অপারেশনের চার পাঁচ দিন পরে রবীন্দ্রনাথের সাবধানবাণী সত্যি হয়ে ওঠে। ফেল মেরে যায় ডাক্তারি অনুমান। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন কবি। তাঁর হাতে আর মেরেকেটে ক'দিন। ঢলে পড়বেন মৃত্যুর কোলে। মৃত্যুপথযাত্রীর যন্ত্রণা খানিক লাঘব করতে ডাক্তাররা শেষে বেছে নিলেন মিক্সচার তৈরির পথ। পিল সাইট্রাস, সোডিবাই কার্ব, পট এসিডাস, সিরাপ রোজ কিম্বা হাইড্রাগ, মেনথল, একুল বেলাডোনা ইত্যাদি নানা জটিল রাসায়নিক হিসেব নিকেশের ফসল এইসব মিক্সচার। জোড়াসাঁকোর একটি দোকান থেকেই মিক্সচার আসত। সেই প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘মহাত্মা এন্ড কোং’। কবির শেষ দিনগুলির সাক্ষী ...
আরও পড়ুন
উদয়শঙ্করের নাচ, ঢিলে কাঁচুলিতে ষোড়শী, বললেন ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে সেই বয়স্ক ভদ্রলোক সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন খেয়াল নেই। স্মিত হেসে একটা বই খুলে ধরলেন। সেই বইয়ের পাতার, ছত্রে ছত্রে পেন্সিলের দাগ। একটিতে ছবি। একটি প্রেসক্রিপশনের ছবি। মুমূর্ষু কবির জন্য মিক্সচারের ফর্মুলা সেই কাগজে…
আরও পড়ুন
অহঙ্কারের ইনজেকশন চলেচে, বললেন রবীন্দ্রনাথ
আরও পড়ুন
হেলেন কেলারের হাতে আঙুল চালিয়ে কবিতা ‘পড়ালেন’ রবীন্দ্রনাথ
‘আমার বাবা, রাধাবিনোদ রায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহাত্মা এন্ড কোং। বাবা ছিলেন গান্ধীভক্ত। শুনেছি গান্ধীজি যখন কলকাতায় এসে, এই দোকানের নামোল্লেখ করেছিলেন। তিনি চিনতেন বাবাকে। এছাড়া ডাঃ বিধান রায় তাঁর পেশেন্টদেরকে বলতেন আমাদের কথা। এ তল্লাটে তখন ওষুধের দোকান বলতে একটাই যে ছিল। ...আমরা তখন খুবই ছোটো। আমি আর দাদা। ছোটবেলায় জানতাম না, এই দোকান থেকেই কবির ওষুধ গিয়েছিল। পরে বড়ো হয়ে বাবার মুখ থেকে শুনেছিলাম…’
বলতে বলতে গলা ধরে আসছিল সেই বৃদ্ধের। নাম, শম্ভুনাথ রায়। বর্তমানে তিনি দোকানের সর্বেসর্বা। যত্ন করে দেখাচ্ছিলেন সব কিছুই। বই-এর পাতায় প্রেসক্রিপশন আর খবরের কাগজের নানা কাটিং দেখতে দেখতে পৌঁছে গিয়েছিলাম চল্লিশের দশকে...
শম্ভুনাথের দাদা রণজিৎকুমার চলে গিয়েছেন বেশ কিছুদিন হল। দাদাই ছিলেন এই দোকানের প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু চলে তো যেতে হয় সবাইকেই। নানা ফেলে দেওয়া কাগজের সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে কবির সেই প্রেসক্রিপশনের কার্বন কপিটি। ভাগশেষ হিসেবে পড়ে রয়েছে একরাশ স্মৃতি...
আজও বাইশে শ্রাবণ এলে উদাস হয়ে যান শম্ভুনাথ। তাকিয়ে থাকেন জোড়াসাঁকোর গলির দিকে…
ক্ষণিকের জন্য আমারও সময়ভ্রম হয়…
ঋণস্বীকার : শম্ভুনাথ রায়, মহাত্মা এন্ড কোং
তথ্যসূত্র: ‘সূর্যাস্তের আগে রবীন্দ্রনাথ’ – অমিতাভ চৌধুরী
Powered by Froala Editor