নিজে ছিলেন বিখ্যাত ডাক্তার। আরও ভালো করে বললে, ধন্বন্তরি। আর সেই কারণেই বুঝতে পেরেছিলেন, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। জীবনের শেষ কয়েকদিন নানাভাবে ভুগেছেন। হয়েছে হার্ট অ্যাটাক। কত মানুষকে সুস্থ করে দিয়েছিলেন তিনি। মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন কতজনকে! তাঁর রোগীদের মধ্যে ছিলেন মতিলাল নেহরু, মহাত্মা গান্ধী, চিত্তরঞ্জন দাশ-সহ আরও অনেকে। তবুও নিজের অসুস্থতার সময় বলেই বসলেন, কোনো ওষুধই আর বাঁচাতে পারবে না। নিজের শেষ যে ঘনিয়ে আসছে, আস্তে আস্তে একটা কালো পর্দা নেমে আসছে, এমনটা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু কে আর জানত, জন্মদিনের দিনই চিরতরে চলে যাবেন তিনি…
তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তিনি। বাড়িতে হাজির হয়েছেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব। হাজির হয়েছিলেন সার্জন এবং বন্ধু ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিদিনের মতো এক গ্লাস ফলের রসও খেলেন। তারপরই বললেন নিজের দীর্ঘ জীবনের কথা। কোনোরকম অতৃপ্তি নেই তাঁর। যেন অপার এক শান্তি নেমে আসছে চারদিকে। ধীরে ধীরে পা ঠান্ডা হয়ে এল। একসময় থেমে গেল হৃদস্পন্দন। দিনটা ১ জুলাই, ১৯৬২। চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবী তখনও জীবিত। তিনি বললেন, “বিধান পুণ্যাত্মা, তাই জন্মদিনেই চলে গেল। ভগবান বুদ্ধও তাঁর জন্মদিনে সমাধি লাভ করেছিলেন।” একই দিনে জন্ম এবং মৃত্যু— এমনই অদ্ভুত সমাপতন যে ব্যক্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তাঁর নাম ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। গোটা জীবনে নানা মিথ তৈরি করেছেন তিনি। ডাক্তার হবার ইচ্ছা ছিল না; তবুও এই কাজেই হয়ে উঠেছিলেন সর্বসেরা। ভারতের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর নাম। তবে তাঁর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও এক আশ্চর্য কিংবদন্তি কাহিনির। যা শেষ হয় এক অপূর্ণ প্রেমকাহিনিতে…
কেন চিরকুমার রইলেন বিধান রায়? যদি সংসার করতেন, তাহলে হয়ত শরীরের ওপর এত অনিয়ম করতেন না। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও এমনটাই বলতেন। কিন্তু কেন? এই কেন-র উত্তর একটি কাহিনি দিয়ে শুরু করা যাক। তখন বিধান রায় সদ্য ডাক্তারি পাশ করেছেন। প্র্যাকটিসও শুরু করেছেন একটু একটু করে। রোজগার খুব বেশি নয়। পারিবারিক দিক থেকেও খুব বিত্তশালী, তাও নয়। সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার। সেই সময়ই হৃদবিনিময় হল কিংবদন্তি ডাক্তার নীলরতন সরকারের মেয়ে কল্যাণীর সঙ্গে। একটা সময় সেই খবর জানতে পারলেন নীলরতন। একদিন ডাকলেন বিধানকে। জিজ্ঞেস করেছিলেন তাঁর রোজগার সম্পর্কে। অঙ্কটি শুনে নীলরতনের জবাব ছিল, তাঁর মেয়ের হাতখরচ এর থেকে বেশি। জবাবটা ভালো লাগেনি বিধান রায়ের। বুঝে গিয়েছিলেন, এই সম্পর্ক আর পরিণতি পাবে না। সেই আবেগই কি তাঁকে চিরকাল একা করে রাখল? চিরকুমার হয়ে রইলেন তিনি? অন্তত জনপ্রবাদ তো তাই বলে! কিন্তু এর কি লিখিত প্রমাণ আছে কোনো? নাহ! তবে লোকের মুখে-মুখে যে কাহিনি এসে পৌঁছেছে একুশ শতকেও, তাকে কি এক ফুঁয়ে উড়িয়েও দেওয়া যায়!
এই ঘটনার সমান্তরালে এসে জুড়ে যায় বিধানচন্দ্র রায়ের জীবনের আরও একটি অধ্যায়। তখন তিনি মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে। ১৯৫০ সালে কলকাতা থেকে ৫০ কিমি দূরের নদিয়া জেলার একটি জায়গায় তৈরি করলেন শহর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গঙ্গার ধারে জায়গাটি ছিল মার্কিন সেনাদের ছোটোখাটো উপনিবেশ, নাম ছিল ‘রুজভেল্ট নগর’। পরবর্তী সময় সেখানেই বিধানচন্দ্র তৈরি করলেন ‘কল্যাণী’। নামটা কি খুব কাকতালীয়? অনেকের মতে, প্রিয়তমা কল্যাণীর সঙ্গে অপূর্ণ পরিণয়ের স্মৃতি থেকেই এই নামটি বেছেছিলেন বিধান রায়। আজ কল্যাণী রীতিমতো একটি স্মার্ট সিটি। আধুনিকতার আড়ালে কি লুকিয়ে আছে এমন কিংবদন্তি প্রেমকথা?
অদ্ভুতভাবে, ইতিহাসে যখনই ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের প্রসঙ্গ এসেছে, তখনই তুলনায় এসেছেন তাঁর শিক্ষক নীলরতন রায়। রবীন্দ্রনাথের চিকিৎসার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন দুজনে। অথচ জীবনের অন্যতম ট্র্যাজেডির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেই নামটিও। কিন্তু জীবনের মঞ্চে হেরে যেতে শেখেননি তিনি। লড়াই চালিয়ে গেছেন। ডাক্তার হিসেবে তো বটেই, রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবেও তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা না করে বিধানচন্দ্র রায় নিজে উদ্যোগ না নিলে হয়ত ‘পথের পাঁচালী’র মুক্তি নিয়েও তৈরি হত গভীর জটিলতা। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যাবার পরেও নিজের বাসভবনে সকালবেলায় বিনে পয়সায় রোগী দেখতেন। অথচ নিজের শরীরটা যে শেষ হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে নজরও দিতেন না। এইভাবেই নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক অন্য উচ্চতায়। নিজেই হয়ে উঠেছিলেন ইতিহাসের অংশ। বিধানচন্দ্র রায় যে লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে চলে যেতে শেখেননি!
তথ্যসূত্র- আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘ডাকনাম ভজন ভাল নাম বিধান’/ শঙ্কর
আরও পড়ুন
লেকের পাশে চিনা ভাষায় লেখা সংকেত, স্যাটেলাইট ইমেজে ধরা পড়ল চিনের ‘বার্তা’
Powered by Froala Editor