ঈর্ষাক্ষাৎকার: তুহিন মুখোপাধ্যায়— প্রথম পর্ব

তুহিন মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৫৩ সালে, কলকাতায়। শৈশব থেকেই রিষড়ার স্থায়ী বাসিন্দা। ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বর্তমান ঈর্ষাক্ষাৎকারটি তাঁর ‘চৈতন্যের শেষ প্রহর’-কে (প্রকাশ ২০১৬) কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। কথোপকথনে তুহিন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ প্রথম পর্ব...


তন্ময়— চৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে ইতিপূর্বে একাধিক গবেষণামূলক কাজ হয়েছে। অর্থাৎ, বিষয়টি বহুচর্চিত। এমন বিষয় নিয়ে আবার কাজ করার পরিকল্পনা নিলেন কেন?

তুহিন মুখোপাধ্যায়— আসলে ব্যাপারটা হঠাৎ করে ঘটে যায়নি। যে-কোনো ঘটনার যেমন একটা প্রেক্ষাপট থাকে, এখানেও তা রয়েছে। দুম করে কিছু ঘটেনি। মোটামুটি ২০০০ সাল থেকেই আমি চৈতন্যকে নিয়ে পড়াশোনা করতে আরম্ভ করি। এবং সেই পড়াশোনার তাগিদে আমাকে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হত, বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে হত। মানে একটা অদ্ভুত প্রশ্নের মুখোমুখি আমি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। আমার হাতে অবন্তীকুমার সান্যাল এবং অশোক ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘চৈতন্যদেব ইতিহাস ও অবদান’ বইটি এসে পৌঁছয়। এটি একটি প্রবন্ধ সংকলন। পড়তে পড়তে লক্ষ করলাম যে, গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধারার সঙ্গে যে-লেখকরা যুক্ত, তাঁরা দাবি করছেন, চৈতন্য তাঁদের প্রতিষ্ঠাতা। আবার ধরুন সুধীর চক্রবর্তী ও এইধরনের যাঁরা, মানে বাংলার লোকায়ত সাহিত্যের চর্চা করেছেন, তাঁরা বলতে চাইছেন, চৈতন্য ব্রাহ্মণ্যবাদের মানুষ ঠিক নন। বরং, সহজিয়া। এরকম একটা ব্যাপার যেন।

এইখানে প্রশ্নটা যেটা তৈরি হয়, সেটা হল, চৈতন্য তবে কাদের মানুষ ছিলেন? কেন-না গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায় পুরোপুরি ব্রাহ্মণ্যধর্মের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছে। এটা কি গোড়াতেও তাই ছিল? নাকি অন্যরকম কিছু ছিল, যা আজ বেদখল হয়ে গেছে? এটা খুঁজতে খুঁজতে যখন আমি বাউল-ফকির, বৈষ্ণবদের সঙ্গে মেলামেশা করছি, সে-সময় প্রচুর জায়গাতে আমাকে প্রশ্ন শুনতে হত—মানে যাঁদের সঙ্গে আমি কথা বলতাম, তাঁদের থেকে—যে, আপনি তো চৈতন্যদেবকে নিয়ে খোঁজ-খবর করছেন, তা তাঁর শেষ পরিণতিটা কী হল? উনি কি জগন্নাথে বিলীন হলেন নাকি সমুদ্রে ঝাঁপ দিলেন? নাকি ওঁকে মেরে দেওয়া হল? কী হল ঘটনাটা? স্বাভাবিকভাবেই আমি যখন আমার মতো করে কিছু জানি না, তখন বিভিন্ন মতের মধ্যে কোনোটাকেই আমি সমর্থন করার মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। কিন্তু কৌতূহলটা আরেকটু অন্যদিকেও গেল। যে, এটা সম্পর্কে খোঁজ-খবর করা যেতে পারে।

চৈতন্যের সম্পর্কে খোঁজখবর করতে গিয়ে যখন ‘লোকায়ত চৈতন্য’-এর কাজটা আমার শেষ হল—প্রায় বারো বছর সময় লেগেছিল ওটা শেষ করতে—কাজটা যখন শেষের দিকে গুছিয়ে এনেছি, তখন আমি পাশাপাশি চৈতন্যের অন্তর্ধানের বিষয়টা নিয়েও পড়াশোনা করতে আরম্ভ করি। আরম্ভ করা মানে, যে বিভিন্ন মতগুলো রয়েছে এবং এই মতের ওপর যে-লেখাগুলো রয়েছে—সব তো জোগাড় করা সম্ভব হয়ে ওঠে না সবসময়— যতটা পাচ্ছি, পড়তে আরম্ভ করেছি। পড়তে পড়তে যেটা মনে হল, এতবছর আগেকার একটা ঘটনা, যার কংক্রিট এভিডেন্স আজকে বসে জোগাড় করা কিন্তু ভীষণ কঠিন ব্যাপার, প্রায় অসম্ভব বলা যেতে পারে। কারণ, প্রত্যেকেই যাঁরা লিখেছেন বা বলেছেন, কোনোটাই কিন্তু পাথুরে প্রমাণের ওপর দাঁড়িয়ে নয়। তাহলে পড়ে থাকে যে-জায়গাটা সেটা হচ্ছে, তখনকার ইতিহাস। ইতিহাসের মধ্যেও নানারকম আবর্জনাও থাকে, তার থেকে যেটুকু পারা যায় বাছ-বিচার করে বার করার দরকার হয়। এবং সব ক্ষেত্রেই চেষ্টা করার চেয়েও যেটা দরকার হয়ে পড়ে, কোনোদিকে আগে থেকে কিছু ধরে না-নিয়ে, নিজের যুক্তি, বিচারবোধ এবং সেই সময়কার তথ্য যা যা পাওয়া যায়— যেমন সেইসময়কার বিভিন্ন ধরনের তথ্য, সেটা সরাসরি চৈতন্যের সঙ্গে জড়িত না-ও হতে পারে, বিভিন্ন সামাজিক প্রথা, অর্থনৈতিক অবস্থা ও ঐতিহাসিক টানাপোড়েন—এই সমস্ত তথ্য বা বিষয়গুলোকে যুক্তি দিয়ে বিচার বা যাচাই করা দরকার।

একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলে বোধ হয় ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধা হবে। যেমন, জগন্নাথ মন্দিরের মধ্যে চৈতন্যকে হত্যা করা হল—এরকম একটা গল্প তো প্রচলিত আছে। এবার আপনাকে ভাবতে হচ্ছে যেটা, সেটা হচ্ছে, এখনও যদি পুরীর মন্দিরের মধ্যে রক্তপাত ঘটে কোনোভাবে কিংবা ধরুন কেউ প্রস্রাব করে ফেলে, পায়খানা করে ফেলে তাহলে মন্দির শোধন করতে হয়। তাহলে এই যে পাঁচশো বছর পেরিয়ে গেছে, অতদিন আগে যাঁরা পাণ্ডা, পুরোহিত-মণ্ডলী ছিলেন, তখন তাঁদের মনোভাব তো আরও অনেক বেশি কঠোর ছিল। তাহলে সে-সময়ে দাঁড়িয়ে—একে তো তখনকার সমাজে ব্রহ্ম-হত্যা একটা চরম পাপ, তার ওপরে চৈতন্য সন্ন্যাসী। তার মানে একইসঙ্গে যে-মানুষটা সন্ন্যাসী, ‘সন্ন্যাসীরে সর্বজনে করে নমস্কার’—গায়ে কেউ হাত তোলে না—যেটা তিনি বলেছিলেন সন্ন্যাস নেওয়ার আগে। তো একে সন্ন্যাসী, তার ওপর ব্রাহ্মণ। এইরকম একজন মানুষকে জগন্নাথ মন্দিরের মধ্যে মেরে ফেলা—এটা সম্ভাব্যতার বিচারে কতটা সম্ভব? কারণ ওড়িশার ইতিহাসই বলে, গজপতি বংশেরই এক রাজা—মন্দিরের ভেতরে নয়, বাইরে এক ব্রাহ্মণকে মেরে ফেলেছিলেন। এবং তার ফলে তাঁকে ব্রাহ্মণদের ডেকে কয়েক হাজার গরু-দান করতে হয়েছিল, কয়েক মণ সোনা দান করতে হয়েছিল এবং কয়েকশো পুকুর কাটাতে হয়েছিল প্রায়শ্চিত্ত-স্বরূপ। এই যেখানকার অবস্থা, সেখানে মন্দিরের মধ্যে কাউকে মেরে ফেলা হল, তাও একজন ব্রাহ্মণ এবং অ্যাজ-ওয়েল-অ্যাজ সন্ন্যাসী—এটা যখন শুনছি, তখন তো আমার বিচার করার জায়গা আসছে যে, এটা আদৌ সম্ভব ছিল তখনকার দিনে? ওই যে যাচাই করে নেওয়া, নিজের বোধ, বুদ্ধি, বিচার, বিবেচনা এবং তখনকার পরিস্থিতিটা মাথায় রাখা—এটা তারই কথা বললাম।

অটোমেটিক্যালি সেই বিচার করে আমি সবকটা মতকে পড়তে গিয়ে দেখলাম, কোনোটাই যেন ফুলপ্রুফ নয়। প্রত্যেকটার মধ্যেই বিভিন্ন ফাঁকফোকর দেখা যাচ্ছে। তাহলে কী হতে পারে ব্যাপারটা? এখান থেকেই আমার খোঁজ শুরু হয়েছিল। এবং প্রথমে একটা ছোটো চ্যাপ্টার তৈরি হয়েছিল, যেটা ‘লোকায়ত চৈতন্য’-এর সঙ্গেই প্রকাশ হওয়ার কথা ছিল। তারপর মনে হল, না, এটা ওর সঙ্গে যাবে না। প্রথমত, তাতে ‘লোকায়ত চৈতন্য’-এর ওপর থেকে ফোকাসটা সরে যাবে, আর দ্বিতীয়ত এই বিষয়টার প্রতি একটা অবিচার করা হয়ে যাবে। তখন এটা নিয়ে সেপারেটলি আমি সার্চ করতে আরম্ভ করি। এভাবেই ব্যাপারটা এসেছিল। লোকের যেহেতু প্রচুর কৌতূহল আছে, কাজেই এই বিষয়টা নিয়ে লিখলে লোকে খুব নেবে, বিক্রি হবে বা খুব নাম-টাম হয়ে যাবে—ঠিক এইভাবে ব্যাপারটা কিন্তু আসেনি। যেহেতু মনে হয়েছিল, কোনো মতটাই ফুলপ্রুফ হতে পারছে না। আমার মনে হত, এই প্রশ্নগুলো হয়তো অনেকের মনেই উঠেছে, সেখানে তাঁরা সমাধান পাচ্ছেন না বা বিকল্প পাচ্ছেন না। কাজেই এই কাজটা শুরু করা যাক। এইভাবেই বিষয়টা এসেছিল।


তন্ময়— অদ্যাবধি চৈতন্যের অন্তর্ধান নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন, সেটা বাংলায় থেকেই হোক বা পুরীতে গিয়ে—শোনা যায় তাঁদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিকূলতা বা হুমকির মুখোমুখি হতে হয়েছে। এমনকি জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পিছনেও একটা রহস্য লুকিয়ে। অন্যান্য যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরাও বিভিন্ন সাবধানবাণীর মুখোমুখি হয়েছেন শোনা যায়। আপনারও কি এরকম কোনো অভিজ্ঞতা হয়েছে?

তুহিন মুখোপাধ্যায়— না, ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং আমার এইধরনের কোনো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়নি। তার কারণ যেহেতু আমার এই কথাগুলো শোনা ছিল, কোনোদিনই কোনো জায়গাতে খোঁজখবর করার সময় ‘চৈতন্যের অন্তর্ধানের খোঁজ করছি’—এটা আভাস-ইঙ্গিতেও কাউকে বুঝতে দিইনি। ফলত, আমাকে এইধরনের ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়নি। আর দ্বিতীয়ত, আমি তো আর তেমন কোনো নামী লোক নই যে, আমার মুভমেন্ট, কাজকর্ম বা কথাবার্তা পাঁচজনের কাছে পৌঁছে যাবে বা কোনো বিশেষ চক্রের কাছে পৌঁছে যাবে। তাই আমাকে এটা ফেস করতে হয়নি। এমনকি আমি যখন ওঁর সমাধি খুঁজতে হাজির হয়েছিলাম, তখনও কিন্তু আমি কটকের যেখানে উঠেছিলাম, সেখান থেকে শুরু করে অটোওয়ালা, টোটো-ওয়ালা—প্রত্যেকেই জানত আমি কোনো একটা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছি, আমি কটকের ও আশপাশের ঐতিহাসিক ব্যাপারগুলো নিয়ে খোঁজখবর করছি। কেন? কারণ, এটা নিয়ে লিখে আমার দুটো পয়সা হবে। পত্রিকাতে ফ্রিলান্সার হিসাবে কাজ করি। এভাবেই ব্যাপারটা করেছি।

আর প্রসঙ্গত আরেকটা কথা বলি। যাঁরা বিভিন্ন সময়ে দাবি করেছেন যে তাঁদের ওপর নানারকম আক্রমণ হয়েছে, এটা নিয়ে আমার কিন্তু একটা সন্দেহের জায়গা আছে। আমি খোলাখুলি বলছি আপনাকে।


তন্ময়— অবশ্যই। এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা তো খুবই জরুরি।

তুহিন মুখোপাধ্যায়— এই যে জয়দেববাবুর বইটা—দেশে বিজ্ঞাপন বেরোত। বহুকাল আগের ব্যাপার। সেই বিজ্ঞাপন আমি খুঁজে বার করেছিলাম। তাতে নীহাররঞ্জন রায়ের কোনো এক চিঠির একটা অংশ তুলে দেওয়া হয়েছিল। তাতে বলা ছিল, ‘আমি সবটাই জানি কিন্তু আমার শহিদ হওয়ার কোনো আগ্রহ নেই’। কিন্তু নীহাররঞ্জন রায়কে যাঁরা চিনতেন, জানতেন ইত্যাদি, তেমন কারোর কাছেই আমি কিন্তু শুনিনি যে তিনি কোনো হুমকি চিঠি পেয়েছিলেন বা অমুক-তমুক কোনো ব্যাপার হয়েছিল। এবার জয়দেববাবুর মৃত্যু নিয়ে কিন্তু ওড়িশাতেও কিছু কিছু মহল অন্যরকম মতামতও দিয়েছে। অর্থাৎ, চৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে কাজ করতে গিয়েই তিনি খুন হয়ে গেলেন—এটা কিন্তু অনেকেই বিশ্বাস করেন না। ওড়িশার এক সাংবাদিক বন্ধু, তাঁরা কিন্তু খোঁজখবর করতে গিয়ে জেনেছিলেন, উনি যেখানে থাকতেন মাকে নিয়ে আশ্রমে, সেখানে এক বৃদ্ধা বাস করতেন। খুবই ধনী পরিবারের এক বৃদ্ধা। ছেলেদের সঙ্গে ওঁর বনিবনা না-হওয়ার কারণে নিজের সমস্ত গয়নাগাটি বেঁধে নিয়ে উনি চলে এসেছিলেন। প্রচুর গয়না। এখন ওঁর ছেলেরা মাঝেমাঝেই এসে হানা দিতে আরম্ভ করে যে, ‘মা, তুমি কেন এখানে চলে এলে? ফিরে চলো। আর যদি না-ই যাও তাহলে, তুমি তো এই জীবন বেছে নিয়েছ, এইসব গয়নাগাটি নিয়ে তুমি কী করবে? আমাদের দিয়ে দাও...’ ইত্যাদি ইত্যাদি ব্যাপার।

আমি আবারও বলছি, এটা শোনা কথা। সত্যি-মিথ্যে জানি না। যেমন জয়দেববাবু যে চৈতন্যের অন্তর্ধান নিয়ে কাজ করতে গিয়ে খুন হয়েছেন—এটা শোনা কথা, ঠিক পালটা একটা শোনা কথাই আপনাকে শোনাচ্ছি। তো, এই ভদ্রমহিলা জয়দেববাবুকে খুব ভালোবাসতেন। এবং অনেকেই অনুমান করেন যে জয়দেববাবুকে বলে গেছিলেন, আমার যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে আমার গয়নাগুলো অমুক জায়গায় আছে। এবং ওই কারণে জয়দেববাবুকে চেজ করার জন্য ওইরকম একটা ব্যাপার হয়েছিল। মানে ওঁর কাছ থেকে গয়নাগুলোর খোঁজ পাওয়ার জন্য—এরকমটা অনেকেই দাবি করেন। কারণ, একটা জিনিস খেয়াল রাখবেন, জয়দেববাবুর ‘কাহাঁ গেলে তোমা পাই’ যখন প্রথম তমলুক থেকে বেরিয়েছিল একটি পত্রিকাতে, তখনও পড়েছিলাম, পরেও বইটা জোগাড় করে পড়েছিলাম—কোথাও কিন্তু চৈতন্যের অন্তর্ধান নিয়ে এমন কোনো বিস্ফোরক তথ্য নেই যা তাঁকে বিপন্ন করে তুলতে পারে। কেন-না, পুরো বইটাই লেখা হয়েছে একটা থ্রিলারের ঢং-এ। এবং সব-জায়গাতেই জয়দেববাবু যেটা করেছিলেন—আমি তাঁকে অসম্মান করছি না, হয়তো এটাই তাঁর লেখার টেকনিক ছিল বা পরবর্তীকালে আরও কিছু করতেন হয়তো—সেটা হচ্ছে... বহুকাল আগে ‘অভিনেত্রী সংঘ’ একটা নাটক করত 'মিশর কুমারী’ বলে। সেখানে ‘আবন’ বলে একটা ক্যারেক্টর ছিল। সে মাঝেমাঝে বলত, ‘আমি জানি কিন্তু বলব না।’ জয়দেববাবুও যেন এই বলি বলি করেও বলছেন না। কেমন একটা ব্যাপার করে যাচ্ছেন। এবং দ্বিতীয় ব্যাপার—এগুলো আদৌ তিনি জোগাড় করেছিলেন কি করেননি, এটা কিন্তু কেউ জানেন না। সবটাই শোনা কথা, সবটাই অনুমানের কথা। ফলে তিনি যে এইটার জন্যেই খুন হয়েছিলেন, এমন কোনো ব্যাপার কিন্তু উইথ এভিডেন্স প্রমাণ করা খুব কঠিন ব্যাপার।


তন্ময়— আর জয়দেববাবু বা নীহাররঞ্জনবাবু ছাড়াও যাঁরা চৈতন্য নিয়ে গবেষণা করেছেন, সেই মহলে যে একটা গুঞ্জন শোনা যায় যে, পুরীর পাণ্ডা বা অন্যান্য অন্যান্য মহল থেকে সাবধানবাণীর মুখোমুখি হয়েছেন—এটার কোনো বাস্তব ভিত্তি আছে?

তুহিন মুখোপাধ্যায়— দেখুন, আমি কোনো বাস্তব ভিত্তি খুঁজে পাইনি। আমাকে ঘনিষ্ঠ মহলের অনেকে বারণ করেছে খোঁজখবর করতে, যাঁরা কাজটার কথা জানত। কিন্তু আমি কোনো নির্দিষ্ট মানুষের খোঁজ পাইনি বা কথা শুনিনি যাঁরা এরকম কোনো সংলাপ বা হুমকির মুখোমুখি হয়েছেন। এমন একটা ব্যাপার কিন্তু হতে পারে—আমি কাউকে অপমান করছি না—যাঁরা এইধরনের কাজকর্মগুলো করেছেন, তাঁরা হয়তো এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছিলেন যে, দেখো আমি কতটা ঝুঁকি নিয়ে, কতটা বিপদের মুখোমুখি হয়ে এই কাজটা করছি। এটা খুব অসম্ভব ব্যাপার নয়। কাজেই এটা সম্বন্ধে কংক্রিট কিছু বলা কঠিন। আমি এইধরনের কোনো ঘটনার মুখোমুখি হইনি। বইটা বেরোবার পরেও ধরুন সাতটা বছর পেরিয়ে আট বছর শেষ হতে চলল, তার মধ্যে বেশ কিছু লোকের কাছে বইটা পৌঁছেছে—এমন একটা ভাবার জায়গা তো থাকেই যে, যদি সত্যিই এমন কোনো চক্রের বাস্তব অস্তিত্ব থাকে, ‘ক্ষমা করো হে প্রভু’-তে যার কথা বলা হয়েছে—সেটা বাস্তবে আছে কিনা লেখক বলতে চাননি, তবে এমন একটা ব্যাপার তো উনি দেখিয়েছেন বা যেটা শোনা যায়—তাহলে সেই চক্রটাও তো রীতিমতো খোঁজ রাখত যে চৈতন্যের সম্পর্কে কী বেরোচ্ছে, কী লেখা হচ্ছে, কী মত ছড়ানো হচ্ছে। এবং তাঁরা নিশ্চয়ই বাংলা বইয়েরও খোঁজখবর রাখে। কারণ, যাঁরা এইধরনের হুমকি বা ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন বলে শোনা যায়, তাঁরা তো সকলেই বাংলাতেই লিখেছেন। তাহলে এতকিছুর পরও আমার বইটা তাঁদের নজরে পড়ল না, আমাকে ফোনে একটা কিছু বললেন না, ভয় দেখালেন না যে বইটা তুলে নিন, অমুক-তমুক... এটা তো আমি ফেস করিনি কোনোভাবেই। এটার সত্যতা সম্পর্কে যাচাই করাটা অনেকটা ভূত দেখার মতো ব্যাপার। ভূত, ভূত, ভূত— কিন্তু তার আর দেখা পাওয়া যায় না। এরকম ভাবেই যেন কাজ করে গেছে ব্যাপারটা।


তন্ময়— অদ্যাবধি চৈতন্যের মৃত্যু বা অন্তর্ধান নিয়ে যে-ঘটনাগুলোকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেগুলো হল— ১ জগন্নাথ-দেহে লীন হয়ে যাওয়া; ২ সমুদ্রে ডুবে মৃত্যু; ৩ পায়ে আঘাত পেয়ে বিষিয়ে যাওয়া, ৪ ছদ্মবেশে নীলাচল ত্যাগ ও ৫ গুপ্তহত্যা। এইগুলোর মধ্যেই কোনো-একটিকে একেকজন গবেষক মুখ্য হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। এই প্রত্যেকটা ঘটনারই পটভূমিই কিন্তু পুরী। কিন্তু আপনি সম্ভাব্যতা-নির্ভর সম্পূর্ণ নতুন একটা তত্ত্ব আনলেন, ক্ষেত্রটাকে নিয়ে গেলেন পুরী থেকে দূরে কটকের কাছে। আপনি বললেন, ১৫৩৩-৩৪ সালে চৈতন্য প্রায় এগারো মাস চূড়ঙ্গগড় দুর্গে বন্দি ছিলেন এবং সেখানেই মারা যান। তারপর সিদ্ধেশ্বর পাহাড়ের কোলে এক জঙ্গলে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। সেই সূত্রে ‘সাড়ে তিন অক্ষরের’ একটা চিত্রলিপির সংকেতের কথা উল্লেখ করলেন এবং এ-ও জানালেন, চৈতন্যকে সমাধি দেওয়ার প্রায় চল্লিশ বছর পর, হরিহরপুর দুর্গে রসিকরায় মন্দিরে তাঁর দেহাবশেষ স্থানান্তরিত হয়ে থাকলেও থাকতে পারে। আপনার এই যে তত্ত্ব— আট বছর পেরিয়ে এই তত্ত্বের কোনো অগ্রগতি হয়েছে?

তুহিন মুখোপাধ্যায়— দেখুন, আমি এটা বারবারই লিখেছি যে, চৈতন্যের অন্তর্ধান নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়। আমরা যুক্তিসঙ্গত তথ্যভিত্তিক একটা হাইপোথিসিসে আসতে পারি। এবং এটাকে আমি সেইভাবেই দেখেছি। আমার এই সিদ্ধান্তকে কেউ যেন চূড়ান্ত বলে মনে না করেন, এটা আমি বারবারই বলেছি। এখনও আমার তত্ত্বটি বদলাবার কোনো কারণ খুঁজে পাইনি। কারণ, পাল্টা কোনো যুক্তি আমার কাছে আসেনি। আমার বইটার বেরোবার পরেও আরও কিছু কিছু লেখা হয়েছে—নাম করছি না সে-বইগুলোর, যেগুলো আমি পড়েছি—তার মধ্যেও আমার মতটাকে বদলে ফেলার মতো নতুন কোনো কথা বা বিশ্বাসযোগ্য তথ্য আমি খুঁজে পাইনি। সে-জন্য আমিও এখনও পর্যন্ত আমার ওই হাইপোথিসিসেই দাঁড়িয়ে আছি।

আমি যেটা লিখেছিলাম সেটা হচ্ছে, চৈতন্যকে যাঁরা সমাধি দিতে গিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে তাঁদেরই মধ্যে কেউ একজন ‘সাড়ে তিন অক্ষরের’ লিপিটি তৈরি করেন। তাতে একটা আঁকাবাঁকা লাইন গিয়ে শেষ হয়েছিল একটা বিন্দুতে। এবং সেইটা ধরে গেলে জঙ্গলের গভীরতম জায়গাতে একটা সমাধির খোঁজ পাওয়া যায়, যেখানে আমাদের প্রস্তুতি ছিল না বলে ঢুকতে পারিনি। তার কারণ, আমি আর আমার যে-বন্ধু গিয়েছিল— আমরা জানতাম না যে এত ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকতে হবে। আমাদের যিনি রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনিও ভাবেননি যে ওখানে ভেতরে ঢোকার দরকার হবে। ওই অঞ্চলে একটা জনশ্রুতি আছে যে, অন্তত পাঁচশো বছর আগে কোনো এক বিখ্যাত সাধককে ওইখানে সমাধিস্থ করা হয়েছে। এবং যেটা চৈতন্য হলেও হয়তো হতে পারেন। এটা আমাদের বিভিন্ন তথ্য, যুক্তি দিয়ে মিলিয়ে মনে হয়েছিল।


তন্ময়— আমার একটা কৌতূহল—এই যে ‘সাড়ে তিন অক্ষরের’ চিত্রলিপি, আপনি এটার কি কোনো ছবি তুলেছিলেন? আপনি মূলটা পাননি বলেছেন, কিন্তু নিচে একটা দুর্বল প্রতিলিপি দেখেছিলেন, সেইটার কি কোনো ডকুমেন্টেশন করা হয়েছিল?

তুহিন মুখোপাধ্যায়— প্রথমত যে-লিপিটা রয়েছে এখন, মানে আমরা যেটা দেখতে পেয়েছিলাম, সেই লিপিটা খোদাই করে করা লিপি নয়। যাঁর লেখায় এটার খোঁজ পেয়েছিলাম, তিনি ভুবনেশ্বরের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের এক প্রাক্তন ডিরেক্টর, নাম আরপি মহাপাত্র। তিনি ‘আর্কিওলজি অফ ওড়িশা’ বলে একটি বই লিখেছিলেন, মোটা বই, তাতে মূল লিপিটার ছবি আছে। তো আমি ওখানে গিয়ে যখন দেখি, তখন সেই ছবির সঙ্গে লিপিটা মেলেনি। তার কারণটা আমি ধরতে পারলাম ওখানে দাঁড়িয়েই। প্রচুর পাথর আছে যেগুলো স্তরে স্তরে তৈরি হয়। অনেক সময় দেখবেন তার একটা অংশ খসে গেছে বা খুলে গেছে—এমনটা মাঝেমধ্যেই হয়। এই পাথরটারও একটা অংশ কিন্তু খসে গিয়েছিল। বাকি যেটুকু ছিল, তাতে বহু প্রাচীন খোদাই করা কিছু চক্র, শঙ্খ ইত্যাদি নানারকম চিহ্ন ছিল। যেগুলোর অর্থ আমি বুঝিনি। কিন্তু যে-অংশে সেই লিপি ছিল, সেখানের একটা পরত খুলে পড়ে গেছে। এবং সেইখানে কোনো সূচালো পাথর দিয়ে আঁকা হয়েছে নতুন লিপিটা। আগেরটা যেটা ছিল, সেটারই অনুকরণে। তার মানে যিনি এঁকেছিলেন তিনি আগেরটাও দেখেছিলেন ওই অংশটা খসে পড়ে যাওয়ার আগে। এবং সেটার ছবি তোলা যায়নি তার কারণ, এটা করতে গেলে অত্যন্ত উঁচু মানের ক্যামেরার প্রয়োজন হয়, যা আমাদের কাছে ছিল না। খুবই সাদামাটা একটা সোনির ক্যামেরা ছিল। আর দ্বিতীয় ব্যাপার হল, পাথরের ওপর খোদাই করা হলে লিপিগুলো তো একই রঙের হয়ে যায়, সেগুলোকে চুন বা পাউডার জাতীয় কিছু একটার প্রলেপ দিয়ে সেটা উড়িয়ে দিলে, তবে আসল চিহ্নটা ফুটে ওঠে। তারপর সেটার ছবি তুলতে হয়। কিন্তু এইটা যেহেতু একটা খসে যাওয়া অংশ, কাজেই ওই অংশটার রং যা ছিল আর তার ওপর আঁচড় কেটে সূচাল পাথর দিয়ে যেটা করা হয়েছে, সেটা ক্যামেরায় আসছিল না। সে-জন্য ছবিটা তুলতে পারিনি।


তন্ময়— আমাদের এই আলোচনায় বার বার উঠে আসছে, ‘সাড়ে তিন অক্ষরের’ চিত্রলিপি—অর্থাৎ ছবির মধ্যে দিয়ে একটা কথা বোঝানো হয়েছে। সেটা কি একান্তই রহস্য-সংকেত বোঝানোর জন্য নাকি স্বতন্ত্র কোনো ভাষা? ষোড়শ শতকের ওড়িশায় নতুন কোনো ভাষার উদ্ভব হয়েছিল কি? নইলে ছবিটার আড়ালে কি কিছু বলার চেষ্টা করা হচ্ছে, যার পাঠোদ্ধার করা যায়নি?

তুহিন মুখোপাধ্যায়— আমি সেটাই বলতে চাইছি। তার কারণ ওড়িশার আরও বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন বিষয়ে এ-ধরনের বিভিন্ন লিপি তখন প্রচলিত ছিল।


তন্ময়— চৈতন্যের সমসময়ে? মানে পঞ্চদশ বা ষোড়শ শতকেই?

তুহিন মুখোপাধ্যায়— হ্যাঁ, এই সময়েই প্রচলিত ছিল। এবং এই লিপিগুলো সাধারণত শেষ হত বিন্দুতে—মানে লাইন দিয়ে গিয়ে একটা বিন্দুতে শেষ হত। এখানে যে তিনটে ফিগার দেখা যায়, তার প্রতিটার মাথাতেই একটা করে চাঁদ আঁকা আছে। এবং ওড়িশার প্রাচীন ধারা অনুযায়ী কিন্তু কোনো বড়ো সাধক বা মহাপুরুষকে বোঝানোর জন্য এই চাঁদের চিহ্নটা দেওয়া হয়। ওই তিনটে ফিগারের কপালেই কিন্তু চাঁদের চিহ্নটা ছিল।


তন্ময়— এবং আপনার অনুমান, ওই তিনজন চৈতন্য, গদাধর পণ্ডিত এবং স্বরূপ দামোদর…

তুহিন মুখোপাধ্যায়— এখানে একটা আশ্চর্য ব্যাপারও আছে, সেটা বলি আপনাকে। যে-চিত্রলিপিটি আমরা দেখেছিলাম, সেটা পরবর্তীকালে খুবই অপটু হাতে করা, অরিজিনালটা আমরা দেখতে পাইনি। কিন্তু যিনি আমাদের গাইড ছিলেন, মানে লোকাল যে-মানুষটি আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি আমাদের একটা কথা বলেছিলেন, এরকম আরেকটা চিত্রলিপি আরও ওপরের দিকে, আরও ঘন জঙ্গলের মধ্যে আছে। তবে সেখানে তিনি বহুদিন যাননি। সেটা হয়তো ইনট্যাক্ট থাকলেও থাকতে পারে। আমরা সেখানে ঢুকতে পারিনি। যাই হোক, যেটা বলার, ওই ছবিটার মূর্তিগুলো প্রত্যেকটিই মুণ্ডিত-মস্তক। তার মধ্যে একটা—মানে একটা ফিগার বিরাট লম্বা। মানে অ্যাবনর্মালি লম্বা বলা যেতে পারে। চৈতন্যদেবও কিন্তু তা-ই ছিলেন। দ্বিতীয় ফিগারটা তার থেকে ছোটোখাটো এবং খুব রোগাসোগা একজন মানুষ। যেটা স্বরূপ দামোদরের বর্ণনা যেটা পাওয়া যায়, তার সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়। আর তৃতীয় ফিগারটা একটু ছোটোখাটো চেহারার, একটু গোলগাল টাইপের—তার সঙ্গে গদাধরের যে-বর্ণনা পাওয়া যায়, তার মিল আছে। আমি নিশ্চিত দাবি কখনোই করতে পারব না, যেহেতু ওটার পাঠোদ্ধার হয়নি আর আমি তো ওই মাপের পণ্ডিত নই—আর যাঁরা দেখেছেন তাঁরাও তো পাঠোদ্ধার করতে পারেননি। কারণ আর্কিওলজির প্রাক্তন ডিরেক্টর, যাঁর কথা আমি বললাম, উনিও কোনো অর্থ বার করতে পারেননি, শুধু লিপিটারই খোঁজ দিয়েছেন। আমাকে যেটা ভাবিয়েছিল, সেটা হল জায়গাটার লোকেশন। চূড়ঙ্গগড় থেকে ওখানে আসার সহজতম একটা উপায়—যদি সমাধি দিতে হয়, তবে ওই জায়গাটা—মানে লিপিটার আশপাশের অঞ্চলটা সবচেয়ে স্যুটেবল জায়গা ছিল। সেখানে যখন এমন একটা লিপি পাওয়া যাচ্ছে এবং ওই লিপির লাইনটা গিয়ে জঙ্গলের মধ্যে যে-সাধকের সমাধির কথা লোকমুখে শোনা যায় এবং তার ভগ্নাবশেষ কিছু কিছু দেখাও যাচ্ছে যেন, মানে কিছু কিছু পাথরের অবশেষ রাখা আছে সাজানো—সেটাকেই ইন্ডিকেট করছে। ফলে, আমার মনে হচ্ছে, এটা চৈতন্য-স্বরূপ দামোদর-গদাধরের সমাধি হলেও হতে পারে।


তন্ময়— আপনি ২০১৩ সালে ওখানে গিয়েছিলেন। আপনি যখন গেলেন এবং দুর্ভেদ্য জঙ্গলে প্রবেশ করতে পারলেন না, তার পরে কি আবার দ্বিতীয়বার প্রবেশ করার প্রচেষ্টা নিয়েছেন? বা পরবর্তীকালে অন্য কেউ সেই প্রচেষ্টা নিয়েছে বলে আপনার জানা আছে?

তুহিন মুখোপাধ্যায়— আমি নিজে কোনো প্রচেষ্টা নিইনি। আমাকে কিছু জুনিয়ার ছেলেপুলে, তারা কেউ প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ে, কেউ অন্যান্য জায়গায়—তারা আমাকে অনুরোধ করেছিল যে, আপনি যদি পরবর্তীকালে ওখানে যান, তাহলে আমরাও আপনার সঙ্গী হতে চাই। আমি যাইনি যে-কারণটার জন্য, সেই কারণটা পরিষ্কারভাবে বলি। ওই জঙ্গলের মধ্যে ওখানে যদি খুঁড়ে কিছু বার করতে হয় আমাকে, সেই প্রশিক্ষণ আমার নেই। কারণ এগুলোর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের দরকার হয়। একটা লোকাল সেন্টিমেন্টও কাজ করে সেখানে। প্লাস এই অঞ্চলে একটা বিপদেরও ভয় আছে। সেটা হচ্ছে, ওখানে আরেকটা জনশ্রুতি চলে। ওই জায়গাটার খুবই কাছে মহানদীতে সোনা-ভর্তি একটা জাহাজ ডুবেছিল। এবার সেই জাহাজটার লোকেশনটা এই চিত্রলিপির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। এবার ওইটা নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে—যেহেতু এখনও অনেক মানুষ বিশ্বাস করেন এটা একটা গুপ্তধনের নকশা—ফলে আমি খুন হয়ে যেতে পারি। এই মানুষটা এখানে গিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি করতে গেছে মানে এ নিশ্চয়ই ওই গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে। এটা আমার কাছে একটা চরম ঝুঁকির কারণ বলে মনে হয়েছে। যেটা ফেস করার ক্ষমতা আমার নেই। এবং লোকাল প্রশাসন এবং সরকারি দপ্তর এই ব্যাপারে এত উদাসীন থাকে… কেন সেটা বললে বুঝতে পারবেন। আমি যখন ভুবনেশ্বরে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার রিজিয়নাল অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম একটা কানেকশন থেকে, ওরা তখন বলল এরকম একটা লিপি আছে নাকি? বললাম, আপনাদেরই এক ডিরেক্টর লিখে গেছেন এটা। শুনে বলল, আমরা তো ঠিক খেয়াল করতে পারছি না, লাইব্রেরিতে আমাদের কিছু বই আছে, আমরা দেখব, আমাদের দুটো দিন সময় দিন। পরে আবার ফোন করলাম, তাতে বলল, উনি ছবিও তুলেছেন, লিখেছেন সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু ওদিকে তো পরবর্তীতে মহানদীর ওপর একটা রিজার্ভার গড়ে উঠেছে। যদি রিজার্ভারের জলে ডুবে না-গিয়ে থাকে তাহলে তো থাকার কথা। কারণ, জলে তো চট করে বোল্ডার নষ্ট হয়ে যাবে না। কিন্তু ওটা ডুবে গেছে কিনা আমরা জানি না।


তন্ময়— ওই রিজার্ভারটা কি আপনার যাওয়ার পরে তৈরি হয়েছে?

তুহিন মুখোপাধ্যায়— না, না, আমি যাওয়ার আগে যখন খোঁজখবর করছি জায়গাটা নিয়ে। এবং ওঁরা আমাকে এইটুকু বলে উদ্ধার করলেন যে, যদি আমি যেতে চাই তাহলে বড়োজোর আমাকে একটা জিপ দিয়ে সাহায্য করতে পারেন। আর কিছু লোকজন দেবেন, যাঁরা আমাকে জায়গাটা চিনিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু ডুবে গেছে কিনা আমরা জানি না। এই হচ্ছে ওঁদের কাজ-কর্মের ধারা। এবং লোকাল পুলিশ আমার কথার ভিত্তিতে হঠাৎ করে কোনো প্রোটেকশন দেবে কিনা তারও হিসেব নেই। আমি নেক্সট টাইম আর খোঁজ করতে যাইনি তার আরও একটা কারণ হল, আমি আরেকটা জিনিস আমি বুঝে গিয়েছিলাম আগামীতে খোঁজ করতে যাওয়াটাও আমার পক্ষে নানা কারণেই মুশকিল। ধরুন আমি কিছু খুঁজে পেলাম, এটা যে চৈতন্যেরই সমাধি ছিল বা অন্য কারোর—সেটা আমি কীভাবে প্রমাণ করব? যেমন ধরুন হরিহরপুর দুর্গে রসিকরায় মন্দিরের ওই যে সিক্রেট চেম্বারটার কথা আমি উল্লেখ করেছি, সেটা আমাকে তো কেউ খুঁড়ে দেখতে দেবেন না। তাও ধরুন না-হয় সরকারি মহলে প্রভাব বিস্তার করে, খুঁড়ে কিছু হাড়-গোড় পাওয়া গেল। এখন এই হাড়-গোড়গুলোর সি-ফরটিন স্টাডি করে, ডিএনএ ম্যাচিং করে চৈতন্যের অথবা ওঁদের কারোর জিনের সঙ্গে মিল বার করা—এগুলো তো পুলিশি কাজ। এটা আমি কীভাবে করব? তার কারণ চৈতন্যের কোনো সন্তান-সন্ততি ছিল না। তার ওপর তাঁর কাকা-জ্যাঠা যাঁরা ছিলেন... বিশ্বরূপের কোনো খোঁজ পাওয়া যাবে না, কারণ তিনি বিয়ে করেননি, পরবর্তীকালে সন্ন্যাস নিলেন এবং মারা গেলেন। বিশ্বরূপের ডিএনএ-এর ট্রেস পাওয়া সম্ভব নয়। তাহলে জয়ানন্দের লেখায় তাঁর যে সাত কাকা-জ্যাঠার কথা উল্লিখিত হয়েছিল, তাঁদের প্রকৃত উত্তরাধিকারী খুঁজে বার করে এই জঙ্গলের মধ্যে থেকে হাড়-গোড় বার করে ডিএনএ ম্যাচিং করাতে হয়। সেটা তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়, যদি-না সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়।


তন্ময়— চৈতন্যের সেইসব কাকা-জ্যাঠাদের কি চিহ্নিত করা যায়? তাঁরা সবাই কি শ্রীহট্ট থেকে নবদ্বীপে এসেছিলেন?

তুহিন মুখোপাধ্যায়— তাঁদের চিহ্নিত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, বিগত সাড়ে পাঁচশো বছরে তাঁরা কে কোথায় ছড়িয়ে গেছেন, সেটা বলা মুশকিল। নবদ্বীপে শুধুমাত্র শ্রীচৈতন্যের বাবাই এসেছিলেন। বাকিরা ওই অঞ্চলেই ছিলেন। এবং তার পর থেকে পূর্ববঙ্গের শ্রীহট্ট অঞ্চলে বা যেখানেই বলুন না কেন প্রচুর রাজনৈতিক ব্যাপার হয়েছে, প্রচুর মানুষ বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে গেছেন, দেশভাগ হয়েছে, সে-সময় প্রচুর মানুষ ওপার থেকে চলে এসেছেন পশ্চিমবঙ্গে। কেউ আন্দামানে চলে গেছেন, কেউ কলকাতার জনসমুদ্রে মিশে গেছেন, কেউ দণ্ডকারণ্যে চলে গেছেন। তাঁদের কীভাবে আপনি খুঁজে বার করবেন? সেটা আমি কীভাবে পারব? ফলে এই সমস্ত ব্যাপার ভেবেই ওখানে আমি আর খোঁজ করতে যাইনি। যদি আগামীদিনে কোনো গবেষকের সেই ক্ষমতা থাকে, তাহলে তিনি সেটা খোঁজ করতে পারেন। তবে আমার সেই ক্ষমতা নেই।


তন্ময়— এখানে যদি আমি চূড়ঙ্গগড় আর হরিহরপুরের প্রসঙ্গটা সরিয়ে রাখি, তাহলেও যে মূল যে তত্ত্বটা উঠে আসে, সেটাও সেটা খুবই চাঞ্চল্যকর—চৈতন্যকে পুরী থেকে নিয়ে এসে বন্দি করে রাখা হয়েছিল এগারো মাস। এই তত্ত্ব খুব সম্ভবত আপনি ছাড়া আর কোনো গবেষকের কথায় উঠে আসেনি, আমার জ্ঞান মতে। এটি প্রকাশ্যে আসার পর পাঠকের প্রতিক্রিয়া কী ছিল? আপনাকে কি কোনো মতানৈক্যের মুখোমুখি হতে হয়েছে?

তুহিন মুখোপাধ্যায়— পাঠকদের প্রতিক্রিয়া যেটা আমি পেয়েছি— অনেকেই ফোন করেছেন প্রকাশকের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে— তাঁদের অনেকেরই মনে হয়েছে এটাই সম্ভবত সত্যের সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছেছে। এক ভদ্রলোক, আমি নাম করব না—তিনি কোনো একটা মাধ্যম থেকে যোগাযোগ করে আমার কাছে এসে হাজির হন। বলেন, তিনিও চৈতন্যের অন্তর্ধান নিয়ে কাজ করছেন, আমার এই মতটার সঙ্গে একমত নন। অনুরোধ করেন, যদি আমি আমার নোটস বা ফাইন্ডিংগুলো ওঁকে দিই, তবে ওঁর কাজটা এগোতে সুবিধা হবে। আমি খানিকটা অবাকই হলাম, যে এটা কীধরনের অনুরোধ হচ্ছে। আমি যে এত খেটে-খুটে এত জায়গা থেকে এত সমস্যার মধ্যে দিয়ে গিয়ে এই যে তথ্যগুলো পেলাম, সেগুলো কেন তাঁকে দিতে যাব? আমাকে তো কেউ এগুলো দেয়নি। তিনি সেগুলো নিজেই খুঁজে বার করে নিন। কিন্তু যিনি ওঁকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন, তিনি অত্যন্ত স্নেহভাজন মানুষ এবং আমার এই কাজটা করার সময় বিভিন্ন বইপত্র দিয়ে আমাকে এতটাই উপকার করেছিলেন যে, আগত ভদ্রলোকটির অনুরোধ আমি ফেলতে পারলাম না। আমার নোটসের একটা পার্ট আমি তাঁকে দিয়েছিলাম কিন্তু। পরবর্তীকালে তাঁর একটি বই বেরোয় চৈতন্যের অন্তর্ধান নিয়ে। আমি কিন্তু বইটার নাম বা লেখকের নাম বলব না। তিনি কিন্তু বইটা কৃতজ্ঞতা মেনেও এক কপি আমাকে পড়তে দেননি।


তন্ময়— এই বইটিতে কি আপনার তত্ত্ব খণ্ডিত বা আলোচিত হয়েছে?

তুহিন মুখোপাধ্যায়— কোনো বিশেষ তত্ত্ব বা মতকে তুলে ধরা মানে, যে ভাবেই হোক, অন্য মতকে খণ্ডন করতে চাওয়া। কিন্তু এখানে প্র্যাকটিক্যালি চেষ্টাটা সেভাবে দাঁড়ায়নি। ওঁর তত্ত্বের পিছনে আমি এমন কোনো যুক্তি বা বিশ্লেষণ খুঁজে পাইনি, যার ওপর আমি নির্ভর করতে পারি বা যেটা আমাকে ভাবিয়ে তুলতে পারে। কাজেই আমি সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছি। যদি আগামীদিনে সেইধরনের কোনো বইপত্র আমার হাতে আসে, তাহলে নিশ্চয়ই আমার ধারণা বদলাতে পারে।

(দ্বিতীয় পর্ব)

অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor