‘‘বরুণদার গল্পগুলো অনেকটা বরুণদারই মতো। স্মার্ট, ঋজু ও মেদহীন।” বলছিলেন চিত্রপরিচালক অনীক দত্ত। গতকাল, ৬ অক্টোবর স্টারমার্কে বসেছিল চাঁদের হাট। ছিলেন অনীক দত্ত, অতনু ঘোষ, অলকানন্দা রায়ের মতো ব্যক্তিত্বরা। তাঁদের মাঝেই মঞ্চে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হল ১০টি প্রাপ্তমনস্ক বাংলা থ্রিলারের সংকলন―ঘোলাটে জল। লেখক, বরুণ চন্দ (Barun Chanda)। সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালির কাছে যিনি ‘সীমাবদ্ধ’র শ্যামলেন্দু চট্টোপাধ্যায়। বর্তমানেও নিয়মিত তাঁকে দেখা যাবে বড়পর্দা কিংবা ওটিটির আঙিনায়। পাশাপাশি চলছে কলম। ‘ঘোলাটে জল’ তাঁর লেখা চতুর্থ থ্রিলারধর্মী বই। এর আগে পত্র ভারতী থেকেই প্রকাশিত হয়েছে, ‘সাপের ঝাঁপি’, ‘কোক’ এবং ‘কিডন্যাপ’। তাঁর সৃষ্টি অবিনাশ-প্রদ্যোৎ গোয়েন্দা জুটি পাঠকমহলে সমাদর কুড়িয়েছেন।
‘বাংলায় যা থ্রিলার লেখা হয় সেগুলোর অধিকাংশই খুব স্যানিটাইজড’―বরুণ চন্দের গলায় খানিক শ্লেষের সুর। সত্যি কথা বলতে গেলে, মননশীল বাঙালি থ্রিলার সাহিত্যকে, সিরিয়াস সাহিত্য হিসাবে মনে করে না। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরে কিশোরবয়স্কদের জন্য লেখা রোমহর্ষক দাদাধর্মী গোয়েন্দা উপন্যাসেই যেন তা আটকে গিয়েছে। যৌনতার ধারও মাড়ায় না গল্পের বুনোট। এক অদৃশ্য সেন্সর বোর্ড সর্বদা কাঁচি চালিয়ে চলেছে, শব্দ-বাক্য-অনুচ্ছেদে। অথচ সিনেমার পর্দায় থ্রিলার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জঁর। বিশেষত হিচকক থেকে ডেভিড ফিঞ্চার―হলিউডে থ্রিলার হয়ে উঠেছে যেন একটি স্বতন্ত্র আর্টফর্ম। জন লেক্যারের ভক্ত বরুণ চন্দ, তাই বাংলা থ্রিলারকে সাবালক করে তুলতেই ধরেছেন কলম। তাঁর লেখায় ‘ডার্টি মার্ক’ থাকলেও গল্পের চরিত্রদের মনে হয় রক্তমাংসেরই মানুষ। গল্পের উপাদানও বাস্তবে ঘটে যাওয়া কোনো না কোনো ঘটনা অবলম্বনে। ‘ঘোলাটে জল’ বইটিতে যেমন ১০টি গল্পের ৭টিই লেখা খবরের কাগজে বেরোনো কোনো ক্রাইমের ঘটনার সঙ্গে খানিক কল্পনার মিশেলে।
আরও পড়ুন
ইউরোপজুড়ে ছাপা হত ‘বিষাক্ত বই’, দীর্ঘদিনের ব্যবহারে হতে পারে মৃত্যুও
আলোচনা আরেকটু গড়াতেই উঠে এল থ্রিলারের মনস্তাত্ত্বিক দিকটি। পরিচালক অতনু ঘোষ বলছিলেন, সম্পর্ক ও মনের জটিল সমীকরণের কথা। যাকে ঘিরেই মূলত নির্মাণ হয়েছে, ‘অংশুমানের ছবি’ কিংবা ‘রূপকথা নয়’। পরিপার্শ্বের সঙ্গে পাল্টাতে থাকা মনস্তাত্ত্বিক অনুরণন মূলত কাহিনির প্রধান উপজীব্য হয়ে ওঠে। বস্তুতপক্ষে সিরিয়াস থ্রিলার সব পাঠকের জন্য নয়। ফলে যেখানে খেই হারান ফেলুদা কিংবা শার্লক, সেখানেই প্রবেশ ঘটে পোয়ারো অথবা ফাদার ব্রাউনের। অতনুর মতে বরুণ বাবুর লেখনী অত্যন্ত সিনেম্যাটিক। গল্প এগোয় প্রচন্ড গতিতে। অনেকটা নির্মেদ চিত্রনাট্যেরই মতো। কোথাও বর্ণনার ঘনঘটা নেই।
আরও পড়ুন
১০০ বছরেও অপঠিত, কোন রহস্য লুকিয়ে এই বইয়ের ভিতরে?
এই আশ্চর্য লিখনশৈলী অবশ্য বরুণ চন্দ রপ্ত করেছেন দীর্ঘদিন বিজ্ঞাপন সংস্থায় যুক্ত থাকার ফলে। এছাড়া নামী দৈনিকে দীর্ঘদিন প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সিনেমা সমালোচনা। আশি ছুঁই ছুঁই অভিনেতা আজও কাগজ কলমেই স্বচ্ছন্দ। আধুনিক প্রযুক্তিতে ততটাও সড়গড় নন। বরুণ চন্দের গোয়েন্দা ডিআইজি অবিনাশও আর পাঁচজন গড়পড়তা রুচিশীল বাঙালির মতোই একজন। স্ত্রীর সঙ্গে প্রায়শই মনোমালিন্য, টুকরোটাকরা নানা গার্হস্থ্য সংঘাত বিছিয়ে রয়েছে গল্পগুলিতে। খুব সহজ-সাধারণ পেক্ষাপটে গড়ে ওঠে গল্প। অপরাধীরাও কেউ অতিমানবিক বুদ্ধির অধিকারী নন। কেউ ক্রিমিনাল অফ প্যাশন, আবার কেউ বা সাধারণ কোনো ছিনতাইবাজ। যার প্রমাণ ছত্রে ছত্রে পাওয়া যাবে, এই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত ‘হাত দেখা’ গল্পটিতে। অনুষ্ঠান শেষে এই গল্পটিই শ্রোতাদের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন বরুণ চন্দ।
অতনু ও অনীক―দু'জনেরই মতে, বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্য ঘুরপাক খাচ্ছে ‘হুডানিটে’র গোলোকধাঁধায়। বলাবাহুল্য, বাংলার ছোট ও বড়পর্দাও দীর্ঘদিন ধরে ভুগছে গোয়েন্দা জ্বরে। ফেলুদা-ব্যোমকেশের মুহুর্মুহু রিমেক বাঙালি দর্শককে ক্রমশ হলবিমুখ করে তুলছে। সঞ্চালক ইন্দ্রনীল সান্যালের প্রশ্নের উত্তরে খানিক বরাভয়ই দিলেন অতনু। টেনে আনলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস। সেই ইতিহাসের নিয়মেই একদিন উৎকৃষ্ট মৌলিক থ্রিলার সাহিত্যের খরা কাটবে। কে জানে, সেই পথের পথিকৃৎ হয়তো হয়ে উঠতে পারে বরুণ চন্দের লেখনী।
Powered by Froala Editor