গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়নের দুনিয়ায় বহু সাহেবি খাবারই জায়গা করে নিয়েছে বাঙালির খাদ্যতালিকায়। কেক, কাটলেট কিংবা পিৎজা ছাড়া আজ সত্যিই অচল শহুরে বাঙালি। ঠিক সেভাবেই ডোনাটের স্বাদ নেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াই বিরল এই মুলুকে। বিশেষত, ছোটোদের মধ্যে এই ফাস্টফুডের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। ডোনাটের (Doughnut) নাম শুনলেই মাথায় আসে পেস্ট্রি কিংবা মিষ্টির কথা। তবে মজার বিষয় হল, জন্মলগ্নে এই খাবার বানানো হত কেবলমাত্র মাংস দিয়েই। এমনকি তার চেহারায় অনুপস্থিত ছিল আইকনিক গর্তটিও।
হ্যানসন গ্রেগরি (Hanson Gregory)। আজ আমরা যে ডোনাটের সঙ্গে পরিচিত সকলেই, তার রূপকার এই মার্কিন নাবিক। এমনকি আধুনিক ডোনাটের ‘আবিষ্কারক’ যে তিনি, তা প্রমাণ করতে মামলা গড়িয়েছিল আদালত পর্যন্তও। শুরু থেকেই বলা যাক গল্পটা।
বাঙালি মাত্রই চপ বা তেলেভাজার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। ডোনাট আদতে এই চপ বা তেলেভাজারই ডাচ সংস্করণ। ডাচদের ভাষায় তার নাম ছিল ‘ওলিকোয়েক’। উনিশ শতকের শুরুতে ব্যবসার খাতিরেই ওয়াশিংটনের নিকটবর্তী অঞ্চলে ক্রমশ গড়ে উঠতে থাকে ডাচ বসতি। আর সেই সূত্র ধরেই মার্কিন কুশিনে ঢুকে পড়ে ডোনাট। প্রাথমিকভাবে ‘ওলিকোয়েক’ মার্কিনিদের মধ্যে জনপ্রিয় হয় ‘ওয়েল কেক’ নামে। মাংস এবং ময়দার তালের মিশ্রণকে শূকরের চর্বি দিয়ে ভেজেই তৈরি করা হত এই খাবারটি। দেখতে ছিল অনেকটা বলের মতো। আর সেই কারণেই ‘ডো-নাট’ নামে তা পরিচিত হয়ে ওঠে বহু মানুষের কাছে।
তবে ডোনাটের এই আকারের কারণে দেখা যায় অন্য একটি সমস্যা। অনেকসময়ই ডোনাটের বাইরের অংশ ভালোভাবে ভাজা হলেও, কাঁচা থেকে যেত ভিতরের মাংসের পুর। ডোনাটের মাঝে গর্ত-যুক্ত করে এই সমস্যার সমাধান করেন হ্যানসন গ্রেগরি। এই ফাঁকে তাঁরও পরিচয় দিয়ে রাখা যাক বরং।
আরও পড়ুন
শান্তিনিকেতনে বাংলার হারিয়ে যাওয়া মিষ্টি ফিরিয়ে আনছেন অমর্ত্য সেনের ছাত্র
১৮৩২ সালে গ্রেগরির জন্ম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেইনে। মাত্র ১২ বছর বয়সেই জাহাজের নাবিক হিসাবে কাজ শুরু করেন গ্রেগরি। ১৫ বছর বয়সে হয়ে ওঠেন ক্যাপ্টেন। তৎকালীন সময়ে বিশ্বের কনিষ্ঠতম ক্যাপ্টেন ছিলেন তিনিই। এমনকি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার আগেই, ডুবে যাওয়া এক স্প্যানিশ জাহাজের নাবিকদের মাঝ-সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে স্পেনের রানি দ্বিতীয় ইসাবেলার থেকে বিশেষ সম্মাননাও পেয়েছিলেন গ্রেগরি। যাই হোক, আবার ফেরা যাক ডোনাট-ইতিহাসে।
আরও পড়ুন
১৭৫ বছরের পুরনো মিষ্টির দোকান, সেখানেই তৈরি বিশ্বের প্রথম রসগোল্লা তৈরির যন্ত্র
সে-সময় তরুণ গ্রেগরিকে ভাবিয়ে তুলেছিল তাঁর নাবিকদের স্বাস্থ্য। অধিকাংশ সময়েই সমুদ্রে পাড়ি দেওয়ার সময় পেটের রোগে আক্রান্ত হতেন তাঁর নাবিকরা। গ্রেগরি লক্ষ করেন, সহজে তৈরি করা সম্ভব বলে, নাবিকদের জন্য জাহাজে সকাল-সন্ধে টিফিন হিসাবে রান্না করা হয় ডোনাট। তবে তার অভ্যন্তরীণ অংশ কাঁচা থেকে যায় বলেই তা থেকে পেটের রোগের সমস্যা দেখা যায়। সমস্যার সমাধান করতে ডোনাটের আকার নিয়ে রীতিমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন গ্রেগরি। কখনও তাকে কাটলেটের মতো চ্যাপ্টা, আবার কখনও সসেজের মতো লম্বা ও সরু আকার দেন তিনি। তবে খুব একটা লাভ হয়নি তাতে। শেষে তাঁর মাথায় খেলে যায় এক অন্য বুদ্ধি। ডোনাটের তাল তৈরির পর বোতলের ঢাকনা দিয়ে তার মাঝে ছোট্ট গর্ত তৈরি করেন গ্রেগরি। ফলাফল ছিল রীতিমতো চমকপ্রদ। মাঝে গর্ত থাকার দরুন সুষমভাবে তেল ও মশলা পৌঁছাত ডোনাটের ভিতর।
আরও পড়ুন
বিজয়া-স্পেশাল মিষ্টি ‘নারিকেলছাবা’, ছিল প্রণামী দেওয়ার রেওয়াজও
সেটা ছিল ১৮৪৭ সালের ২২ জুন। জাহাজের নাবিকদের নিজে হাতে এই বিশেষ খাবার তৈরি করে খাইয়েছিলেন ক্যাপ্টেন গ্রেগরি। তারপর বাড়ি ফিরে এই খাবার তৈরি করতে শেখান তাঁর মা-কেও। তাঁর হাত ধরেই শুরু হয় হ্যানসন গ্রেগরির পারিবারিক ডোনাটের ব্যবসা। তৎকালীন সময় যা রীতিমতো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল মেইনে।
মায়ের মৃত্যুর পর সস্ত্রীক তিনি স্থানান্তরিত হন ম্যাসাচুসেটের সেইলর’স স্নাগ হারবারে। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে বিদায় জানান সমুদ্রজীবনকে। পরবর্তীতে কয়লা খনির ইঞ্জিনিয়ার হিসাবেই কাজ করেছেন তিনি। সেইসঙ্গে চলেছে ডোনাটের ব্যবসাও। এর প্রায় এক যুগ পরে ১৯১৬ সালে ‘প্যাট্রিয়ট লেজার’ পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় তাঁর। ডোনাট আবিষ্কারকে কেন্দ্র করেই নেওয়া হয়েছিল এই সাক্ষাৎকার।
তারপরেই ধীরে ধীরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাড়তে থাকে বিতর্ক। বহু মানুষই দাবি করেন, ডোনাটের আসল আবিষ্কর্তা নাকি তাঁরা। এমনকি এই বিতর্ক গড়ায় আদালত পর্যন্ত। সেটা ছিল ১৯৪১ সালের নভেম্বর মাস। পার্ল হারবার আক্রমণের সপ্তাহ দুয়েক আগে নিউ ইয়র্কের আদালতে শুনানি হয় ডোনাট-মামলার। এলসা ম্যাক্সওয়েল, ফ্র্যাঙ্কলিন অ্যাডামের মতো খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বরা যেমন হাজির ছিলেন সেখানে, তেমনই হাজির ছিলেন ম্যাসাচুসেট ও মেইনের বহু সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ী। তাঁদের সমর্থনও ছিল গ্রেগরির পক্ষে। অবশ্য ততদিনে প্রয়াত হয়েছেন গ্রেগরি। তাঁর হয়ে সেই মামলা লড়েছিলেন তাঁর ভাইপো ফ্রেড ক্রকেট। দীর্ঘ বিতর্কের পর মামলার রায় যায় গ্রেগরির পক্ষেই। আনুষ্ঠানিকভাবে পেটেন্ট না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে ডোনাটের আবিষ্কারকের তকমা দেয় আদালত।
১৯৪৭ সালে ডোনাট আবিষ্কারের ১০০ বছর পূর্তিতে ২২ জুন তারিখটিকে জাতীয় ডোনাট দিবস হিসাবে ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন। এমনকি ক্যামডেনের স্নাগ হারবারের কাছে তৈরি হয় তাঁর পূর্ণাঙ্গ ব্রোঞ্জের মূর্তিও। সমুদ্রের দিকে মুখ করে যা দাঁড়িয়ে আজও। তাছাড়া তাঁর এই ঐতিহ্য মেনেই সে-শহরে আজও পালিত হয় বাৎসরিক ডোনাট উৎসব। ভিড় জমান দেশ-বিদেশের ডোনাট ব্যবসায়ীরা! অতিজনপ্রিয় ফাস্টফুডের পিছনে যে এত দীর্ঘ ইতিহাস ও বিতর্ক জড়িয়ে আছে, ক’জনই বা তার খোঁজ রাখি আমরা?
Powered by Froala Editor