ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের নিজস্ব নববর্ষ ও বিচিত্র সব রেওয়াজ

/১১

দেখতে দেখতে ফুরিয়ে গেল আরও একটি বছর। আজ পয়লা বৈশাখ। তবে মহামারীর জন্যই অন্যান্য বছরগুলোর তুলনায় এবার তাঁর জাঁকজমক খানিকটা কমই। তবে বছরের প্রথম দিনে হালখাতা, মিষ্টিমুখ কিংবা নতুন জামা-কাপড় ছাড়া চলে নাকি? তাই দূরত্ব বজায় রেখেই চলছে সেই আয়োজন। সেইসঙ্গে যাবতীয় দুঃখ, মৃত্যু, রোগ, মহামারি দূরে সরিয়ে রেখে নতুন এক পৃথিবীর স্বপ্ন বুনছি সবাই। এভাবেই বারবার ধরা দেয় নতুন বছর। এদিকে ভারত হল বৈচিত্র্যের দেশ। কেবল বাংলা নববর্ষই নয়; বিভিন্ন রাজ্যে, বিভিন্ন সংস্কৃতির নিজস্ব নতুন বছর রয়েছে। উৎসবে-আয়োজনে ভরে ওঠে মানুষরা। এই অদ্ভুত বৈচিত্র্যই এই দেশকে এত রঙিন করে তুলেছে। নতুন বছরের প্রথম দিনে, একবার নজর রাখা যাক সেই বিশেষ কিছু নববর্ষের দিকে—

/১১

পয়লা বৈশাখ আমাদের বাংলা সংস্কৃতির চিরকালীন উৎসব। প্রতি বছর এপ্রিলের ১৪ কিংবা ১৫ তারিখে ক্যালেন্ডার বদলে যায় বাঙালির। মন্দিরে, বইপাড়ায়, দোকানে একটাই আহ্বান- ‘এসো হে বৈশাখ’। লক্ষ্মী-গণেশের পুজো, হালখাতার উদ্বোধন, গান-নাচ-আলপনায় শুরু হয় নতুন বছর। সেই সঙ্গে থাকে পঞ্জিকা কেনার হুড়োহুড়ি। পয়লা বৈশাখ যেন আমাদের ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে গেছে। এই একটা দিন কাঁটাতার ভুলে যায় দুই বাংলা। সংস্কৃতির আঙিনায় মিলে যায় গঙ্গা-পদ্মা।

/১১

বৈশাখী পাঞ্জাব ও হরিয়ানার নববর্ষ উৎসব। বাংলার নতুন বছরের আগমনের ঠিক আগের দিন পালিত হয় এই উৎসব। মূলত শিখ সম্প্রদায়রা এই উৎসব পালন করেন। পেছনে ছোট্ট একটি ইতিহাসও আছে। নানকসাহি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বৈশাখী হল দ্বিতীয় মাসের প্রথম দিন। আর এই দিনেই শিখদের দশম গুরু গোবিন্দ সিং ‘খালসা পন্থ’ প্রবর্তন করেন। সবুজে ভরা পাঞ্জাব হরিয়ানা মেতে ওঠে নতুন দিনের প্রার্থনা নিয়ে। উল্লেখ্য, ১৯১৯ সালে এই বৈশাখীর দিনেই জালিয়ানওয়ালাবাগে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে জড়ো হয়েছিলেন শিখরা। আর তারপরই ঘটে যায় সেই নৃশংস ঘটনা…

/১১

বিহু লোকগানে, উৎসবে, সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে বারবার উঠে এসেছে আসামের এই বিশেষ উৎসবের নাম। বিহু’র গান আজও ভীষণভাবে জনপ্রিয়। আসামের প্রধান উৎসব তো বটেই; নববর্ষের উৎসব বললেও অত্যুক্তি হয় না। প্রধানত তিন ধরণের বিহু উৎসবের প্রচলন আছে- বহাগ, কাতি ও মাঘ। উৎসবের সূচনা হয় বহাগ বিহু দিয়ে; আর এটিই আয়োজিত হয় পয়লা বৈশাখের দিন। গানে, নাচে, নতুন ফসলের ঘ্রাণে মেতে ওঠে আসাম।

/১১

বিশু শুধু কেরালা নয়; কর্ণাটকের টুলুনাড় এলাকা, তামিলনাড়ুর কিছু এলাকায় এই বিশেষ উৎসবটি দেখা যায়। মালয়ালম ক্যালেন্ডারের মেদাম মাসের প্রথম দিন আয়োজিত হয় ‘বিশু’। এবং অদ্ভুতভাবে, সেই দিনটিও ১৪ বা ১৫ এপ্রিলে হয়। অর্থাৎ, পয়লা বৈশাখের সঙ্গেই। নতুন জামা পরে, পরিবারের মানুষদের নিয়ে বিষ্ণু (কৃষ্ণ) পুজোর মাধ্যমে দিনটি শুরু হয়। তারপর আতসবাজি, খাবার, গানে কেটে যায় সময়। এই একটি দিন সমস্ত কাজ দূরে সরিয়ে রেখে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোই প্রধান হয়ে ওঠে কেরালায়। (প্রসঙ্গত, কেরালার দক্ষিণ অংশের মানুষদের কাছে সবচেয়ে বড়ো উৎসব হল ওনাম। কেরালার প্রধান রাজ্য উৎসব হলেও, এটি আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে অনুষ্ঠিত হয়।)

/১১

পুত্থান্ডু কেউ বলেন পুত্থান্ডু, কেউ আবার পুথুভারুসাম। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, এই দিনটি তামিলনাড়ুর বাসিন্দাদের কাছে নববর্ষের দিন। তামিল মাস চিথিরাইয়ের শুরুর দিনটি রঙ্গোলী, আলপনা আর পুজোতেই কাটিয়ে দেন সবাই। অদ্ভুতভাবে, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসেবে এটিও ১৪ এপ্রিলেই পড়ছে। পূজা-অর্চনাই নয়; সঙ্গে থাকে রকমারি খাবার। তবে যাই খাওয়া হোক না কেন, এই দিনটি একেবারে মাংস-ডিম বর্জিত।

/১১

য়ুগাডি কর্ণাটক তো বটেই; এটি অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানারও নববর্ষের উৎসব। চৈত্রের প্রথম দিনেই পালিত হয় য়ুগাডি। দরজার বাইরে ‘তোরানা’ অর্থাৎ আমপাতা দিয়ে সাজানো, ‘কোলামুলুস’ অর্থাৎ ঘরে রঙিন আলপনা দেওয়া এবং ‘পাচাডি’ খাওয়া— য়ুগাডির অন্যতম অঙ্গ বলা হয় এগুলো কে। তবে এর বাইরেও আছে অনেক কিছু। পুজো-আচ্চা তো আছেই; সঙ্গে আছে দরিদ্র মানুষদের সাহায্য করা। এই প্রথাটি অবশ্য কর্তব্য। দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে গেছে এই নববর্ষের উৎসব।

/১১

গুড়ি পড়ওয়া দক্ষিণ ভারতের কথা যখন হচ্ছে, তখন মহারাষ্ট্রকে তো আসতেই হবে। এই রাজ্যের নববর্ষও আসে চৈত্রের প্রথম দিনে। নাম ‘গুড়ি পড়ওয়া’। অবশ্য শুধু মহারাষ্ট্র নয়, গোয়ার নতুন বছর হিসেবেও এই উৎসব পালিত হয়। ‘গুড়ি’ মানে পতাকা (কারোর মতে দণ্ড), আর ‘পড়ওয়া’ মানে প্রতিপদ। প্রতিটা মারাঠি বাড়িতে এইদিন বিশেষ একটি পতাকা ওড়ে। সঙ্গে থাকে একটি লাঠি; যার মাথায় রাখা থাকে একটি ঘট। নববর্ষ ছাড়াও এর আরও একটি মাহাত্ম্য আছে। বসন্তকে আহ্বান করতে, মাঠের রবি ফসল ঘরে আনার বার্তা দিতেও এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। এছাড়াও, রঙ্গোলী বা আলপনা তো আছেই!

/১১

নভ্রেহ দক্ষিণ থেকে একেবারে উত্তরে যাওয়া যাক। কাশ্মীর মানেই ভূস্বর্গ। আর সেই স্বর্গেই পয়লা চৈত্রের দিন পালিত হয় নভ্রেহ, অর্থাৎ নববর্ষ। মূলত কাশ্মীরি পণ্ডিতরা এই উৎসব প্রবর্তন করেন। তাঁরা মনে করেন, পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে, এই দিনটিতেই কাশ্মীরি সপ্তর্ষি যুগ আরম্ভ হয়। থালার ওপর ভাত, ফুল, পত্র, নতুন ঘাস, দই, বাদাম, পেন ইত্যাদি জিনিস সাজিয়ে রেখে পূজার্চনা করা হয়। তারপর ওই ‘থালি’ থেকে বাদামটুকু নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। এটাই ‘সমর্পণ’। আর ভাতটুকু স্থানীয় মন্দিরে ভগবানের কাছে উৎসর্গ করা হয়।

১০/১১

বেস্তু বরষ গুজরাট এবং রাজস্থানের বেশ কিছু অংশে এই উৎসবটি নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। এটি দীপাবলির চতুর্থ দিন। তবে ‘বেস্তু বরষ’ স্থানীয় নাম। আসলে শাস্ত্রীয় হিসেবে, এই দিনটি হল ‘বালি প্রতিপদ’। কেউ কেউ একে বালি পদ্যমিও বলেন। বিষ্ণুর দশাবতারের এক অবতার বামনের সঙ্গে সাক্ষাত হয় দৈত্যরাজ বালির। সেই বামনাবতারের কাছেই পরাস্ত হন তিনি। তারপর দীপাবলির চতুর্থ দিনেই উনি আবার পৃথিবীতে ফিরে আসেন। সেই দিনটিকে স্মরণে রাখতেই এই উৎসব। তবে নববর্ষ হওয়ার দরুণ, গুজরাটে একটু বিশেষভাবে আয়োজিত হয় এটি।

১১/১১

পানা সংক্রান্তি বা ওড়িয়া নুয়া বারসা নামেই আন্দাজ পাওয়া গেছে কিছুটা। হ্যাঁ, এটি ওড়িশার নববর্ষ উৎসব। মোটামুটি ১৩ অথবা ১৪ এপ্রিলে আয়োজিত হয় এই নববর্ষ। ওড়িয়া ক্যালেন্ডার হিসেবে, এটিই তাঁদের পয়লা বৈশাখ। তবে সাধারণভাবে মহা বিষুব সংক্রান্তিও বলা হয় একে। বলা হয়, এই দিনটিতেই জন্ম নিয়েছিলেন হনুমান। ওড়িশার স্থানীয় লোকশিল্পী ঘণ্টাপটুয়ারা পরিবেশন করেন ‘ঝামা নট’, ‘দণ্ড নট’-এর মতো নৃত্যশৈলী। সঙ্গে অবশ্যই থাকে বেল পানা। ওড়িশার নববর্ষের দিনে এই একটি জিনিস বাদ গেলে চলবে না। এমনকি, মন্দিরে প্রসাদ হিসেবেও বেলের ব্যবহার হয়।

Powered by Froala Editor

More From Author See More