মেঘকে সঙ্গী করে প্রেয়সীর কাছে বিরহের বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছিল কালিদাসের যক্ষ। দেশে দেশে সমস্ত কালে এভাবেই প্রিয়জনদের ছেড়ে থাকতে হয়েছে রাষ্ট্রের কর্মচারীদের। আর সেই কর্মচারী যদি সৈনিক হন, তাহলে তো ফিরে আসার সম্ভবনাও অত্যন্ত ক্ষীণ। তবে এই বিরহের মধ্যেও প্রিয়জনদের ছুঁয়ে থাকার একটা সুযোগ এনে দিয়েছিল ক্যামেরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়েই অনেক যোদ্ধাকে দেখা যেত তাঁদের টুপিতে অথবা পকেটে প্রেমিকা অথবা স্ত্রীর ছবি রেখে দিতে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেই কাজটাই পৌঁছে গিয়েছিল রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে। যুদ্ধ তো একধরনের শিল্পই। ধ্বংসের শিল্প!
২০০৭ সালে আমেরিকার সেনাবাহিনীতে যোগ দিলেন জিম মরিস। ঠিক দুবছর আগে মারা গিয়েছেন তাঁর মা ভেলমা। জিম যেদিন প্রথম যুদ্ধক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন, সেদিন বাবা জেমস মরিস তাঁর হাতে তুলে দিলেন একটি এম১৯১১ পিস্তল। এই পিস্তল নিয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নেমেছিলেন জেমস। কিন্তু সেই পিস্তল হাতে নিয়েই অবাক হয়ে গেলেন জিম। হাতলের কাছে আঁকা অবিকল তাঁর মায়ের মুখ। ৭০ বছর আগের মুখ।
না, এই ছবি আঁকা ছিল না। এটা ছিল একটি ফটোগ্রাফ। আজকাল যেমন ফটোগ্রাফ অনেকেই প্রিন্ট করে রাখেন মোবাইলের ব্যাক কভারে, অথবা কফি মাগে। কিন্তু এভাবে প্রিন্টিং-এর ব্যবস্থা তো সেদিন ছিল না। তবে প্রেমের আবেগ আর অনুভূতি ছিল একইরকম।
আসলে এই শিল্পের পিছনে আবিষ্কারটি ঘটেছিল ১৯২৮ সালে। উইলিয়াম ক্যালমার্স, ওটো রোম এবং ওয়াল্টার বয়ারের মতো কিছু রসায়নবিদ তৈরি করলেন প্লেক্সিগ্লাস। আসলে কাঁচের মতো স্বচ্ছ হলেও এটি একধরনের প্লাস্টিক। তাই তার স্থায়িত্বও বেশি। ফলে ১৯৩৩ সালে যখন রোম অ্যান্ড হাস কোম্পানি এই প্লেক্সিগ্লাস বাজারে নিয়ে এল, তখন সেটা জনপ্রিয় হতে বেশি সময় লাগেনি।
আরও পড়ুন
হিটলার-বিরোধিতার শাস্তি, গিলোটিনে প্রাণ হারালেন কিশোরী সোফি
এর কিছুদিনের মধ্যেই এসে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধবিমান অথবা মোটরগাড়ি, সবকিছুর জানলাই তৈরি হত এই প্লেক্সিগ্লাস দিয়ে। তবে শুধু যুদ্ধে মেতে ওঠা রাষ্ট্রই নয়, এই জিনিসটি ব্যবহার করতে শুরু করেন সৈনিকরা নিজেদের জন্যও। সেনারা অনেকেই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছেন প্রেমিকা অথবা স্ত্রীর ছবি। এবার ধরা যাক যুদ্ধের মধ্যে হঠাৎ একটি গাড়ির জানালা ভেঙে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার খানিকটা টুকরো তুলে নিলেন সেই সেনা। তারপর নিজের পিস্তল বা রাইফেলের বাঁটের একটা দিক খুলে ফেললেন তিনি। সাধারণত বাঁদিকের। তারপর সেই ফাঁকা জায়গায় প্রেমিকা বা স্ত্রীর ছবিটা বসিয়ে দিলেন বিরহী সৈনিক। আর তার উপর বসিয়ে দিলেন প্লেক্সিগ্লাসের ভাঙা টুকরো। পুরোটা ঠিকভাবে গড়ে নেওয়ার পর মনে হয় যেন সেই আগ্নেয়াস্ত্রের উপর কেউ ছবি এঁকে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধের ৭৬ বছর পরেও নাৎসি শাসন! জার্মানিতে আজও রয়েছে এই গ্রাম
এইসব আগ্নেয়াস্ত্রের একটি ডাকনাম ছিল সেইসময়। সৈনিকরা ডাকতেন 'সুইটহার্ট গ্রিপস'। সবসময় যে প্রেমিকার বা স্ত্রীর ছবি থাকত, তাই নয়। অনেক সময় পারিবারিক ছবিও থাকত। আবার কারোর সঙ্গে থাকত বলতে না পারা প্রেমের স্মৃতি। এইসব নিয়েই গড়ে উঠেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অসংখ্য স্মৃতি। অনেকে বেঁচে আছেন, অনেক প্রাণ হারিয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রেই। কিন্তু সেইসব প্রেম আজও অক্ষয় হয়ে থেকে গিয়েছে আগ্নেয়াস্ত্রের গায়ে।
আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চরমে, ‘শত্রুপক্ষ’ আমেরিকার বুকে মার্চ করলেন হিটলার!
Powered by Froala Editor