বোসপুকুর শীতলামন্দির থেকে রাসবিহারী কানেক্টরের ফুটপাথ ধরে একটু এগোলেই এক বিচিত্র সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। ‘আই অফ হোরাস’। বোসপুকুরে মিশর রহস্য? কৌতুহল সামলাতে না পেরে সটান ভেতরে ঢুকি। ভাবখানা কাকাবাবুর মতো। আর ঢুকেই চমকে যাই। মনে হয়, যেন চলে এসেছি কোনো এক অজানা শহরের কিউরিও শপে। এখানেই হয়তো মিলতে পারে ‘বাগদাদের বাক্স'। পিরামিড, স্ক্যারাব, আনুবিস, লাপিস লাজুলি... মায়াবি ডুমের আলো, সময়কে পিছিয়ে নিয়ে গিয়েছে চার হাজার বছর...
‘বলুন তাহলে…’
চমকে উঠি। দরজা সরিয়ে ঢুকলেন রৌকবাবু। রৌনক দত্ত। এই বিচিত্র বিপণির একমেবাদ্বিতীয়ম কর্ণধার। পেশা ইমপোর্ট-এক্সপোর্টের ব্যবসা। কিন্তু কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ার, রৌনক দত্তকে টেনেছিল মিশর। গিয়েছেন বহুবার। আরবি ভাষাটাও কাজ চালানোর মত রপ্তও করে ফেলেছেন। হাজার হোক এই সারা ভারতবর্ষে তিনিই একমাত্র, যিনি খোদ মিশর থেকে জিনিস ইমপোর্ট করেন। আর তাই দিয়েই ২০১৭ সালে এই বোসপুকুরে গড়ে তুলেছেন ‘আই অফ হোরাস’।
‘এই বাস্ট-এর মূর্তিটা কত দাম?'
আরও পড়ুন
বিড়াল মারা যাওয়ার দুঃখে চোখের ভ্রু কেটে ফেলতেন প্রাচীন মিশরীয়রা!
‘বাস্ত নয় বাস্তেত।’
বিড়াল দেবতার মূর্তি কাম টুথপিক স্ট্যান্ড সলজ্জে তুলে নিলাম আমি। নিজেকে গোমুখ্যু মনে হচ্চিল। এমন এক জায়গায় এসে পড়েছি যা সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না। অথচ আলটপকা প্রশ্ন করার লোভ সামলাতে পারি না।
আরও পড়ুন
মিশরের যুদ্ধক্ষেত্রে বাঙালি শ্যামলাল, পিরামিডের দেশ নিয়ে লিখলেন প্রথম বাংলা বইও
‘আচ্ছা হাইরোগ্লিফ পড়তে পারে এমন কেউ এখন জীবিত আছে? চেনেন?’
এমন বাজে প্রশ্নে যেকোনো সমঝদার রুষ্ট হতে পারেন। রৌনকবাবু নো-ননসেন্স চাঁচাছোলা মানুষ। সটান বললেন ‘না! আর কেউ যদি বলে থাকে সে হাইরোগ্লিফ সঠিক পড়তে পারে তাহলে সে ধাপ্পাবাজ!’
আরও পড়ুন
যন্ত্রণায় বিকৃত মুখ, হাঁ-করা অবস্থাতেই মৃত্যু; মিশরের রহস্যময় এই মমি কার?
‘কেন?’
‘কারণটা খুব সোজা। এই যে গ্লিফ বা ছবিগুলো দেখছেন, এগুলোর বিভিন্ন মানে হয়। একই ছবির অর্থ বদলায় ক্ষেত্র বিশেষে। এবং সেই অর্থ খুঁজে এখন কেউই আর বার করতে পারে না। ’
নিজেকে জ্ঞানী প্রমাণ করার মরিয়া চেষ্টায় এবার তুলে নিলাম একটা ছোট্ট নীল পাথরের পিরামিড।
‘এই পেপারওয়েটটা কত করে?’
‘ওটাকে পেপারওয়েট বলবেন না। ওটা লাপিস লাজুলি।’
‘মানে পাথর লাপিস লাজুলি?’
‘হ্যাঁ। ওটা সেমি প্রেশাস স্টোন। ওজন ৬৬ গ্রাম। আর ওজন মাফিক হিসেব করলে দাম দাঁড়াবে চার হাজার টাকার খানিক বেশি।’
এবার সত্যিই বেকুব বনে যাই। স্কুলপাঠ্য-গুগলপাঠ্য সব তথ্যই এখানে ফেলনা। এনসাইক্লোপিডিয়া রৌনক বাবুর কাছে কৌতূহলের ঝাঁপি খুলে ধরি। জানতে পারি, ‘আনুবিস’ হল ‘মামিফিকেশনের দেবতা।’ মরুভূমির ‘ফেনেক শেয়ালে’র আদলে সৃষ্টি। পচাগলা মাংসের লোভে সমাধিক্ষেত্রে ঢুকে পড়ত শেয়ালের দল। কিন্তু প্রাচীন মিশরিয়রা মনে করতেন যে ওরাই পাহারাদার…
মিশরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কিউরিও আমদানি হয় ‘আই অফ হোরাসে’। যেমন প্যাপিরাস আসে কায়রো থেকে। স্যান্ড পাথর আর লাপিজ লাজুলির মূর্তি আলেক্সান্দ্রিয়ার। চারহাজার বছরের ইতিহাস ঘিরে ছড়িয়ে নানা গল্প কথা। তার কিছু মিথ্যা, কিছু মিথ। এমনকি অনেক ভুলভাল তথ্য পাওয়া যাবে ইন্টারনেটেও। দোকানের এককোণে রাখা মিশর সংক্রান্ত নানা বইয়ের তাক। রৌনকবাবু বললেন, ‘এই বইগুলোই আমার থিংক ট্যাঙ্ক। এগুলো আদতে রিসার্চের বই। ইন্টারনেটের উপর ভরসা রাখা আজকের দিনে চলে না।’
একসময় আড্ডা শেষ হয়। বেরিয়ে আসি। তিলোত্তমায় একটুকরো মিশর আবিষ্কারের আনন্দে তখন নেচে উঠছে মন। এও কি একরকমের মিশর ভ্রমণই নয়?
(কৃতজ্ঞতা স্বীকার: রৌনক দত্ত, আই অফ হোরাস)
Powered by Froala Editor