‘ব্যান্ডের বাইরে গিয়ে অনুষ্ঠান করতে করতে বুঝতে পেরেছি, কলেজপড়ুয়া বা অল্পবয়সীদের কাছে অন্যরকম মিউজিকের যতই ডিমান্ড থাকুক, ব্যান্ড মিউজিককে ঘিরে তাদের মধ্যে একট অন্য আবেগ কাজ করে। সেই আবেগটাকে কোনোভাবেই পুষিয়ে দিতে পারে না অন্য কোনো গান। আর তরুণ প্রজন্মের হতাশা, রাগ, প্রেম, ক্রমশ বিদ্রোহী হয়ে ওঠার প্রবণতাকে রক মিউজিক এবং ওই ডিস্টরশন গিটারের আওয়াজটা ছাড়া আর কিছু কি সেভাবে ধারণ করতে পেরেছে?’
বলছিলেন স্যমন্তক সিনহা। তাঁর কণ্ঠস্বরে হয়তো একটা প্রজন্ম নিজের শ্রুতিকে, সুরের স্মৃতিকে ফিরে পেয়েছে। স্যমন্তক, শুভ্র, দীপায়ন আর কুশল―চারজনের এই লাইন-আপের নাম ‘স্যমন্তক অ্যান্ড মেটস’। সেই ব্যান্ডেরই প্রথম অ্যালবাম প্রকাশ পেল সম্প্রতি। নাম ‘ভলিউম ওয়ান’। চারটে ঋতুকালীন প্রেমের গানের অ্যালবাম। সফ্ট বা পপ রকের আঙ্গিকে।
‘যদিও অনেকে এটাকে বলতে পারেন ইপি বা এক্সটেন্ডেড প্লে।’ বলছিলেন স্যমন্তক। তবুও ‘স্যমন্তক অ্যান্ড মেটস’-এর মতে এটাই তাঁদের প্রথম অ্যালবাম। চারটি নতুন সাউন্ডস্কেপ নিয়েই।
‘স্যমন্তক অ্যান্ড মেটস’ অবশ্য আজকে তৈরি হয়নি। তার পথচলা দু-বছরের। করোনাকালের কোনো এক দুপুরে সাউন্ডস্কেপ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা আর আলগা জ্যামিং-এর মাঝেই জন্ম এই দলের। স্যমন্তক এই অ্যালবামের গীতিকার হতে চাননি। তাঁরা বরং খুঁজছিলেন নতুন লিরিক, নতুন সময়ের ভাষা, শব্দ, গড়ন। সেসব লিরিক তাঁরা কখনো খুঁজে পেয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়, কখনো বা ব্যক্তিগত আলাপচারিতার মাঝে। যে-কারণে এই অ্যালবামের গীতিকারেরা কেউই তথাকথিতভাবে গীতিকার হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত নন। সাহানা বাজপেয়ী অবশ্যই ব্যতিক্রম। কিন্তু তাঁকেই বা ক’জন আমরা গীতিকার হিসেবে চিনি? গায়িকা সাহানাই তো আমাদের কাছে অনেক বেশি পরিচিত। আর বাকি তিনজন? স্বদেশ মিশ্র, সোমেন রায় এবং অর্ঘ্যদীপ ঘোষ। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ এই প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে গান লিখলেন।
কিন্তু চারটে গানই কেন? এবং অ্যালবামই কেন? স্যমন্তক তো নিজেই একাধিক সিঙ্গলস গেয়েছেন। ইউটিউবেও বেশ নিয়মিতভাবেই আপলোড করেন নতুন কভার বা কোনো কম্পোজিশন।
‘আমরা চাইছি, মানুষ আবার অ্যালবামে ফিরুক। কোনো একটা ব্যান্ড বা একজন শিল্পীর পরিচয় লুকিয়ে থাকে অ্যালবামে। তার আইডেনটিটি, শিল্পভাবনা, সঙ্গীতের দর্শন। আমরা অবশ্য আরও গান রাখতে পারতাম। যেমন এই আ্যলবামে চারটের মধ্যে দু’টি গান আমি আগেও গেয়েছি। তবে আসল কথা হল আমাদের হাতে টাকা ছিল না। একটা রেকর্ড লেবেল থেকে অ্যালবাম বের করা মোটা খরচের ধাক্কা। তাছাড়া মানুষের ধৈর্যও কমেছে। ভবিষ্যতে অবশ্যই আরো বেশি গান নিয়ে আমাদের অ্যালবাম বেরোবে।’
বলতে বলতে হাসছিলেন স্যমন্তক। তাঁর গলা দিয়ে চুঁইয়ে নামছিল আত্মবিশ্বাস। প্রথম অ্যালবামে তিনি ও তাঁর বন্ধুরা প্রথা ভেঙেছেন। সেই প্রথা ভাঙতেও তো আত্মবিশ্বাস লাগে। অ্যালবামের প্রথম গান শুরু হয়েছে বর্ষাকে কেন্দ্র করে। তারপর হেমন্ত, বসন্ত ও শীত। প্রথাগত ঋতু-পরম্পরা ভেঙে গেছে। কিন্তু ‘স্যমন্তক অ্যান্ড মেটস’ চেয়েছেন এভাবেই গানগুলো থাকুক। এভাবেই প্রেমের ক্রমবিকাশ ঘন হোক।
‘আমার একটা প্রবণতা হল মেজর স্কেলে সুর করা। যেমন ‘ছাতিম ফুল’ গানটা ডি-মেজর স্কেলে রেখেছি। আবার ‘শ্রাবণের দিন’ রেখেছি জি-মেজর স্কেল থেকে। ‘চাঁদের চুমুক’ও আবার জি-মেজর স্কেল। এবার আমি যদি ‘চাঁদের চুমুক’ আর ‘শ্রাবণের দিন’ ঋতুর ক্রম মেনে সাজাতে যাই, শ্রোতাদের কানে একঘেয়ে শোনাতে পারে। আর শুরুটা একটু জমলে শেষটাও জমে যাবে।’
‘শ্রাবণের দিন’-এর দিন বা অ্যালবামের প্রথম গানটি খানিক আপ-টেম্পো। পপ রকের খুব চেনা বিটে শুরু হয়। সুরে খানিক ধরা পড়ে আশির দশকের গ্ল্যাম ব্যান্ডের ছায়া। ডিস্টরশান বা ইন্টারলিউডও চেনা ছকে বাঁধা। এই গান বৃষ্টিমুখর কলেজ-ক্যাম্পাসে টেবিল বাজিয়ে গলা ছেড়ে গাওয়ার জন্যই হয়তো সৃষ্টি হয়েছে। গানের কথাও মানাসই। ঝকঝকে, মেদহীন। তরুণ কবি অর্ঘ্যদীপ ঘোষের লেখনী যে গানেরই জন্ম দেবে, তা আর আশ্চর্য কী?’
হেমন্তের রঙমাখা ‘ছাতিমফুল’ গানটির স্রষ্টা প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী সাহানা বাজপেয়ী। স্যমন্তকের অন্তরঙ্গ বন্ধুও তিনি। এর আগেও একাধিক গান লিখেছেন, কিন্তু অনেকেই হয়তো সেগুলি সাহানার লেখা গান হিসাবে জানেন না। সাহানা বলছিলেন, এই ‘ছাতিমফুল’ গানটির আড়ালে তাঁর মাথায় একটি হেমন্তবিকেলের স্মৃতি জমাট বেঁধে আছে।
―‘হেমন্তের বিকেলের পূর্ণদাস রোড দিয়ে হাঁটছি, আমি আর আমার এক বন্ধু। সামনেই দাঁড়িয়ে ছাতিম গাছ। সে গাছ খামখেয়ালি। কখনো ফুল দেয়, কখনো সে অভিমান করে…’ হয়তো সেই অনুভূতিই শব্দ হয়ে ঝরে পড়েছিল সাহানার কলম থেকে।
আ্যলবামের তৃতীয় গান চাঁদের চুমুক, গীতিকার স্বদেশ মিশ্র-র শব্দচয়নে এবং স্যমন্তকের সাউন্ডস্কেপ বয়ে আনে বিষণ্নতা। গানের সুর খানিক সাইকেডেলিক। বিমূর্ত কিছু অনুভূতির বাহক। বসন্তের এক ভোরকে ঘিরেই চাঁদের চুমুক। নিভুনিভু তারাভরা আকাশে কল্পনায় ভর করে পাড়ি দেন শ্রোতা। সোমেন রায়ের লেখা ‘ভুলে থাকা’-র সাউন্ডস্কেপ শীতের হিমেল আবহকে তুলে ধরে অনায়াসে। ঢিমে লয়েই এগোয় গান। সুরে সুরে ভেসে ওঠে রক ব্যালাডের ছায়া। বিরহকে এমন সোজা-সহজ ভাষায় হয়তো এর থেকে ভালোভাবে কেউ ধরতে পারেননি।
রক-ব্যালাড বরাবরই টানত স্যমন্তককে। সফ্ট বা পপ রকের মেলোডি। যদিও নিজে নানা ধরনের সাউন্ডস্কেপ নিয়ে কাটাছেঁড়া করেছেন। কিন্তু শেষটায় থিতু হলেন রকেই। বাংলা গানের রক-অ্যান্ড রোল যুগ ফুরিয়েছে কবেই। নতুন ব্যান্ডও বড় একটা জন্ম নেয়নি গত কয়েকবছরে। সিডি ক্যাসেটের ক্রেতারা এখন ইউটিউবে ভিউ বাড়ান। মাঝে মাঝে স্পটিফাইয়ের প্লেলিস্টে ভেসে আসে ফসিলস, জেমস, ক্যাকটাস, লক্ষ্মীছাড়া, মাইলস, ওয়ারফেজ, শিরোনামহীন বা শূন্যের কোনো চেনা ট্র্যাক। মুহূর্তের নস্টালজিয়াকে ঝেড়ে ফেলে বাঙালি শ্রোতা ফিরে যায় চটুল প্লেব্যাকের সুরেই।
‘আজকাল গানবাজনার খবর হাতে গোনা কয়েকটি সংবাদমাধ্যম ছাড়া কেউই তেমন দেয় না। ফলে মানুষের মধ্যে আগ্রহও কমছে। সিঙ্গলস হিসাবে বা স্বাধীনভাবে রিলিজ করলে, আমাদের গান ইউটিউবের চেনা গণ্ডিতেই থেকে যেত। তাই ভেবেছিলাম, অ্যালবাম হিসাবে একটা রেকর্ড লেবেল থেকে এই গানগুলো রিলিজ করলে রেডিওতে কিছু গান বাজলেও বাজতে পারে। সামান্য লেখালেখিও হতে পারে। আবার চর্চায় ফিরতে পারে আধুনিক বাংলা গান। ব্যান্ড-মিউজিক। আমাদের দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে যদি আরও দশজন শিল্পী এভাবে অ্যালবাম রিলিজ করেন, তাহলে হয়তো গানদুনিয়ার উপকারই হবে। সেই ফেলে আসা ব্যান্ড মিউজিকের যুগ ধীরে ধীরে ফিরতে পারে। প্লেব্যাকের সঙ্গীতের বাইরে যে গান, যে গানগুলো আমরা শুনতাম, সেই আধুনিক গানকে তো বাঁচিয়ে রাখা দরকার…’
মৌলিক বাংলা গানকে ফিরিয়ে আনার লড়াইয়ে জুড়ে গেলেন স্যমন্তক আর তার বন্ধুরাও। একইসঙ্গে চেষ্টা করছেন কলেজ কনসার্টের সেই মাথা-ঝাঁকানো উন্মাদনাকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে। তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে প্রেমের আঁচ, নরম মেলোডি। এই সবকিছুকে জুড়ে বেঁধে, জড়িয়ে-জাপ্টে উড়ান দিতে চাইছে ‘স্যমন্তক অ্যান্ড মেটস’। তাঁদের স্বপ্ন সফল হবে কিনা, সময়ই বলবে।
Powered by Froala Editor