বদলে গেল কাহিনি, তাই কি নাটক লেখা ছাড়লেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়?

বাঙালির কাছে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় (Sharadindu Bandyopadhyay) মূলত তিনটি জিনিসের জন্য বিখ্যাত। ব্যোমকেশ (Byomkesh), ঐতিহাসিক উপন্যাস আর ভূতের কাহিনি। এই তিনটে দিয়েই তিনি আজীবন রাজত্ব করতে পারেন বাংলা সাহিত্যে। ব্যোমকেশ বক্সীর সত্যান্বেষণ নিয়ে আজও মাতোয়ারা বাঙালি পাঠক। ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ বা ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’-এর ঐতিহাসিক উপন্যাস নিমেষের মধ্যে নিয়ে যেতে পারে রোম্যান্সের রাজত্ব। আর যারা গল্প পড়তে পড়তে বরদার সঙ্গে প্রেতযোনির চর্চা করেছেন, তাদের মনেও যে ভয় ঢোকেনি, এ-কথা বুকে হাত রেখে বলতে পারবে না কেউই। আর এর মাঝে চাপা পড়ে গেছে তাঁর আরো দুটি পরিচয়—চিত্রনাট্যকার ও নাট্যকার। অথচ, জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন এই দুটি শিল্পের সঙ্গে। 

পিতা তারাভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন উকিল, শরদিন্দুর জীবনও শুরু হয়েছিল আইন-চর্চাতেই। ১৯২৯-তে সব ছেড়ে দিয়ে মন দিলেন সাহিত্যসৃষ্টির কাজে। নামও হতে থাকলে ক্রমশ। রঙমহলের মতো প্রসিদ্ধ মঞ্চে অভিনীত হল তাঁর লেখা নাটক ‘বন্ধু’। সোনেলা কোম্পানি রেকর্ড করল ‘ডিটেকটিভ’, ‘উমার বিবাহ’-এর মতো পালা। নিজেকে বহুমাত্রায় পরীক্ষা করবেন বলে ১৯৩৮-এ পাড়ি দিলেন মুম্বই। হিমাংশু রায় তখন ‘বোম্বে টকিজ’-এর কর্ণধার। তাঁর আহ্বানেই শুরু হল ‘সিনারিও’ বা চিত্রনাট্য লেখার কাজ। অর্জন করলেন খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা। কিন্তু রূপোলি পর্দার মায়া যে তাঁকে সাহিত্যচর্চা থেকে বহু দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সেই কষ্টও ছিল অন্তরে। আবারও সমস্ত জাল কেটে বেরিয়ে এলেন। ১৯৫২ সালে মুম্বইয়ের ফিল্ম জগতের সম্পর্ক ত্যাগ করে চলে এলেন পুনে। 

এই সিদ্ধান্ত যে তাঁকে মানসিক শান্তি দিয়েছিল, সেটা বনফুলকে লেখা একটি চিঠি দেখলেই বোঝা যায়। তিনি লিখছেন, “সিনেমার সম্পর্ক ঘুচে গেছে; তার ফলে বাংলা লেখার অবকাশ পেয়েছি। এইভাবে শেষ দিনগুলো যদি কেটে যায় তাহলে নালিশ করবার আর কিছু থাকবে না।” জীবনের শেষ দিনগুলো কেটেছিল পুনেতেই। সেখানের জলহাওয়ায় নতুন শক্তি নিয়ে পনেরো বছর পরে লিখলেন ব্যোমকেশের নতুন কাহিনি। গল্পের নাম—‘অর্থমনর্থম’। নালিশ করার সুযোগ দেননি, বরং সমস্ত শক্তি ঢেলে দিয়েছিলেন বাংলা ভাষার সেবায়। জীবনের এই নাটকীয় বাঁকবদলগুলি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল তাঁর সাহিত্যেও।

ব্যোমকেশের কথা যখন উঠলই, তাহলে জিজ্ঞেস করে নেওয়া যাক, বাকি গোয়েন্দাদের থেকে সে আলাদা কোথায়? উত্তর একটাই, সে বিবাহিত। তা তিনি খামকা ব্যোমকেশের বিয়ে দিতে গেলেন কেন? উত্তরের জন্য হয়তো তাকাতে হবে, তাঁর একটা নাটকের দিকে। ১৯৩৫-এ লেখা ‘ডিটেকটিভ’ নাটকে তিনি রীতিমতো হাসি-ঠাট্টা করেছেন গোয়েন্দাদের নিয়ে। জমিদার অনন্ত চৌধুরী অগাধ পয়সার মালিক, শখ জাগল ডিটেকটিভ হওয়ার। শার্লক হোমস-কে গুরু বানিয়ে ঠিক করে, আজীবন অবিবাহিত থাকবে। শেষে মহামায়ার পায়ের জুড়ুল খুঁজতে গিয়ে সমস্ত পরিকল্পনা পণ্ড হয়ে গেল তার। এই নাটকের মাত্র তিন বছর আগে থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে ব্যোমকেশ। গোয়েন্দা মাত্রেই যে সামাজিক জগৎ থেকে আলাদা হতে হবে, এই ধারণায় বিশ্বাস করতেন না তিনি। ব্যোমকেশ তাঁর কাছে একই সঙ্গে বন্ধু ও সন্তান। তাঁকে নিয়ে এতটাই খুঁতখুঁতে ছিলেন যে, সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘চিড়িয়াখানা’ সিনেমায় চশমা পরা ব্যোমকেশকে দেখে রীতিমতো রেগে গেছিলেন।

আরও পড়ুন
জীবিকার প্রয়োজনে মুম্বাই পাড়ি শরদিন্দুর, ১৩ বছর পর উপার্জনের দায় থেকে মুক্তি

‘ডিটেকটিভ’ নাটকটি প্রথম অভিনীত হয় রঙমহলে, পরিচালক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। ‘শনিবারের চিঠি’-র সম্পাদক সজনীকান্ত দাস ঠিক করেন অভিনয় হওয়ার আগেই নাটকটি বই আকারে প্রকাশ করবেন। কাজ হল সেইমতো। কিন্তু বই হিসেবে যখন হাতে এল, তখন শরদিন্দু দেখলেন, “উহার মধ্যে এমন অনেক বস্তু প্রবেশ করিয়াছে যাহার দায়িত্ব গ্রহণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব।” অভিনয় হওয়ার সময় আরো বদলে গেল নাটকটা। একেবারে প্লেটোর মতো সত্য থেকে তিন ধাপ দূরে দাঁড়িয়ে গেল শরদিন্দুর ‘ডিটেকটিভ’। সম্ভবত সেই কারণেই পরবর্তীতে আর নাটক লেখার কাজে খুব একটা উৎসাহিত হননি। মুম্বইতে থাকাকালীন ‘লাল পাঞ্জা’-র মতো থ্রিলারধর্মী নাটক লিখলেও, সেটা সম্ভবত ফরমায়েশি লেখা। ফিল্মজগতের কাজে প্রবেশের পর সময় পাননি পর্যাপ্ত, কলকাতার নাট্যমঞ্চ থেকেও ছিলেন দূরে। অবশ্য, ‘বিশুপাল বধ’-এ এসেছিল বাংলা পেশাদার থিয়েটারের প্রেক্ষাপট। ঘটনাচক্রে সেই গল্প শেষ করে যেতে পারেননি। নারায়ণ সান্যালের হাতে সমাপ্ত হয় সেটি। 

আরও পড়ুন
সিনেমায় চশমা-পরা ব্যোমকেশ, সত্যজিতের ‘চিড়িয়াখানা’ দেখে অখুশি শরদিন্দু

ব্যোমকেশের গল্পগুলিও কিন্তু নাটকীয়তায় ভরা। ‘সত্যান্বেষী’-র গল্পে নাটক তো থাকবেই। শুধু কাহিনি নয়, যে ভাষায় তিনি ‘সিচুয়েশন’ তৈরি করেন, তার জুড়ি মেলা ভার। ‘অর্থমনর্থম’-এর শেষে সত্যবতীর সঙ্গে ব্যোমকেশের প্রেমের সূত্রপাতে সংলাপের চালাকিটা বোকা বানিয়েছিল অজিতকেও। কিংবা মনে পড়তে পারে, ‘শজারুর কাঁটা’ গল্পের শেষের ‘টুইস্ট’-টার কথা। এমন নয় যে, ব্যোমকেশের আবির্ভাবের আগে বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে নাটকীয়তার কমতি ছিল। পরে ফেলুদার কাহিনিতেও সিনেমাসুলভ ‘সাসপেন্স’-এর প্রচুর উপাদান আছে। কিন্তু শরদিন্দু নিজের রাস্তা তৈরি করে নেন গল্প বলার ভঙ্গি আর ঘটনাক্রম তৈরিতে। ব্যোমকেশকে দিয়ে এত কাণ্ড করানোর পরেও যে তাঁকে পাশের বাড়ির একজন গৃহস্থ বাড়ির ছেলে মনে হয়, সেটা কিন্তু শরদিন্দুর কৃতিত্ব। তারপরেও ব্যোমকেশ নিয়ে চলচ্চিত্রের পরীক্ষায় পাস মার্ক কম ওঠে কেন, সেটাই আশ্চর্যের। 

তথ্যঋণ :
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় : জীবনকথা— মানস মজুমদার
সার্থকতার শিখরে শরদিন্দু— সন্তোষকুমার দে

Powered by Froala Editor