বাংলার বইপ্রেমী মানুষের কাছে শীতকাল মানেই আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তকমেলা (Kolkata Book Fair)। আপামর বাঙালি সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের বইমেলার জন্য। যদিও এবারের বইমেলায় থাকছে বড়ো চমক! ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড’-এর (Publishers And Booksellers Guild) সাম্প্রতিক ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৪ সালের কলকাতা বইমেলা অনুষ্ঠিত হতে চলেছে ১৮ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত।
অবশ্য গত কয়েক বছরে কোভিড ও অন্যান্য বিভিন্ন কারণে কলকাতা বইমেলার দিনক্ষণ বহুবার বদলেছে। সাধারণত কলকাতা বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারি মাসের শেষ বুধবার থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। কিন্তু ২০২৪ সালের ৪৭ তম কলকাতা বইমেলা জানুয়ারি মাসের মধ্যেই সমাপ্ত হতে চলেছে। স্বভাবতই এই ঘোষণার ফলে সাহিত্যিকমহল ও প্রকাশকগোষ্ঠী কিঞ্চিৎ অবাক হয়েছেন। বিস্মিত পাঠকমহলও। সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয়েছে গুঞ্জন।
এই প্রসঙ্গে ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড’-এর সভাপতি শ্রী ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় জানান যে আগামী বছরের বইমেলায় ২৩ ও ২৬ জানুয়ারির মতো ছুটির দিনগুলি ছাড়াও একাধিক শনিবার ও রবিবার রয়েছে। যা প্রকাশক ও পাঠকমহল উভয়পক্ষের ক্ষেত্রেই সুবিধাজনক হবে। এছাড়াও ২০২৪-এ দেশে লোকসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণার পূর্বেই গিল্ড কর্তৃপক্ষ বইমেলা সমাপ্ত করার বিষয়ে ভেবেছেন। পাশাপাশি ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকেই মাধ্যমিক পরীক্ষা এবং অন্যান্য বোর্ডের পরীক্ষা শুরু হওয়ার বিষয়টিও তাঁরা খতিয়ে দেখেছেন। এ বিষয়ে পুজোর পরে বিস্তারিতভাবে জানানো হবে বলে তিনি প্রহরকে জানিয়েছেন।
দে’জ পাবলিশিং হাউসের অন্যতম কর্ণধার শুভঙ্কর দে-ও (অপু) গিল্ডের সিদ্ধান্তে খুশি। তাঁর মতে এতো আগে ঘোষণার ফলে প্রকাশকমহল প্রস্তুতি নেওয়ার যথেষ্ট সময় পাবেন। কিন্তু মাসের শেষে বইমেলা আয়োজনের ফলে কি পাঠকদের পুঁজিতে কি টান পড়বে না? সে বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, “যাঁরা বইমেলায় আসবেন বা বই কেনার জন্য যাঁরা আগ্রহী, তাঁরা সেই জায়গাটা আগে থেকে বুঝেই রাখেন।”
আরও পড়ুন
বইমেলায় ‘মহীন’-এর আদি ঘোড়া বাপি দাসের জীবনী, চিকিৎসায় ব্যবহৃত হবে গ্রন্থের লভ্যাংশ
‘তবুও প্রয়াস’ প্রকাশনীর কর্ণধার সেলিম মণ্ডল ও ‘সৃষ্টিসুখ’ প্রকাশনীর কর্ণধার রোহণ কুদ্দুসও প্রস্তুতির নেওয়ার বিষয়ে সহমত প্রকাশ করেছেন। উভয়েরই বক্তব্য যে প্রকাশনার কাজের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, এই সিদ্ধান্তে তাঁদের কাজে খুব হেরফের হবে না। “যদি পাবলিশার্সরা মনে করে তাঁরা কাজ এগিয়ে রাখবেন, তাহলে দশ-পনেরো দিনের জন্য কিছু পার্থক্য হয় না।” তবে রোহণ কুদ্দুসের মতে, “বাইরে যাঁরা থাকেন; আমি শুধু পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বলছি না, ভারতের বাইরেও অনেক প্রকাশক, লেখক, পাঠক থাকেন। তাঁদের অনেকেই এই সময়টার জন্যে সারা বছরের ছুটি জমা করে আসেন। তাঁদের মধ্যে আগে থেকে যদি কেউ টিকিট কেটে রেখে থাকেন, তাঁদের অসুবিধা হবে।”
আরও পড়ুন
প্রথম বইমেলা, প্রথম বই
এ বছর জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে নন্দনচত্বরে ‘লিটল ম্যাগাজিন মেলা’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেক্ষেত্রে যে প্রকাশকরা লিটল ম্যাগাজিন মেলা ও বইমেলা দু-স্থানেই বইয়ের সম্ভার সাজিয়ে বসেন, তাঁরা কি সমস্যায় পড়বেন? এ বিষয়ে ‘বোধশব্দ প্রকাশনী’-র সুস্নাত চৌধুরী খুব একটা চিন্তিত হচ্ছেন না। তিনি জানিয়েছেন, “মেলার আগের দু-তিন সপ্তাহ প্রচুর চাপ যায় এবং সেই সময়ে ভয়ঙ্কর কাজ হয়। ওই সময়টা একটু কমে যাচ্ছে। অসুবিধা হয়তো সেই নিরিখে কিছু একটা হবে, কিন্তু মনে হয় অ্যাডজাস্ট করে নেওয়া সম্ভব।”
তবে বইমেলা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন সাহিত্যিক কিন্নর রায়। তাঁর মতে বিশ্বের খ্যাতনামা বইমেলাগুলির মতো কলকাতা বইমেলারও একটি নির্দিষ্ট সময় অনুসরণ করা উচিত। আমাদের ধর্মে বা জীবনের উৎসবের দিনগুলি যেমন পূর্বনির্ধারিত থাকে, বইমেলার মতো উৎসবেও সেই পদ্ধতি কঠোরভাবে মানা উচিত। এক্ষেত্রে প্রকাশকদের পাশাপাশি সমস্যায় পড়বেন সাহিত্যিকরাও। তিনি জানিয়েছেন, “এই ক্যালেন্ডারের ফলে বাংলা ভাষার যাঁরা অক্ষরকর্মী, তাঁদের বই তৈরির সময়ও কমে যাবে।” কলকাতার যাঁরা কম পুঁজির প্রকাশকমহল আছেন, তাঁরা এই সিদ্ধান্তে অসুবিধায় পড়বেন। তাছাড়া আজকের মূল্যবৃদ্ধির যুগে মানুষ মাসের শেষে বই কিনতে আগ্রহী হবে কিনা সে বিষয়ে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেন।
ফলে মতের পার্থক্য থেকেই যাচ্ছে। আপাতত মাধ্যমিক, নির্বাচন, প্রকাশক ও পাঠকদের প্রস্তুতি ইত্যাদি প্রশ্ন সামলে নতুন সময়ে বইমেলা কীভাবে পথ চলে সেটাই এখন দেখার।
Powered by Froala Editor