১৯৪৫ সাল। গোটা বিশ্ব প্রথমবারের জন্য সাক্ষী হয়েছিল এক ভয়াবহ যুদ্ধাস্ত্রের। পারমাণবিক বোমা। পরমাণুর মধ্যেও যে একাধিক সূক্ষ্মতর কণার অস্তিত্ব রয়েছে, তা প্রকাশ্যে এসেছে ইতিমধ্যেই। শুরু হয়েছে এই ধরনের আরও অজানা মৌলিক কণার অনুসন্ধান। লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে, সেসময় মৌলিক কণা অনুসন্ধানের জন্য একটি বিশেষ কণাত্বরকের নকশা তৈরি করেছিলেন কিংবদন্তি পদার্থবিদ জেমস চ্যাডউইক (James Chadwick)। হ্যাঁ, নিউট্রন আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে যাঁর নাম, তাঁর কথাই হচ্ছে। ‘সিঙ্ক্রোসাইক্লোট্রন’ (Synchrocyclotron) নামে পরিচিত চ্যাডউইকের প্রস্তাবিত সেই কণাত্বরক। কিন্তু কোথায় হারিয়ে গেল ঐতিহাসিক যন্ত্রটি?
শুরু থেকেই বলা যাক জেমস চ্যাডউইকের এই যন্ত্রের গল্প। একটা সময় ব্রিটেন তথা গোটা ইউরোপের মধ্যে অন্যতম প্রধান কণাত্বরক ছিল চ্যাডউকের তৈরি এই যন্ত্রটি। তবে এটিই ব্রিটেনের প্রথম কণাত্বরক নয়। সেইসময় লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিল ৩৭ ইঞ্চি ব্যাসের একটি সাইক্লোট্রন যন্ত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটন প্রোজেক্ট থেকে ফেরার পর, চ্যাডউইক কাজ শুরু করেছিলেন এই যন্ত্রেই। তবে কিছুদিনের মধ্যেই দেখা দিয়েছিল বেশ কিছু যান্ত্রিক ত্রুটি। সংশ্লিষ্ট সাইক্লোট্রনটিকে সারানোর পরিবর্তেই নতুন কণাত্বরকের নকশা বানিয়েছিলেন চ্যাডউইক।
সেটা ১৯৪৫ সালের একদম শেষের দিক। গোটা ইউরোপ তখনও বিধ্বস্ত হয়ে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতায়। ধ্বসে পড়েছে অর্থনীতিও। এই অবস্থায় বিজ্ঞানের খাতে নতুন করে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করার কোনো ইচ্ছেই ছিল না যুক্তরাজ্যের। তবে শেষ পর্যন্ত চ্যাডউইকের এই পরিকল্পনা স্বীকৃতি দেয় ব্রিটিশ সরকার। তার একমাত্র কারণ ক্ষমতালিপ্সা। আশা ছিল জেমস চ্যাডউইকের এই যন্ত্রই হয়তো পরমাণু বোমার চেয়েও আরও সাংঘাতিক কোনো অস্ত্রের সন্ধান এনে দেবে ভবিষ্যতে।
লিভারপুলের মাউন্ট প্লিসান্টের ওপর এই যন্ত্রের জন্য গড়ে তোলা হয়েছিল প্রকাণ্ড এক বাড়ি। সবমিলিয়ে খরচ হয়েছিল প্রায় সাড়ে ৮ লক্ষ পাউন্ড। শুধু সিঙ্ক্রোসাইক্লোট্রন যন্ত্রটি নির্মাণেই চ্যাডউইকের লেগেছিল ৫ লক্ষ পাউন্ড। ১৫৬ ইঞ্চি ব্যাসের যন্ত্রটি অনায়াসেই ৪০০ মেগা ইলেকট্রনভোল্ট শক্তি সরবরাহ করতে পারত একটি প্রোটনকে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, প্রকাণ্ড এই যন্ত্রটি তৈরি করা হয়েছিল কেবলমাত্র একটি তড়িৎচুম্বকের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে। যেখানে অন্যান্য সমস্ত কণাত্বরকেই ব্যবহৃত হত চুম্বকের সমন্বয়।
তবে দুঃখের বিষয় হল, এই যন্ত্র চ্যাডউইকের মস্তিষ্কপ্রসূত হলেও জীবদ্দশায় এই যন্ত্রে কাজ করে যেতে পারেননি তিনি। নির্মাণ চলাকালীনই স্বেচ্ছায় তিনি বদলি হয়েছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বর মাসে চ্যাডউইকের সহকর্মী মাইক মুর, জন গ্রেগরি এবং অ্যালবার্ট ক্রু প্রথম পরীক্ষা চালান এই যন্ত্রে। পরবর্তী ১৪ বছরে পদার্থবিদ্যার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ‘অত্যাধুনিক’ কণাত্বরক। সিপিটি তত্ত্বের ব্যতিক্রম থেকে শুরু করে অ্যান্টিপার্টিকল সিমেট্রি, মিউয়ন ক্ষয়, আন্টিনিউট্রিনোর ধারণা-সহ পদার্থবিদ্যার একাধিক মাইলফলকের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই বিশেষ যন্ত্রটির নাম।
কিন্তু কোথায় এই যন্ত্র? লিভারপুলের মাউন্ট প্লিসান্টের ওপর বৈজ্ঞানিক ল্যাবরেটরিটিরই বা অস্তিত্ব কোথায় বর্তমানে? না, তা আর দেখার সুযোগ নেই। আজ সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রয়েছে লিভারপুলের অন্যতম স্থাপত্য মেট্রোপলিটন ক্যাথোলিক ক্যাথিড্রাল। ১৯৬৮ সালে সংশ্লিষ্ট ভবনটিকে ভেঙে ফেলে এই স্থাপত্য গড়ে তোলা হয়েছিল। আর চ্যাডউইকের যন্ত্র?
১৯৫৭ সালে চ্যাডউইকের এই নকশার অনুকরণেই জেনেভার সার্নে তৈরি হয়েছিল আরও একটি কণাত্বরক। যা প্রায় ৬০০ মেগা ইলেকট্রনভোল্ট শক্তি সরবরাহ করতে পারত মৌলিক কণায়। এই যন্ত্রটির ব্যবহার শুরু হওয়ার পর অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে চ্যাডউইকের প্রযুক্তি। পাশাপাশি চ্যাডউইকের তৈরি এই যন্ত্রে, একটিই চুম্বক ব্যবহারের জন্য তা চালাতে প্রয়োজন হত বিপুল পরিমাণ শক্তির। মাসে শুধু বিদ্যুতের জন্যই খরচ হত প্রায় ৫ হাজার পাউন্ড। সেই কারণেই ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা কমতে থাকে যন্ত্রটির।
১৯৬৮ সালে একপ্রকার আবর্জনার মতোই ‘ফেলে’ দেওয়া হয়েছিল যন্ত্রটিকে। তেজস্ক্রিয় অংশগুলি অধিগ্রহণ করে তা নষ্ট করে দেয় ব্রিটিশ সরকার। ধাতব অংশগুলি অধিকাংশই বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল কিলো দরে। শুধুমাত্র রেহাই পেয়েছিল ঐতিহাসিক এই যন্ত্রটির রোটেটিং কনডেন্সার এবং ফ্রেম। পরবর্তীতে যা লিভারপুলের ওয়ার্ল্ড মিউজিয়ামে সংরক্ষিত হয়। ২০১৪ সালে পুনরায় তা স্থানান্তরিত করা হয়েছিল লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিক্টোরিয়া গ্যালারিতে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাধারণের জন্য প্রদর্শিত হত ঐতিহাসিক যন্ত্রটির কিয়দাংশ। তারপর সরিয়ে নেওয়া হয় সেটিকেও। মেট্রোপলিটন ক্যাথিড্রাল লিভারপুলের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু তার তলাতেই যে লুকিয়ে রয়েছে পদার্থবিদ্যার এক আকর্ষণীয় অধ্যায়, ক’জনই বা জানেন সেই কথা?
Powered by Froala Editor