বইমেলা থেকে ফিরে || পর্ব— ১১
একটি গাছ থেকে দমকা হাওয়ায় উড়ে এলো শুকনো পাতা। কোত্থাও কেউ নেই। স্থির এই ক্যানভাসে কেবল সাজানো বাগান আর দর্শক ছাড়া এটুকুই অস্থিরতা। এটুকুই প্রাণের প্রমাণ। বইমেলা, যদি ধরে নেওয়া যায় স্থির সেই দৃশ্য তবে হকাররা নিশ্চিত তাতে শুকনো পাতার চরিত্রে অভিনয়ে এসেছে। এই আড়ষ্ট দৃশ্যপটে প্রাণসঞ্চার করতে। একগুচ্ছ ভিড়ে যখন লোক বই দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছেন ভিতরের দিকে, লেবু চা হাঁকতে হাঁকতে বাঁকা হাতে কাপ আর কেটলি সামলে স্রোতের প্রতিকুলে ঢুকে আসছে ছেলেটি। ভিড়ের বুক চিরে, দেরিতে পাওয়া ভালো লেখা যেভাবে জায়গা করে নেয় সাজানো পত্রিকায়। যতদূর মনে পড়ে ২০১৭ সালে করুণাময়ীতে সরে আসে মেলা। সেই থেকে গোটা মেলা প্রতিদিন একমনে চা খাইয়ে যাচ্ছে ছেলেটি। ওর বাঁ-হাতটি স্বাভাবিক নয়, একঝলকে মনে হয় অযত্নে ভাঁজ করা বইয়ের ফ্ল্যাপের মতো দুমড়ে গিয়েছে কোনোভাবে। যে দাগ আর সোজা হবে না কখনও। বাঁকা বাঁহাতের এই অদ্ভুত ভাঁজ দুর্দান্তভাবে কাজে লাগায় ছেলেটি। মনে হয় যেন খালি কাপ বওয়ার জন্যই এমন এক আকার পেয়েছে হাতটি। আমরা আমাদের খামতিগুলোও যদি এভাবে পূরণ করতে পারতাম...
হকারি, সাধারণ অর্থে ঘুরে বিক্রির এই অভ্যাসকেই আমরা বলে থাকি। কাজের ধরণ ভেদ বা সমস্ত উন্নাসিকতাকে দূরে রেখে ভাবলে মেলার হকার গোষ্ঠিতে নিজেদের এনে বসাতে পারি আমরাও। ২০১১-১২ সাল। টেবিল পাই না তখনও। একটি ছোট্ট পকেট সাইজ পত্রিকা, নাম উপস্থিতি। জনা কয়েক বন্ধু মিলে তেরো দিনে প্রায় এগারোশো কপি বিক্রি করতাম এই পত্রিকা। সাতটাকা দাম, তাই বছরের অন্য কোনো সময় আর কোথাও পাওয়া যেত না এটি। বয়স কম, অঢেল আত্মবিশ্বাস তাই কোনো লাগাম ছিল না আমাদের, ছিল না কোনো টার্গেট। শুধু জানতাম যত দ্রুত শেষ হবে সংখ্যা, তত বেশিদিন মেলা ঘুরতে পারব নিজেদের মতো, বই কিনব। এই বৃহৎ আয়োজনে বরাবর খুব ঘরোয়া আভাস পেয়েছি। আর তাই রাস্তায় ঘাটে বসে পড়া অথবা লোকের থেকে চেয়ে লিফলেট বিলি করে দেওয়া -- কোনোকিছুতেই দ্বিধা হয়নি কখনও। নিজেদের বই শেষ হলে, অন্যান্যদেরও সাহায্য করেছি বহুবার, বিক্রি করে দিয়েছি তাঁদের বই। তখনও কেউ মেলায় ঘুরে বই বেচলে কেউ কলার ধরত না। ছুঁড়ে ফেলে দিত না মেলার বাইরে। স্টল থেকে আপত্তি জানাত না প্রকাশকেরা, বরং উৎসাহই পেতাম। পাঠকের কাছেও। যাঁদের উপর এই অত্যাচার চালিয়েছি তাঁরা অনেকেই এখন বেশ ঘনিষ্ঠ আমাদের। মজা পান সেসব পুরোনো কথা মনে করালে... নিজেদের এই হকারি এখন মিস করি খুব। প্রতি পঞ্চাশ কপি বিক্রির পর একসঙ্গে বসে দশ মিনিটের আড্ডা, জল খাওয়া, টিফিন খাওয়া... অঞ্জনা, শুভজিৎ, সুদীপ্ত, দেবজ্যোতি, আমি কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছি মিলনমেলার মাঠ। ভাগে ভাগে নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছি, পকেটে দু-টাকা একটাকার খুচরো নিয়ে। মধ্যে মধ্যে গিয়ে কখনও কুইজ খেলে জিতে আনছি কেক, উইঙ্কিজের সেই কেক দিয়ে টিফিন সারছি একসঙ্গে। রাতে দুনম্বর গেটের দিকে হাঁটছি যখন, ভাঙা মেলায় লোকের হাতে কেবল আমাদেরই পত্রিকা। এ আনন্দ লিখে বোঝাবার নয়...
উত্তরপাড়া গণউদ্যোগের আয়োজনে হিন্দমোটর দেশবন্ধু পার্কে এক লিটল ম্যাগাজিন মেলায় টেবিলে বসে আছি, মঞ্চে তখন পাঠ চলছে স্থানীয় কবিদের কিছু দুর্বোধ্য কবিতা। জগতের এক অদ্ভুত নিয়মে, যা আমাদের ভালো লাগে না, সেসবই কানে আসে সবচেয়ে বেশি। এর ঠিক পরে পরেই মঞ্চে উঠলেন এক ভদ্রলোক, ছন্দে একটি দীর্ঘ কবিতা স্মৃতি থেকে পড়লেন। কী অপূর্ব সে পাঠ, মনে পড়ে দীর্ঘ এই কবিতা বীথি নামক একটি মেয়েকে নিয়ে। বছর পঞ্চাশের এই মানুষটির পাঠে বীথি কখনও হয়ে উঠছে আমার বান্ধবী, কখনও প্রেমিকা, কখনও স্কুলের দিদিমণি। ভদ্রলোককে সম্ভবত আমরা সবাই চিনি। ময়দানের মাঠ থেকে স্মৃতিতে ভেসে আসে তাঁর গলার স্বর, ‘পাঁচটাকায় কিনবেন, সাতমিনিট পড়বেন, তিনঘণ্টা হাসবেন...’। শরীরের সামনে ও পিছনে বিরাট দুই পোস্টার, মাথায় টুপি, আর কাঁধে রাখা কঞ্চির উপর হাত রেখে পত্রিকা বিক্রি করছেন তিনি। বছরের পর বছর। আড়াই ফুট থেকে পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি হয়ে গেলাম, গালে দাড়ি গজাল, চুল পাকতেও শুরু হয়ে গেল তবু দুলালের তালমিছরির মতো ভদ্রলোক সেই একই রয়ে গেলেন। বইমেলার বয়স বাড়তে দেবেন না তিনি।
চায়ের কথা এল, এল বইয়ের কথাও, এরপর খানিক চানাচুর না হলে জমে না সন্ধের আলাপ, তাই ডেকে আনা আরেক ভদ্রলোককে, মেলা তখনও শুরু হয়নি। ১৪ই জানুয়ারি, সুকল্পদার সঙ্গে মেলার মাঠে ঢুকেছি স্টলের কাজ কতটা এগোল বুঝে নিতে। দুপুর পেরিয়ে তখন সন্ধের আলো জ্বলতে শুরু হয়েছে। মাঠময় শুধু পেরেক আর মজুরদের খিচুড়ির গন্ধ। একগাল দাড়ি, মাথায় একটি অদ্ভুত আকৃতির টুপি পরে ইনি এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। বললেন ‘মুড়ি খাবেন? বা নিমকি? সবই বাড়িতে ভাজা, দশটাকা করে প্যাকেট।’ মেলা তখনও শুরুই হয়নি। বলা ভালো শুরু হতে দিন চার-পাঁচেক বাকি। স্টেজ রিহার্সালের মতো ভদ্রলোক ফেরি করছেন মুড়ি চানাচুর, নিমকি। কটাই বা লোক মাঠে? মিস্তিরিরা তাদের রান্না রেঁধেই খাচ্ছে তখনও। আমরা দুপ্যাকেট মুড়ি নিই, খেতে খেতে কথা হয়, আমাদের স্টল দেখতে আসেন উনি। কথা দেন রোজ দেখা করে যাবেন। মেলা শুরুর পর আমাকে টেবিলে দেখে খুব অবাক হন, বলেন স্টলও আবার টেবিলও? টেবিল দেখে হয়তো মায়া হয় খানিক, এরপর থেকে মুড়ি খেতে বলেন না আর। একদিনও না। আমিও চাই না নিজে। যে লোক ফাঁকা মাঠে আমায় পণ্য বিক্রি করার ক্ষমতা রাখেন, ভরা মেলায় তাঁর ভাতের অভাব হবে না। শেষদিন ঘণ্টা বাজার পর একবার ফিরে আসেন টেবিলে। আমাদের ব্যাগ দেখে বলেন ‘এই এত বই ফিরছে?’, ভেজা গলায় উত্তর দিই, ‘হুম’। হাতের থলি দেখিয়ে জানান তিন চারটে প্যাকেট পড়ে আছে মাত্র। গেট থেকে বেরোলেই বিক্রি হয়ে যাবে। তারপর ভাঙতে থাকা ভিড়ে হারিয়ে যান লোকটি। পুরো একবছরের জন্য। আমাকে হারানোর আনন্দে আগামী একবছর আর পা বাড়াবেন না এই তল্লাটে...
চিত্রগ্রাহক - আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor