কয়েকদিন আগেই আদিবাসীদের মহামিছিল দেখেছিল মহানগরী। দেউচা পাঁচামিতে (Deucha Panchami) উন্মুক্ত কয়লাখনি গড়ে তোলা কিংবা অযোধ্যা পাহাড়ে ঠুরগা পাওয়ার প্রজেক্ট―পশ্চিমবঙ্গ থেকে সারা ভারতবর্ষ বর্তমানে দুটি পক্ষে ভাগ হয়ে গিয়েছে। একদিকে উন্নয়নের পক্ষে চলছে সওয়াল। চাকরির দাবিতে কথা বলছেন অনেকেই। অন্যদিকে অবাধে পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, পরিবেশবিদ, বিজ্ঞানী এবং বনবাসী মানুষরা। তাঁদের মতে, পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা ভারতবর্ষে চলছে অবাধে বনসম্পদ হরণ। এই বনসম্পদ ধ্বংসের ফলে সঙ্কটের মুখে বাস্তুতন্ত্র। সিকিম-হিমাচলে প্রকৃতির তাণ্ডব যেন এই সামগ্রিক বিপর্যয়ের অশনি সঙ্কেত। আদিবাসী আন্দোলনকারীদের মতে, এই উন্নয়নের ছলে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে আদিবাসীদের আত্মমর্যাদা, তাঁদের অধিকার, বাসস্থান। রাতারাতি ভেঙে ফেলা চলছে ধর্মস্থান। এবং এই সবটুকুই হচ্ছে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে।
এই মিছিলের বার্তা সমাজের বেশিরভাগ স্তরেই খানিক আলগাভাবেই গিয়েছে বলে মনে করছেন আন্দোলনকারীরা। কোথাও কোথাও শহরের নিয়মশৃঙ্খলা বিঘ্ন করার অভিযোগও উঠেছে। ফলে সেই নানা চাপান-উতোরের ঘোলাজল থেকে আন্দোলনের দাবিগুলিকে সুস্পষ্টভাবে জনসমক্ষে হাজির করার জন্যই। ‘প্রকৃতি বাঁচাও ও আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চ'-এর বিভিন্ন আদিবাসী মঞ্চ, সংগঠন ও গণতান্ত্রিক ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে ডাকা যৌথ বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে ৮ অক্টোবর একটি সাংবাদিক সম্মেলনের ডাক দেওয়া হয়। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ‘প্রকৃতি বাঁচাও ও আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চ'-এর অন্যতম আহ্বায়ক রাজেন টুডু। ছিলেন আন্দোলনের প্রথম সারির মুখ―সুপেন হেমরম, রতন হেমরম, জগন্নাথ টুডু, নকুল বাস্কে, গুলান মুর্মুরাও। কথায় কথায় তাঁরা স্পষ্ট করলেন, আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি। উঠে এল ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও।
রাজেনবাবু বলছিলেন, ২০১৮ থেকে জারি থাকা অযোধ্যা-বাঁচাও আন্দোলনের কথা। ২০০৬ সালে পাশ হওয়া বন-আইন বলছে, বনে কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রজেক্ট চালাতে গেলে সকলের আগে গ্রামসভার সম্মতি নেওয়া প্রয়োজন। এই গ্রামসভা হল, গ্রামের সমস্ত সদস্যদের নিয়ে গঠিত সাধারণ সভা। আন্দোলনকারী লখিরাম টুডু জানালেন, সেই সভার কোনো অনুমতি ছাড়াই অঞ্চলভিত্তিকভাবে বেআইনি গ্রামসংসদ গড়ে তুলছে সরকার। যেখানে থাকছে সরকার পক্ষের কোনো পেটোয়া লোক। ফলে সরকারের এই পদক্ষেপ বস্তুতপক্ষে বেআইনি।
এই পাওয়ার প্রজেক্ট হলে প্রাণ-প্রকৃতি-বাস্তুতন্ত্রের উপর কোপ তো পড়বেই, উপরন্তু উচ্ছেদ হতে হবে হাজার হাজার আদিবাসীদের। আন্দোলনকারীরা এর মধ্যে কেন্দ্র-রাজ্য উভয় তরফেই বাদানুবাদ চালিয়েছেন। আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। দরখাস্তের পর দরখাস্ত গিয়েছে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে। বিভিন্ন সরকারি আধিকারিকদের দোরে দোরে ঘুরেছেন তাঁরা। এমনকি কেন্দ্রীয় উপজাতি বিষয়ক মন্ত্রী অর্জুন মুণ্ডার সঙ্গেও চলেছে বৈঠক। কোথাও সদুত্তর আসেনি।
আরও পড়ুন
মাতৃভাষাতেই পড়াশোনা আদিবাসীদের, উদ্যোগ ঝাড়খণ্ডে
অথচ আগামী ১২ অক্টোবর, রানি রাসমণি রোডে আরও একটি আদিবাসী সংগঠন ‘সুষ্ঠু সমাধান’-এর দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ ডেকেছে। তাঁদের দাবিপত্রে এই ভয়াবহ ধ্বংসের বিরুদ্ধে তেমন স্পষ্ট অবস্থান নেই। রাজেনবাবুর মতে এঁরা মূলত সরকার ঘনিষ্ঠ। এবং একভাবে এই আদিবাসীদের সম্মিলিত ঐক্যের মধ্যে বিভাজন আনার চেষ্টা করছেন। ১২ তারিখের এই ‘মেকি’ বিক্ষোভসভা এই সাংবাদিক সম্মেলন ডাকার অন্যতম কারণও।
আরও পড়ুন
‘বাধ্য’ হয়েই লিভ-ইন করেন ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীরা, কী সেই কারণ?
কথায় কথায় দেউচা পাঁচামির প্রসঙ্গও উঠে এল। খানিক তির্যকভাবেই প্রশ্ন ছিল―অঞ্চলের মানুষ কি সত্যিই উন্নয়ন চাইছেন না? উত্তরে পরিসংখ্যানের মাধ্যমেই স্পষ্ট করা হল বিষয়টি। মহম্মদবাজার এলাকা সংলগ্ন ৪২টি গ্রামের অন্তর্ভুক্ত ২২,০০০টি পরিবারকে উচ্ছেদ করে তৈরি হবে এই খোলামুখ কয়লাখনি। ধ্বংস হবে আঞ্চলিক ধর্মস্থান। আদিবাসীদের সংস্কৃতি, কৃষ্টিতে পড়বে আঘাত। ‘আমাদের কোনো সরকারের সঙ্গে বিরোধিতা নেই। কিন্তু নিজের দেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে, প্রায় উদ্বাস্তু'র মতো থাকতে হবে?’ প্রশ্ন ফিরিয়ে দেন রাজেন টুডু।
তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, প্রকৃতপক্ষে উন্নয়ন আসলে কী? খোলসা করেন সুপেন হেমরম। ‘উন্নয়ন হোক জীবনদায়ী। উন্নয়ন হোক পরিবেশবান্ধব। আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার, তাঁদের নিজস্ব কৃষ্টি-আচার-সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার অধিকার সুনিশ্চিত হোক। দেউচায় হাজার হাজার পরিবারের মধ্যে মাত্র এক থেকে দেড় হাজার মানুষ শিক্ষিত। অথবা চাকুরিযোগ্য। ফলে সরকার যে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি কাদের ক্ষেত্রে খাটবে? এবং যাঁরা চাকরি পেলেন না, উচ্ছেদ হলেন―তাঁদের পরিণতি কী হতে চলেছে? এর নামই কি উন্নয়ন?’
‘প্রকৃতি বাঁচাও ও আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চ’-এর পাশাপাশি জুড়ে গিয়েছে ভারত জাকাত মাঝি পরগনা মহল, আদিবাসী কল্যাণ সমিতি, ভারতীয় ভূমিক সমাজের মতো বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠন। রাজেন টুডু জানালেন, আন্দোলন চলবে গণতান্ত্রিক পথে। এবং পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষে ২০০৬ বন-আইন কার্যকর করাই এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্যগুলির অন্যতম।
‘সরকার আইন ভুলতে বসেছে। আমরা সেই আইনটাই ভালোভাবে চেনাতে এসেছি।’ বলছিলেন সুপেন হেমরম। আন্দোলনের মূল বার্তাগুলি খুব শীঘ্রই সাধারণ মানুষদের মধ্যে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে দেওয়ার সংকল্প নিয়েছেন তাঁরা।
Powered by Froala Editor