“দেড়শো বছরে পা দিয়েছে কলকাতা ট্রামওয়েজ কোম্পানি। এই বিষয় নিয়ে রীতিমতো চর্চা চললেও, অনেকেই কিন্তু জানেন না কলকাতা ট্রাম কোম্পানি বাসও চালু করেছিল কলকাতায়। এবছরেই কিন্তু একশো বছরে পা দিলে সেই বাস।”
বলছিলেন সংগ্রাহক, গবেষক ও সাংবাদিক সৌভিক মুখোপাধ্যায়।
ট্রাম কোম্পানির বাস। শুনলে চমকে যেতে হয় বইকি। তবে আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে কলকাতার বুকে এমনই এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছিল ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি। তবে কালের আবহেই বন্ধ হয়েছে সেই বাস পরিষেবা। শুধু বন্ধই হয়নি, কলকাতার বুক থেকে মুছে গেছে সে-সব বাসের স্মৃতিচিহ্নও। ‘ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি’-র সেই ঐতিহাসিক বাস পরিষেবার শতবর্ষ পূর্তিতেই আজ আয়োজিত হতে চলেছে এক বিশেষ প্রদর্শনী। আর সেই প্রদর্শনীর অন্যতম উদ্যোক্তা সৌভিক।
আরও পড়ুন
চলমান ট্রামেই জাদুর প্রদর্শনী, শীঘ্রই পথে নামবে ম্যাজিক ট্রাম
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কলকাতার বুকে হঠাৎ কেন বাস পরিষেবা চালু করেছিল খোদ ট্রাম কোম্পানি? উত্তর দিতে গিয়ে সৌভিক ডুব দিলেন সাদা-কালো কলকাতার ইতিহাসে, “কলকাতায় প্রথম বাস চলে ১৮৩০ সালে। অবশ্যই সেটা ছিল ঘোড়ায় টানা বাস। এসপ্ল্যানেড থেকে ব্যারাকপুর পর্যন্ত চলেছিল সেই বাস। তবে মোটরচালিত বাস চালু হয় বহু পরে, বিশ শতকে।”
আরও পড়ুন
ট্রাম ও লঞ্চ মিলিয়ে সারাদিনের ‘বিবেকযাত্রা’, অভিনব উদ্যোগ পরিবহণ নিগমের
হ্যাঁ, ইতিহাস অনুযায়ী কলকাতায় রাস্তায় প্রথম মোটরবাস চলেছিল ১৯১২ সালে। নেপথ্যে ওয়ালফোর্ড কোম্পানি। তবে পরীক্ষামূলকভাবে কিছুদিন চালানোর পরেই বন্ধ হয়ে যায় সেই বাস পরিষেবা। কলকাতায় আবার বাসের জনপ্রিয়তা বাড়তে শুরু করে ১৯২০-র দশকের শুরু থেকে। ততদিনে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে। গান্ধীজির ডাকে সংগঠিত হয়েছে একাধিক সত্যাগ্রহে। আর সেই ঘটনার রেশ পড়েছিল ট্রাম কোম্পানিতেও। ক্রমাগত ধর্মঘট, হরতাল এবং প্রতিবাদের শিকার হতে থাকে ক্যালকাটা ট্রাম কোম্পানি।
তবে শুধুমাত্র ট্রাম ধর্মঘটের মধ্যেই আটকে ছিল না এই ব্যাপারটা। ট্রাম বন্ধ হওয়ায় সে-সময় অফিসে যাওয়াই দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছিল সাধারণ মানুষ, বিশেষত বাবুদের। নিজেরাই সমাধানের পথ খুঁজতে শুরু করেছিল বহু সংস্থা এবং অফিস। পণ্যবাহী লরির কাঠের বেঞ্চ পেতে ব্যবস্থা করা হত বাবুদের। ওঠা-নামা করার জন্য লরির সঙ্গে সংযুক্ত করা হত কাঠের মই। অল্পদিনের মধ্যেই পুলিশের অনুমতি নিয়ে এই ব্যবসায় নামেন বহু লরির মালিকরা। গণপরিবহনের চেহারা নেয় এই পরিষেবা। চালু করা হয় টিকিটও। ধীরে ধীরে এই লরিগুলিই যেন চেহারা নেয় বাসের।
এই সময় একদিকে যেমন কলকাতার বুকে ক্রমশ জনপ্রিয়তা বাড়ছিল বাসের, তেমনই এসবের মধ্যে ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাতে থাকে ট্রাম। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তাই বাজারদখলের ময়দয়ানে নামে ক্যালকাটা ট্রাম কোম্পানি। পিছিয়ে ছিল না ওয়ালফোর্ড কোম্পানিও। নতুন করে এই দুই কোম্পানির পরিষেবা চালু হয়েছিল ১৯২২-২৩ সালে। ১৯২৪ সালের পরিসংখ্যান বলছে, সে-যুগে ১০টি রেজিস্টার্ড বাস ছিল কলকাতায়। যার মধ্যে দুটি বাস ছিল ওয়ালফোর্ড কোম্পানির, বাকি ৮টির মালিক ছিল ট্রাম কোম্পানি। ১৯২৬ সালে ট্রাম কোম্পানির বাসের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৭টি।
অবশ্য কালের আবহে বন্ধ হয়ে যায় ট্রাম কোম্পানির এই বাসের রমরমাও। এতদিন তারা টিম টিম করে উপস্থিতি জানান দিত শুধুমাত্র সাহিত্যে। “কিছুদিন আগে আমার কাছে ক্যালকাটা ট্রাম কোম্পানির এই বাসের কিছু ছবি ও অন্যান্য প্রামাণ্য দলিল আমার হাতে আসে। যার মধ্যে রয়েছে ক্যালকাটা ট্রাম কোম্পানির বাসের বেশ কিছু টিকিট ও ছবি। তাছাড়াও ১৯২০ সালে ট্রাম কোম্পানি একটি পোস্টকার্ডের ফোল্ডার ছাপিয়েছিল। সেই ফোল্ডারের এক কোণায় ছোট্ট করে এই বাসের ছবিও পাওয়া যায়”, জানালেন সৌভিক।
এই দুষ্প্রাপ্য নথি ও প্রামাণ্য দলিল নিয়েই বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন সৌভিক। তাঁর কথায়, “কলকাতায় ট্রাম কোম্পানির বাস চলত, তার পাথুর প্রমাণ বা স্টোন এভিডেন্স এইটুকুই। সেগুলোই মানুষের সামনে তুলে ধরাই প্রধান উদ্দেশ্য।” জানা গেল, হাওড়ার শিবপুরের বাড়িতে নিজস্ব আর্কাইভ ‘আড্ডাঘর’-এ এই প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছেন তিনি। তাছাড়াও ‘কলকাতা বাস-ও-পিডিয়া’ সংগঠনের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছেন সৌভিক। বিগত কয়েক বছর ধরে কলকাতার গণপরিবহন, বিশেষত বাসের ইতিহাসচর্চা ও বিশ্লেষণাত্মক অধ্যয়ন করে চলেছে এই সংগঠন। এই সংগঠনের ওয়েবসাইটেও আনুষ্ঠানিকভাবে আজ মুক্তি পাবে ট্রাম কোম্পানির বাসের প্রামাণ্য নথিগুলি। আগামীতে সাধারণ মানুষ এক ক্লিকেই চাক্ষুষ করতে পারবেন কলকাতার হারিয়ে যাওয়া সেই ইতিহাস।
তবে এখানেই থেমে থাকছেন না সৌভিক। বরং তিনি চান, কলকাতার গণপরিবহনের এই ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্যোগ নিক কলকাতার পরিবহন বিভাগ কিংবা রাজ্য সরকার। তাঁর কথায়, “কলকাতায় একটা ট্রান্সপোর্ট মিউজিয়াম যাতে তৈরি হয়, সেই দাবিই জানাচ্ছি। সেটা সম্ভব না-হলে অন্ততপক্ষে একটি ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরি হোক।” আজ ‘আড্ডাঘর’-এ আয়োজিত হওয়া বিশেষ প্রদর্শনী আরও জোরালো করবে সৌভিক তথা ‘কলকাতা বাস-ও-পিডিয়া’-র এই আবেদনকে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো…
তথ্যসূত্র ও ছবি ঋণঃ
১. সৌভিক মুখোপাধ্যায়
২. কলের শহর কলকাতা, সিদ্ধার্থ ঘোষ, আনন্দ পাবলিকেশন
Powered by Froala Editor