১৯৮৫ সাল। সার্নের গবেষণাকেন্দ্রে জরুরি তৎপরতায় চলছে ব্যবস্থাপনার কাজ। কারণ, এখানেই গবেষণা করতে আসছেন পৃথিবীর অন্যতম প্রতিভাবান বিজ্ঞানী। স্টিফেন হকিং। গবেষণা আর বুদ্ধিমত্তার নিরিখে আইনস্টাইনের সমকক্ষই ধরা হয় তাঁকে। কিন্তু ভবিতব্যকে কি কেউ আটকাতে পারে? উচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনাই যেন ‘শমন’ হয়ে দাঁড়াল তাঁর কাছে। সেখানে হকিং আক্রান্ত হলেন নিউমোনিয়ায়। পরিস্থিতি এমনই হয়ে উঠল যে লাইফ সাপোর্টে দেওয়া না হলে প্রাণ যাবে তাঁর। শেষমেশ তাঁর স্ত্রী জেন কেমব্রিজে নিয়ে আসে তাঁকে। সেখানেই অস্ত্রোপচার করা হয়। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করতে শ্বাসনালীতে ছিদ্র করেন চিকিৎসকরা। মাত্র ৪৩ বছর বয়সেই বন্ধ হয়ে যায় তাঁর কণ্ঠস্বর।
তবে বিশ্বের অন্যতম এই বিজ্ঞানী তার পরেও চালিয়ে গেছেন গবেষণা। প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেছেন প্রযুক্তির মাধ্যমে। আর তার পিছনেই রয়েছে দুই ভারতীয় গবেষকের উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব। ২০০১ সাল। সে বছর জানুয়ারি মাসে প্রথমবারের জন্য ভারতে পা দিয়েছলেন কিংবদন্তি পদার্থবিদ। পুনের টাটা ইনস্টিটিউটে দীর্ঘ ১৬ দিনের সফরে এসেছিলেন এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নিতে। ট্র্যাকোটমির পর তখন পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ ১৫ বছর। এমআইটির গবেষকরা অবশ্য ততদিনে তৈরি করে দিয়েছেন তাঁর জন্য বিশেষ যোগাযোগের ব্যবস্থা। হুইলচেয়ারের সঙ্গে কম্পিউটার স্ক্রিন সংযোগ করে তাঁরা এমন একটি সফটওয়্যার তৈরি করেছিলেন, যাতে সামান্য নড়াচড়ার মাধ্যমেই টাইপ করতে পারেন তিনি। তবে তা ভীষণই ধীরে। মিনিটে প্রায় ৫টি শব্দ টাইপ করতে পারতেন তিনি।
তবে ভারত সফর হঠাৎই বদলে দেয় সবকিছু। ৮ জানুয়ারি মুম্বাইতে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন দুই ভারতীয় কম্পিউটার প্রোগ্রামার— অরুণ মেহতা এবং বিক্রম কৃষ্ণা। কিংবদন্তি গবেষকের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎই ভাবিয়ে তুলেছিল অরুণ মেহতাকে। কারণ ততদিনে হকিং-এর শরীরে আরও জাঁকিয়ে বসেছে এএলএস। আঙুল নাড়ানোর সামান্যতম ক্ষমতাও নেই আর তাঁর। সেইসঙ্গে তাঁর কম্পিউটার সফটওয়্যারেও বেশ কিছু গাফিলতি নজরে আসে মেহতার। নিজেই এগিয়ে আসেন তিনি। নতুন করে একটি সফটওয়্যার ডিজাইনের প্রস্তাব দেন হকিংকে।
হকিং-এর ভারত সফর শেষ হওয়ার পরই সহকর্মী বিক্রম কৃষ্ণাকে নিয়ে কাজ শুরু করে দেন অরুণ মেহতা। কয়েক মাসের মধ্যেই তৈরি হয়ে যায় সফটওয়্যার। তাঁদের তৈরি সেই সফটওয়্যার চালানো যাবে মাত্র একটা আঙুলের ব্যবহারেই। পাশাপাশি এলোকেটর নামে পরিচিত সেই যান্ত্রিক মাধ্যমটি ক্রমাগত শিখতে থাকবে হকিং-এর ভাষা। ফলে, যত দিন যাবে হকিং-এর লেখা শব্দের অনুসরণ করে পূর্বাভাস দিতে পারবে পরবর্তী সম্ভাব্য শব্দের।
বলাই বাহুল্য, এই নতুন প্রযুক্তিকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন হকিং। সফটওয়্যার তৈরির পর কেমব্রিজে গিয়ে দীর্ঘদিন হকিং-এর সঙ্গে দিক কাটিয়েছেন ভারতীয় প্রোগ্রামারদ্বয়। পরবর্তীকালে হকিং-এর মৃত্যুর সময় স্মৃতিচারণায় কৃষ্ণা উল্লেখ করেন শুধু বুদ্ধিমত্তার নিরিখেই নন, হকিং অত্যন্ত রসিক এবং মজাদার এক ব্যক্তিত্ব। হকিং নিজেও ব্রিটেনে এক বক্তৃতায় ভারত সফরের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন ‘ম্যাগনিফিসেন্ট’। ২০০৮ সালে রাজপ্রাসাদে এক আমন্ত্রণে কুইন এলিজাবেথ তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, আমেরিকান ভয়েসই তিনি ব্যবহার করছেন কিনা। খানিক মজা করেই উত্তর দিয়েছিলেন হকিং। বলেছিলেন, ‘কপিরাইট নেওয়া আমেরিকার ভয়েস, তবে ভারতীয়দের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত’।
যাই হোক, শুধু হকিং-এর জন্য এই বিশেষ সফটওয়্যার তৈরি করেই থেমে যাননি ভারতের সেই দুই গবেষক। বরং ২০০৯ সালে মেহতা এবং কৃষ্ণা তৈরি করে ফেলেন একটি সম্পূর্ণ বেসরকারি সংস্থা, ‘বাপসি’। সেই সংস্থার হয়েই বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের জন্য একাধিক প্রযুক্তি তৈরি করেছেন তাঁরা।
দৃষ্টিহীনদের জন্য বানিয়েছেন ‘পকেটএসএমএস’ নামের একটি অ্যাপ। যা কম্পনের ব্যবহারে মর্স কোডের মাধ্যমে পড়ে শোনায় এসএমএস। অটিজম, ডিস্লেক্সিয়া আক্রান্তদের জন্য ‘স্কিড’ নামের একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মও তৈরি করেছেন এই গবেষকদ্বয়। আবার তাঁদের তৈরি ডিজিটাল স্লেট ‘নারঙ্গি’ দৃষ্টিহীন ও শ্রবণে অক্ষমদের সাহায্য করছে ছবি আঁকায়। বর্তমানে সম্পূর্ণভাবে প্রতিবন্ধী মানুষদের কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন এই দুই গবেষক। হয়ে উঠেছেন সক্রিয় মানবাধিকারকর্মী। এমনকি দিল্লি আইআইটিতে গবেষক মেহতার তত্ত্বাবধানেই চলছে দৃষ্টিহীনদের কম্পিউটার ল্যাঙ্গুয়েজ ও প্রোগ্রামিং শেখানোর কর্মসূচী।
২০০১ সালের জানুয়ারির সেই সন্ধায় মুম্বাইয়ের হোটেলে হকিংয়ের সঙ্গে মেহতা ও কৃষ্ণার সাক্ষাৎ যে শুধু বদলে দিয়েছিল কিংবদন্তির জীবন, এমনটা একেবারেই নয়। উল্টোদিকে হকিংয়ের প্রতিবন্ধকতা তাঁদের দেখতে শিখিয়েছিল এক অন্ধকার জগতকে। সেই পথেই আলোর দিশা দেখাতেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন কৃষ্ণা এবং মেহতা। তবে হাই-প্রোফাইল চাকরির সুযোগ ছেড়ে এমনভাবে অলাভজনক সংস্থা চালিয়ে যেতে পারেন ক’জন? সেখানেই যেন বাকিদের থেকে অনন্য হয়ে গেছেন এই দুই ভারতীয় উদ্ভাবক…
Powered by Froala Editor