১৯৪০ সাল। ২৪ পরগনার অ্যাডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট তিনজনকে সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলেন। একজন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি মামলার মূল আসামী। তাঁর শাস্তির মেয়াদ ৬ মাস। অন্য দুজন, অর্থাৎ বিজনকুমার দত্ত এবং সুবীরকুমার দাশগুপ্তের শাস্তির মেয়াদ ৩ মাস। না, এঁদের কারোর বিরুদ্ধেই সশস্ত্র বিপ্লবী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠেনি। অভিযোগ উঠেছে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি বইকে ঘিরে। ‘ইম্পেরিয়ালিস্ট ওয়ার অ্যান্ড ইন্ডিয়া’। সেই বইয়ের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন বিজনকুমার, ‘যুদ্ধবিরোধী কেন’। আর সুবীরকুমার ছিলেন সম্ভবত প্রকাশক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ঘিরে লেখা একটি বই। তাই ব্রিটিশ সরকারের টনক নড়িয়ে দিয়েছিল। এমন একটা সময়, যখন বিপ্লবীদের ভিড়ে জেলখানায় জায়গা পাওয়া কঠিন। সেখানে একটি বই প্রকাশের অপরাধে তিনজনের কারাদণ্ড থেকেই বোঝা যায়, বইটি খুব নিরীহ ছিল না।
সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের এক ব্যতিক্রমী উত্তরসূরি। ইতিহাসে তাঁর জায়গাটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এবং তার সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির কোনো সম্পর্ক নেই বললেই চলে। জমিদারবাড়ির আভিজাত্য থেকে বেরিয়ে এসে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন একেবারে মেহনতি মানুষের যুদ্ধে। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র এবং সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র সৌমেন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় থেকেই জড়িয়ে পড়েন ব্রিটিশবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে। ১৯২৬ সালে বেঙ্গল পেজেন্টস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স পার্টির সম্পাদকও নির্বাচিত হন। এই সময় রাশিয়ার তাসখন্দে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের উদ্যোগে তৈরি কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার একটি গোপন শাখাও তৈরি করেছিলেন সৌমেন্দ্রনাথ। পরিস্থিতি বেশ খারাপের দিকে যাচ্ছে মনে করে সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে বিলেতে পাঠানোর উদ্যোগ নিলেন। তবে তাতে ফল হল উলটো। ইউরোপে গিয়ে আরও বেশি করে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন সৌমেন্দ্রনাথ। আর এই সময় থেকেই তাঁর লেখা বিভিন্ন বই ব্রিটিশ সরকারকে ভাবিয়ে তোলে। সম্ভবত কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত চিন্তকদের মধ্যে মানবেন্দ্রনাথের পরেই তাঁর নিষিদ্ধ বইয়ের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
১৯৩০ সালে ‘বিপ্লব বৈশাখী’ নামে একটি বই লেখেন সৌমেন্দ্রনাথ। সুদূর বার্লিন থেকে প্রকাশিত এই বইতে একটু একটু করে ব্যাখ্যা করা হয় ভারতে বিপ্লব প্রচেষ্টার রূপরেখা এবং সম্ভাবনার কথা। সমুদ্র পেরিয়ে সেই বই ভারতে এসে পড়তেই টনক নড়ে সরকারের। ইন্ডিয়া গভর্নমেন্টকে এই বিষয়ে সচেতন করে চিঠি লেখে বেঙ্গল গভর্নমেন্ট। কিছুদিনের মধ্যেই বাজেয়াপ্ত করা হয় বইটি। শুধু তাই নয়, এরপর সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখার উপর কড়া দৃষ্টি রাখতে শুরু করে বেঙ্গল গভর্নমেন্ট। পরের বছর ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বইটি প্রকাশিত হলে সঙ্গে সঙ্গে আবারও চিঠি যায় ইন্ডিয়া গভর্নমেন্টের কাছে। এই বইটিও বাজেয়াপ্ত হল। কিন্তু তারপরেও লেখা বন্ধ করলেন না সৌমেন্দ্রনাথ। ১৯৩২ সালে আবার লিখলেন ‘লাল নিশান’। ততদিনে অবশ্য সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্টদের সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে কমিন্টার্ন ত্যাগ করেছেন তিনি। ‘লাল নিশান’ প্রকাশিত হওয়ার গোয়েন্দা বিভাগের কাছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের একটি নির্দেশ যায়। তাতে বলা হয়, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সব লেখাই আপত্তিজনক। তাই তাঁর কোনো বই যেন ভারতের সীমানায় প্রবেশ করতে না পারে, সে-দিকে কড়া নজর রাখতে হবে।
সেই বছরই জার্মানিতে হিটলার বিরোধিতার জন্য গ্রেপ্তার হন সৌমেন্দ্রনাথ। পরের বছর মুক্তি পেলে ফিরে আসেন নিজের দেশে। ভারতে। যাঁর বই দেশের সীমানায় প্রবেশ করা নিষিদ্ধ, তিনি স্বয়ং এসে হাজির হলেন। এবং ভারতে এসেও আবার কলম ধরলেন। একে একে প্রকাশিত হয় ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীই কংগ্রেস বিরোধী’, ‘বন্দী’, ‘চাষীর কথা’। আর সঙ্গে সঙ্গে বাজেয়াপ্ত হয় প্রতিটিই। অবশ্য এইসমস্ত বইতে ব্রিটিশ সরকারের চেয়ে আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল তৎকালিন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ। সেই সময়ের মূল ধারার কমিউনিস্টদের মতো আগে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পরে সমাজতন্ত্র, এই ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন না সৌমেন্দ্রনাথ। তাই তাঁর কাছে কংগ্রেস মানে জমিদারদের দল। আর সেই দলের হাত ধরে দেশে শ্রমিক-কৃষকের ক্ষমতায়ন সম্ভব নয় বলেই মনে করতেন তিনি। তবে কংগ্রেস নেতৃত্বের বিরোধিতার ভিতর দিয়েও তো আসলে ব্রিটিশ ভারতে এক বিপ্লবী কর্মকাণ্ড শুরু করার ডাক দিচ্ছিলেন তিনি। তাই ব্রিটিশের কাছে তো তা আশঙ্কার কারণ হবেই।
আরও পড়ুন
গানের সূত্রে ঢুকে পড়বে পশ্চিমি পুঁজিবাদ; কিউবায় লেননকে নিষিদ্ধ করলেন ফিদেল কাস্ত্রো
বাংলা বইগুলি ছাড়াও অসংখ্য ইংরেজি বই লিখেছেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কখনও হিটলারের জার্মানি সম্বন্ধে, কখনও আন্দামানের ভারতভুক্তি সম্বন্ধে। এছাড়াও লিখেছেন চট্টগ্রামে মাস্টারদার নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা আন্দোলন নিয়ে। বস্তুত মাস্টারদা এবং চন্দ্রশেখর আজাদের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন তিনি। এবং সেইসমস্ত বিষয় নিয়ে লেখা প্রায় সমস্ত বইই ব্রিটিশ আইনে নিষিদ্ধ হয়েছে। আজ তাঁর অধিকাংশ বইয়ের কোনো কপি পাওয়া যায় না। ব্রিটিশ সরকার যেগুলো পেরেছে নষ্ট করেছে। আর বাকিটা নষ্ট করেছেন তাঁর দলের সদস্যরাই। দল বলতে সিপিআই যেমন, তেমনই পরে তাঁর তৈরি আরসিপিআই দলও। বস্তুত সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তীব্র সোভিয়েত বিরোধিতা সেইসময় কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ মেনে নেননি। আবার অবাক করা বিষয় হল, রাশিয়া সম্পর্কে যখন সারা পৃথিবীজুড়ে নেতিবাচক খবরের প্রাধান্য, তখন সেইসমস্ত অপপ্রচার সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথকে সচেতন করেছিলেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরই। আর সেই কারণেই দ্বিতীয়বার লেনিনের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ থেকে গিয়েছে সেই দেখার দলিল হয়ে। শুধু সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা হারিয়ে গিয়েছে সময়ের গর্ভে।
তথ্যসূত্রঃ ব্রিটিশ শাসনে বাজেয়াপ্ত বাংলা বই, শিশির কর
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
গণনাট্য সংঘে আত্মপ্রকাশ সুরকার সলিল চৌধুরীর, সেখানেই নিষিদ্ধ হল তাঁর গান