দেবীকে ভোগ দেওয়া হয় চাউমিন, কলকাতার বুকেই রয়েছে এই চিনা কালীমন্দির

‘মা কালীর ভোগ চাউমিন? এমন আবার হয় নাকি?’ শুনে একগাল হাসলেন বৃদ্ধ জন চেং। বললেন, ‘নিজে যা ভালোবাসি, তা মাকে দেব না? নাহলে মায়ের প্রতি আর আমার কীসের ভক্তি?’

ট্যাংরার চিনাপট্টির মোড়ে একচিলতে কালীমন্দির। সকলে বলে ‘চিনা কালীমন্দির।’ কলকাতায় চীনাদের আনাগোনা সেই ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে। এ শহরে প্রথম পা রেখেছিলেন টোনি আচিউ। তাঁর পদচিহ্ন ধরেই মূলত গুয়ানদং প্রদেশ থেকে দলে দলে টেরিটি বাজার ও ট্যাংরায় বাসা বাঁধেন চিনা ‘হাক্কা’ সম্প্রদায়ের মানুষেরা। বাঙালি স্বাদ পায়, এক নতুন সংস্কৃতির। তবে এদেশে থাকতে থাকতে এঁদের অনেকেই ভুলে গিয়েছেন নিজের ভাষা। কেমন যেন মিলেমিশে গিয়েছে, ধর্ম ও বর্ণ। তেমন একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ এই কালীমন্দির। তবে এর ইতিহাস জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে সত্তর বছর।

চিনা কালীমন্দিরকে ঘিরে চালু আছে একটা গল্প। শোনা যায় প্রথমে এটি ছিল রাস্তার ধারে একটি পুজোর থান। বিগ্রহ বলতে কয়েকটি সিঁদুর লেপা কালো পাথর। পড়ে থাকতে অবহেলায়। একদিন ওখানকার একজন চিনা অধিবাসীর ছেলের হল দারুণ জ্বর। দশ বছরের সেই ছেলেকে ডাক্তার-বদ্যি ভালো করতে পারে না। শেষে ছেলের মা-বাপ তাকে নিয়ে যায় মা কালীর থানে। হিন্দু দেবতার পায়ে মাথা কোটে। ধীরে ধীরে ভালো হয় ছেলে। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। সেই পরিবারের হাত ধরেই পত্তন হল চিনা কালীমন্দিরের। 

‘এসব গাঁজাখুরিতে বিশ্বাস করেন?’

আরও পড়ুন
কালীপুজোর দিনই আরাধনা করা হয় লক্ষ্মীর ‘দিদি’ অলক্ষ্মীকে; কিন্তু কেন?

উত্তরে জন চেং-এর মুখে আবার হাসি। জন বাবুর বেড়ে ওঠা এই ট্যাংরা অঞ্চলেই। তাঁর আত্মীয়রা তখন দেখাশোনা করতন মন্দিরের। একটা সময় পাকাপাকিভাবে চলে গিয়েছিলেন আমেরিকার নিউইয়র্কে। তারপর আন্দাজ ১৯৯৭ সালে আবার দেশে ফেরা। হ্যাঁ, তাঁর দেশ তো এই ধুলো ধোঁয়ার কলকাতা। গত পনেরো বছর ধরে এই মন্দিরের সেবাইত জন চেং। নিজের হাতে গাঁথেন জবার মালা। সাজিয়ে রাখেন কোশাকুশি। শুধু পুজোর সময় তাঁকে সাহায্য করেন একজন পুরুতমশাই। তিনিও এলাকার মানুষ। আমার বেয়াড়া প্রশ্নের উত্তরে যে-কোনো নিষ্ঠাবান পূজারীরই ক্ষেপে ওঠার কথা। কিন্তু বৃদ্ধের গলায় আশ্চর্য প্রশান্তি। 

জন চেং

 

আরও পড়ুন
বুকের ওপর মূর্তি রেখে সাধনা; কমলাকান্তের আরাধ্য কালীই বজবজের ‘খুকি’!

‘আমি এসব গল্প শুনেছি। বিশ্বাস করি কি করি না, সেটা তো ভক্তির ব্যাপার। তবে মাঝে মাঝে মনে হয় মা আমার মাথা ছুঁয়ে আশীর্বাদ করছেন।’ ‘সত্যি?’

‘সত্যি মিথ্যা তো জানি না। তবে এমনটা মনে হয়েছে কখনো কখনো। আসলে আমি কখনো ধর্ম বর্ণ, চিনা-ভারতীয় দেখিনি। ভক্তিই তো আসল! অনেকে অনেক কথা বলেছে। বলেছে, ঠাকুরকে চাউমিন খাওয়াচ্ছেন? বিধর্মী বলেছে কেউ। আমি অত ভাবিনি। এখানে বাঙালি আর বিহারি আছে কয়েকঘর। তারা অর্থ সাহায্য করে। নিয়মিত মন্দিরে আসে। সামনেই কালীপূজা আসছে। এবারেও পুজো নিয়ম মেনে ঠিক দুপুর বারোটায় শুরু হবে। এবারেও ভাসান হবে। করোনার কারণে যাত্রায় থাকতে পারবে না অনেকে। কিন্তু পুজোয় থাকবে বটেই।’

আরও পড়ুন
কালীপুজোর মরশুমে বাজি কেনাবেচা নিষিদ্ধ, নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের

কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা গড়ায়। জন চেং আলাপ করিয়ে দেন তাঁর ভাইপো জোসেফের সঙ্গে। এবার থেকে পুজোর ভার নিচ্ছেন তিনি।

জোসেফ চেং

 

‘কাকার বয়স হয়েছে। এই বয়সে ভারী জিনিসপত্র তুলতে পারেন না। আগে সমস্ত যোগাড়যন্ত্র করতেন, কাকা ও তাঁর দুই বন্ধু। তাঁরাও এ-বছর চলে গেলেন করোনায়। আমায় গতকালই কাকা বললেন তিনি একা সামলাতে পারবেন না। ফলে তড়িঘড়ি ছুটলাম কুমোরটুলি। প্রতিমা কিনলাম। কিনতে হল যাবতীয় সামগ্রী।’

বলছিলেন জোসেফ চেং। তিনিও এই এলাকার বাসিন্দা। চেং-রা বংশপরম্পরায় ক্রিশ্চান। তবুও মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন ওতপ্রোতভাবে।

‘ধর্ম যাই হোক, ছোটো থেকে দেখছি, এখানে পুজো হতে। কাকা মন্দিরে পুজো করেন। কত আনন্দ, স্মৃতি জড়িয়ে। চাই না সেসব কাকার সঙ্গে সাঙ্গ হয়ে যাক। আমরা তরুণ প্রজন্ম। আমাদের এবার হাল ধরতে হবে।'

আলোয় ভেসে যাচ্ছে চিনা কালীবাড়ি। বৃদ্ধ জন চেং মায়ের চরণে সঁপে দিচ্ছেন রক্তজবা। ভারত-চিন-হিন্দু-ক্রিশ্চান বিভেদ মানে না ঈশ্বরের কাছে। সাধকের পরিচয়টিই হয়ে ওঠে শাশ্বত। চিরন্তন। 

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: জন চেং, জোসেফ চেং, চিনা কালীমন্দির, ট্যাংরা
চিত্রঋণ: মৃত্তিকা গুহ

Powered by Froala Editor