‘এই যে এত মানুষ বেরিয়েছেন রংবেরংয়ের নতুন জামাকাপড় পরে, ছোট্ট খোকাখুকুদের পায়ে কিচমিচ শব্দ করা জুতো―দেখতে শুনতে খুব ভালো লাগছে। কেবল একটাই দুঃখ, লাইটিংটা দেখা হল না।’
বলছিলেন, ‘প্রত্যয় (Pratyay) জীবন সহায়তা কেন্দ্র'-এর আবাসিক সর্বাণী চন্দ্র। একডালিয়া, সিংহী-পার্ক ঘুরে বকুলতলার পথে প্রত্যয়ের পুজো পরিক্রমা। জোর কদমে চলছেন সৌভিক, সৌরভ, অনির্বাণ, কোয়েল, সর্বাণীরা। আজ ষষ্ঠী। চলছে লিস্টি মিলিয়ে ঠাকুর দেখা। ঘড়িতে বেলা ১২টা। পুজোর রোশনাই ঘিরে রয়েছে ওঁদের। একটি দিনেরই জন্য। অথচ বছর কয়েক আগেও ‘ওঁরা’ ছিলেন ব্রাত্য। সমাজের চোখে বেওয়ারিশ। ‘ওঁদের’ অস্থায়ী ঠিকানা ছিল পাভলভ বা লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতাল। সেই গারদখানার মধ্যে পৌঁছত না ঢাকের বাদ্যি। ‘উৎসব সবার’―লব্জটুকু যেন ওঁদের ক্ষেত্রেই ছিল ব্যতিক্রম।
তবে প্রত্যয়ের আবাসিকরা হাসপাতালের গণ্ডি পেরিয়েছেন বহুদিন। জীবন সহায়তা কেন্দ্রে থেকেই সমাজের মূলস্রোতে ফিরছেন অনেকেই। ‘অঞ্জলি মানসিক স্বাস্থ্য অধিকার সংগঠন’-এর (Anjali MHRO) উদ্যোগ এই ‘মনের মতো ঘর’-এর বয়সও একবছর ছাড়াল। তবে এর আগেও মানসিক হাসপাতালের আবাসিকদের নিয়ে প্যান্ডেল পরিক্রমায় বেরিয়েছিলেন অঞ্জলির কর্মীরা। এই পুজো পরিক্রমা দ্বিতীয়বার। আবাসিকদের সঙ্গেই ঠাকুর দেখছিলেন অঞ্জলির প্রতিষ্ঠাতা, বিশিষ্ট মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী রত্নাবলী রায়।
আরও পড়ুন
ঔষধি গাছে ঘেরা ঝাড়গ্রামের কনক দুর্গা মন্দির
আরও পড়ুন
পুজো মানেই পুজোসংখ্যা, কেমন ছিল প্রথম পুজো সংখ্যার বিজ্ঞাপন?
‘এই পুজো পরিক্রমার উদ্দেশ্য মূলত দুটো। একটা তো বাঙালির মহোৎসবের উদযাপন। তবে তার চেয়েও বড় উদ্দেশ্য হল, সোশ্যাল ইনক্লুশন। আমরা যারা, প্রত্যয়ের মতো জীবন সহায়তা কেন্দ্র চালানোর চেষ্টা করি, সেখানে আমরা চেষ্টা করি সকলের সঙ্গে জুড়ে জুড়ে বাঁচার বার্তা দিতে। আর পাঁচজনের মতোই মানসিক হাসপাতালের আবাসিকরাও যে পুজোর আনন্দে মাততে পারেন―এই ছবিটাই সমাজের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করছি আমরা।’
বলছিলেন ‘প্রত্যয় জীবন সহায়তা কেন্দ্র'-এর আধিকারিক অভিজিৎ রায়। কাঁটায় কাঁটায় ১০টা নাগাদ লুম্বিনী পার্কের কাছ থেকে ছেড়েছে পরিক্রমার গাড়ি। দক্ষিণের সেরা কয়েকটি পুজো দেখে ১টা নাগাদ পেটপুজোর পালা। তারপর ফেরা।
‘মানসিক ভারসাম্যহীন’―তকমাটা যাঁদের গায়ে একপ্রকার সেঁটে দিয়েছিল জনসাধারণ, তাঁরা দিব্যি প্যান্ডেল চষে বেড়াচ্ছেন। কোথাও কোনো ‘বিশৃঙ্খলা’ নেই। এ যেন তথাকথিত স্বাভাবিকতার বুলি আওড়ানো সমাজকে একপ্রকার চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো। হ্যাঁ, আমরাও পারি।
‘সেই আনন্দ'যজ্ঞে সবার মধুর আমন্ত্রণ…'
হাঁটতে হাঁটতেই গুনগুন করছিলেন আবাসিক ভাস্কর মিত্র। নিজের বয়ানে ‘তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত’-এর ছাত্র। গানের ক্লাসও নিয়ে থাকেন আবাসিকদের। তাঁর গলায় যেন কনে দেখা আলোর মতোই খেলা করে টপ্পা-ঠুংরি।
হাঁটতে হাঁটতে বোসপুকুর শীতলা মন্দিরে ঢুকলেন ওঁরা। দুচোখে খুশির আলো। যে আলো, হাজার ওয়াটের ঝাঁ চক চক রোশনাই-এর থেকেও যেন অনেক বেশি উজ্জ্বল।
Powered by Froala Editor