অর্থনৈতিক সূত্র বলে জোগান বৃদ্ধি হলে চাহিদা কমে। ঐকিক নিয়মে চাহিদা অনুযায়ী সম্পূর্ণ জোগান, চাহিদাকে নির্মূল করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে জোগান কখনোই চাহিদাকে ছুঁয়ে ফেলতে পারে না। কারণ চাহিদা অনন্ত। চাহিদার কোনো শেষ নেই। ষাট ও সত্তরের দশকে যখন ময়দানের ঘেরা মাঠে পনেরো হাজার দর্শক গ্যালারিতে খেলা হত, টিকিটের চাহিদা তুঙ্গে থাকত। আশির দশকের পরে সেই দর্শকাসন একসময় এক লাখ হয়েছে। এখন তা ব্যাকেট চেয়ারের সৌজন্যে কমে দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজারে। কিন্তু চাহিদার শেষ নেই।
আজ, বাঙালি তথা ভারতীয় ফুটবলের শতাব্দী প্রাচীন বড় ম্যাচ। ১০২ বছরে পড়েছে মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল, ঘটি বাঙাল, ইলিশ চিংড়ির মহারণ। নানান গল্প আবেগে মোড়া বাঙালির এই আত্মপরিচয়ের খেলা শতবর্ষ পেরিয়ে এসেও সমান জনপ্রিয়। আত্মবিস্মৃত, ইতিহাসবিমুখ ইত্যাদি শব্দ আজ বাঙালির কপালে জুটেছে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্র আছে, যেখানে বাঙালি আত্মবিস্মৃত বা ইতিহাসবিমুখ নয়। পিওরিটি বা বিশুদ্ধতার দিক থেকে বাঙালির এই বড় ম্যাচ কিন্তু যেকোনো জনপ্রিয় উৎসবকেও হার মানাবে। এবং এটা কালে কালে হয়ে আসছে বলেই আজকের বড় ম্যাচের দুটো দিন আগে অন্য রকম এক ছবি দেখা গেল ময়দানে, গোষ্ঠ পাল সরণির মোহনবাগান মাঠে। ১০ আগস্ট ছিল কলকাতা লিগের মোহনবাগান বনাম এফসিআই ম্যাচ। এবারের কলকাতা লিগে রিজার্ভ দল খেলাচ্ছে মোহনবাগান। বিদেশি-বিহীন লিগ খেলানোর নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। যদিও এতে উন্মাদনায় ভাটা পড়েনি। মোহনবাগান ম্যাচগুলিতে ভিড় উপচে পড়েছে গ্যালারিতে। অথচ এফসিআই-এর বিরুদ্ধে ম্যাচে গ্যালারিতে দেখা গেল অন্য চিত্র। সদস্য গ্যালারি কিংবা অসদস্য গ্যালারি কোনোটাই ভরল না। গ্যালারি থেকে সমর্থকরা কেউ গাইলেন না প্রিয় দলকে উদ্বুদ্ধ করবার গানও। অথচ মোহনবাগান মাঠের ঠিক বাইরেই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে কাতারে কাতারে সমর্থক। প্রিয় দলের খেলা চলছে। মাঠে লোক কম। মাঠের বাইরে হাজারো। এমন দৃশ্য জন্মাবধি দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
আজ, ১২ তারিখের বড় ম্যাচ মাঠে গিয়ে দেখার জন্য বহুদিন পরে বড় ম্যাচের টিকিট কিনতে নাজেহাল হয়েছেন কলকাতার ফুটবল দর্শক। মরশুমের প্রথম বড় ম্যাচ। শনিবার, বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ডুরান্ড কাপের গ্রুপ ‘এ’ ম্যাচে জুয়ান ফেরান্দোর মোহনবাগান মুখোমুখি হবে কার্লোস কুয়াদ্রাতের ইস্টবেঙ্গলের। সমর্থকদের দীর্ঘ আক্রোশের পরে মোহনবাগান নামের আগে ‘ATK’ শব্দটি আজ আর নেই। এটিকে উঠে যাওয়ার পর এটাই প্রথম ডার্বি। তাই এবার উন্মাদনা বাঁধ ভেঙেছে। দুই দলের সমর্থকরা খুবই উত্তেজিত। যদিও এমন হাই ভোল্টেজ ম্যাচের মাত্র দু-দিন আগে থেকে টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে। আজ, ম্যাচের দিন দুপুর পর্যন্ত চলবে এই টিকিট বিক্রি। সমর্থকরা ভোররাত থেকে প্রিয় দলের তাঁবুর সামনে জড়ো হয়েছেন। ক্লাব তাঁবুর রাত্রিযাপন পর্যন্ত করেছেন তাঁরা। অনেকেই আবার আজ নিয়ে টানা চারদিন ভোরবেলায় ময়দানে হাজির হয়েছেন মাত্র একটি টিকিটের আশায়। তার মধ্যে প্রথম দিন অর্থাৎ ৯ আগস্ট ভোরবেলায় দুই ক্লাবের তাঁবুতে হাজার হাজার লোক টিকিট কাটতে পৌঁছে গিয়েছিলেন শুধুমাত্র হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি সূত্রে খবর পেয়ে। আগে আসবে যে টিকিট পাবে সে, ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভের সেই চিরাচরিত নীতির খপ্পরে তাঁরাও পড়েছেন। কিন্তু এতসব আয়োজনের পরেও টিকিট নিয়ে সমস্যা কাটেনি। বরং বেড়েছে অসন্তোষ, বিক্ষিপ্ত বিক্ষোভও।
বুধবার (৮ আগস্ট) রাতে ডুরান্ড কমিটি একটি মিটিং ডাকে। সেখানে প্রাথমিকভাবে ঠিক হয়, তাঁবু থেকে সরাসরি বিক্রির জন্য মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলকে পাঁচ হাজার করে টিকিট দেওয়া হবে। কিন্তু দুই ক্লাবই এই শর্তে রাজি হয়নি। তাই আয়োজক কমিটি সিদ্ধান্ত বদল করে। দুই ক্লাবের ময়দানের তাঁবু থেকে বিক্রির জন্য ১৫ হাজার করে টিকিট বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এদিকে, ডুরান্ড কমিটি তাদের অনলাইন টিকিট পার্টনার BookMyShow-এ টিকিট বিক্রির সিদ্ধান্ত বাতিল করে। কিন্তু ম্যাচের জন্য আয়োজক কমিটির মাত্র ৩০ হাজার টিকিট ছাড়ার সিদ্ধান্তে ভক্তরা যারপরনাই হতাশ। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে দর্শকাসন ৬৫ হাজারের মতো। সমর্থকদের অনেকেরই প্রশ্ন, বাকি টিকিট কোথায়? বড় ম্যাচ তো কলকাতা তথা ভারতীয় ফুটবলের উত্তরাধিকার। অথচ ডুরান্ড কমিটির এমন সিদ্ধান্তে বহু সমর্থকই কিন্তু বহু কাঙ্ক্ষিত সেই টিকিট হাতে পাবেন না। ‘দাদা টিকিট চাই! একটা অন্তত টিকিট দেবেন প্লিজ’— খেলার সময় যত ঘনিয়ে আসবে, এমন দীর্ঘশ্বাসও কি তত বাড়তে চলেছে আজ? আজকের ডার্বির মাত্র চারদিন বাদে সেই অভিশপ্ত তারিখ। ১৬ আগস্ট। ভয় হয় এটাই টিকিট বিক্রি নিয়ে এত হট্টগোল আবার আরেকটি ১৬ আগস্ট ডেকে আনবে না তো! বিশৃঙ্খলাকে উন্মাদনার মোড়কে আপাতত চালান করে দেওয়া যায় বটে, কিন্তু পচন ধরলে কী হবে, সেটাই ভাববার। ভীষণভাবে ভাববার।
ছবি: শুভ্রাংশু রায়ের ফেসবুক ওয়াল থেকে
Powered by Froala Editor