তুহিন মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৫৩ সালে, কলকাতায়। শৈশব থেকেই রিষড়ার স্থায়ী বাসিন্দা। ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। বর্তমান ঈর্ষাক্ষাৎকারটি তাঁর ‘চৈতন্যের শেষ প্রহর’-কে (প্রকাশ ২০১৬) কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। কথোপকথনে তুহিন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গী তন্ময় ভট্টাচার্য। আজ দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব...
(প্রথম পর্বের পর)
তন্ময়— আপনি নিজেই বলেছেন, আপনার যে তত্ত্ব, সেটি অনুমান-নির্ভর। বাকি তত্ত্বগুলো সম্ভাবনার দিক থেকে কেন অসম্ভব— তা-ও যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন। কিন্তু আপনার অনুমান যদি ভ্রান্ত হয়, তাহলে অবশিষ্ট তত্ত্বগুলোর মধ্যে কোনটি সবচেয়ে সম্ভাবনাময় বলে মনে হয়?
তুহিন মুখোপাধ্যায়— একটাও সম্ভাবনাময় বলে মনে হয় না।
তন্ময়— তার মানে আপনার মতে পায়ে ইটের আঘাত লাগা বা গুপ্তহত্যা— এই প্রত্যেকটা তত্ত্বই অসার…
তুহিন মুখোপাধ্যায়— দেখুন, একদিক থেকে দেখতে গেলে এই যে তাঁকে চুড়ঙ্গগড় দুর্গে বন্দি করে রাখা এগারো মাস ধরে এবং সেখানেই তাঁর মারা যাওয়া— আদতে এটাকে তো গুপ্তহত্যাও বলা যেতে পারে। গুমখুন যাকে বলা হয়। সেই অর্থে দেখতে গেলে গুপ্তহত্যা শব্দটাই অর্থবহ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু স্থানটা বদলে যাবে। অর্থাৎ সেটা জগন্নাথ মন্দিরও নয়, গুণ্ডিচাও নয়। জগন্নাথ মন্দির থেকে তাঁকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। অন্তর্ধানের প্রেক্ষিতে আমার গবেষণা কৃষ্ণদাস কবিরাজকে অবলম্বন করে। সেখানে যে-টাইমটা দেখা যায়, সেটা হল বৈশাখের শেষ। কিন্তু দুটো মন্দিরের কোনো জায়গাতেই তাঁকে হত্যা করা হয়নি, সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : অঞ্জন সেন— প্রথম পর্ব
তন্ময়— টোটা গোপীনাথে যে তাঁর সমাধি থাকার একটা সম্ভবনার কথা উঠে আসে, সেটা? মালিবুড়ো সম্ভবত এই তত্ত্বে আস্থা রেখেছিলেন।
তুহিন মুখোপাধ্যায়— মালিবুড়ো এটা শুনেছেন বলে দাবি করেন সদাশিব রথশর্মার কাছ থেকে। যিনি পদ্মশ্রী পেয়েছিলেন একসময়, ওড়িশা থেকে। তিনি বলেছিলেন, কয়েকটা ছোটো ছোটো মন্দির টাইপের তুলসীমঞ্চ আছে টোটা গোপীনাথের চত্বরে, তার গোড়ায় নাকি সমাধি আছে। উনি এটা নিয়ে বলেছিলেন কিন্তু কোনো কংক্রিট এভিডেন্স দেননি। আগে টোটা গোপীনাথ মন্দির মাটির ছিল। সেটা যখন পাকা করতে যাওয়া হয়, তখন তার ভিত খুঁড়তে গিয়ে শক্ত কিছুতে কোদাল আটকে গিয়েছিল। তা সেই শক্ত কিছুটা হয়তো চৈতন্যের সমাধির ওপরের ঢাকনা হতে পারে— এরকম একটা তত্ত্ব ছিল, তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। পরেও কোনোরকম আভাস-ইঙ্গিত নেই। ওই জায়গাতেই কেন? তার তো একটা ব্যাখ্যা থাকবে। যেমন ধরুন গুণ্ডিচা বা জগন্নাথ মন্দিরের ক্ষেত্রে একটা ব্যাখ্যা তবু আছে, যে, চৈতন্যকে ছকবাজি করে ওখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অথবা এরা অনেকদিন তক্কে-তক্কে ছিল, তিনি যখন আবেগের বশে ওখানে গেছেন, তখন মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে ভেতরে মেরে দিল। টোটা গোপীনাথে সেই সম্ভাবনা কোনো দিক থেকেই পাওয়া যায় না। এবং ওই অঞ্চলটায় যদি গিয়ে থাকেন বুঝবেন, টোটা গোপীনাথের আশেপাশের অঞ্চলে প্রচুর বোল্ডার রয়েছে লোকজনের বাড়ির খোলা জায়গাতেও। কাজেই বাড়ির ভিত খুঁড়তে গিয়ে শক্ত কিছুতে কোদাল আটকানো— সেটা যে নিছক কোনো বোল্ডার ছিল না, এটা কে বলবে?
তন্ময়— আচ্ছা, এখানে একটা কথা বলছি, আপনি ভালো বলতে পারবেন। কোথায় পড়েছিলাম মনে পড়ছে না। কিন্তু টোটা গোপীনাথ থেকে নাকি একসময় ছ-ফুটের বেশি লম্বা একটা কঙ্কাল আবিষ্কৃত হয়েছিল…
তুহিন মুখোপাধ্যায়— না, টোটা গোপীনাথ থেকে নয়। যেটা বলা হয়, সেটা নাকি কিছু খবরের কাগজে বেরিয়েছিল। এবং এটা ফেসবুকে একজন লিখেছিলেন, সেখান থেকে পড়েছিলাম। কোন কাগজের কোন সংখ্যায় এটা পাওয়া যাবে খবরটা, তার উল্লেখ করেননি। বা তিনি এরকমটা বলেছেন যে, আনন্দবাজারে বেরিয়েছিল অমুক বছরে। যদি বেরিয়েই থাকে, তাহলে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে— আনন্দবাজারের আর্কাইভে প্রথম সংখ্যা থেকে শুরু করে প্রতিটা সংখ্যা রাখা আছে— এবং তিনি যে-বছরের যে-মাসের কথা বলতে চাইছেন, সেটা ওদের কাছে বললে সঙ্গে সঙ্গে সেটা বার করে দেবে। উনি কিন্তু সেটা করেননি। আর এটার সম্পর্কেও সেই একই কথা। পরবর্তীকালে এগুলো নিয়ে কোনো খোঁজখবর পাওয়া যায়নি। এবং পুলিশি রিপোর্ট অনুযায়ী বলা হয়, এরকম কিছু হয়নি। যদিও একটি ছেলে আমাকে বলেছিল যে, ওইটা যিনি— মানে যে-ফরেন্সিক ডাক্তার ওটা দেখেছিলেন বা ঘেঁটেছিলেন, তাঁর সঙ্গে তার কথা হয়েছে কিন্তু কোনো ডিটেলস তিনি নিতে পারেননি।
এবং ওই একই যুক্তিতে— যে-যুক্তিতে আমি জগন্নাথ মন্দিরের ভেতরে কাউকে হত্যা করাকে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি, সেই একই যুক্তিতে ওখানে ওই কঙ্কালও আসতে পারে না। কাউকে হত্যা করে ওখানে পুঁতে দেওয়া সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : অঞ্জন সেন— দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— বুঝেছি। শোধন বা মন্দিরের মধ্যে ব্রহ্মহত্যা ইত্যাদি বিষয়ের কারণে… আমার পরের প্রশ্ন হচ্ছে, চৈতন্য প্রায় পঁচিশ বছর বাংলা ছাড়া। ১৫০৯-এ চলে গেলেন, তারপর ১৫৩৩ বা ’৩৪-এ দেহান্ত। চৈতন্যের মৃত্যুর পরে, তাঁর মৃত্যু বা অন্তর্ধানের প্রভাব বাংলায় কীভাবে পড়েছিল?
তুহিন মুখোপাধ্যায়— দেখুন, কতকগুলো প্রভাব তো পড়েইছিল। বৃন্দাবনের সঙ্গে বাংলার যথেষ্ট বিরোধ থাকা সত্ত্বেও একটা জায়গাতে তারা এক হয়ে গিয়েছিল। সেটা হল চৈতন্যের অন্তর্ধানকে নিয়ে। বৃন্দাবন থেকে চেষ্টা করা হয়েছিল যে প্রকৃত সত্য যাতে গোপন থাকে। আর বাংলাতেও প্রকৃত সত্যকে গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। বৃন্দাবন প্রচণ্ড শক্তিশালী কেন্দ্র ছিল সে-সময়। তবে বৃন্দাবনের সঙ্গে বাংলার কিছু দার্শনিক মতভেদ ছিল। সেটা চৈতন্যকেও নিয়েও বটে, আবার রাধাকে নিয়েও। সেটা আলোচনার জায়গা এটা নয়। পরে কখনও এই বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হতে পারে। যাই হোক, উভয়ের মধ্যে বিরোধ ছিল। কিন্তু এই চৈতন্য-অন্তর্ধানের প্রসঙ্গে দু-পক্ষই একমত ছিল। সেটা হচ্ছে, চৈতন্যের অন্তর্ধান বা মৃত্যু— যেটাই বলুন না কেন, সেটার প্রকৃত সত্য যেন প্রকাশ না-পায়। যেমন আমি বলি আপনাকে, কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’— এটা কিন্তু বৃন্দাবনেই লেখা হয়েছিল সে-সময়। সেখানে কৃষ্ণদাস কবিরাজ আশ্বাস দিয়েছিলেন চৈতন্যের কী হয়েছিল, সেটা তিনি জানাবেন। কিন্তু সেই বর্ণনা নেই। তিনি লেখেননি।
প্রথম কথা হচ্ছে, কৃষ্ণদাস কবিরাজ লেখেননি না তাঁকে লিখতে দেওয়া হয়নি— এই প্রশ্ন আসে। বাংলায় কিন্তু একটা কথা চলে বৈষ্ণব মহলে। চৈতন্যচরিতামৃতকে বৃন্দাবনের গোস্বামীরা কিন্তু প্রাথমিকভাবে অনুমোদন দেননি। পরবর্তীকালে নাকি আলৌকিকভাবে— আরও কিছু বইয়ের নিচে রাখা ছিল, সেই বই উপরে উঠে আসে। তখন বলা হয়, এই বইটায় অন্যরকম ব্যাপার আছে, তাহলে এটাকে অনুমোদন দেওয়া হোক। বৃন্দাবনে যখন জীব গোস্বামী ছিলেন, তাঁর সময়ের ব্যাপার।
এবার দ্বিতীয় কথা আসি। ধরুন, স্বরূপ দামোদরের কড়চা। চৈতন্যের অন্তর্ধানের পর যখন রঘুনাথ দাস— যাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন স্বরূপ দামোদর— তিনি যখন বৃন্দাবনে চলে গেলেন, তখন স্বরূপ দামোদরের কড়চাও তাঁর সঙ্গে বৃন্দাবনে গেল। এই পর্যন্ত জানা যায়। এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজ সেটা দেখেছিলেন এবং একাধিক জায়গায় তার থেকে কিছু কিছু উদ্ধৃতিও আছে। স্বরূপ দামোদরের কড়চা— যেটা কিন্তু চৈতন্যের অন্তর্ধানের পরে শেষ হয়েছিল— সেটা লোপাট হয়ে গেল কীভাবে বৃন্দাবন থেকে?
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— প্রথম পর্ব
তন্ময়— আচ্ছা, এখানে আপনাকে আরেকবার বাধা দিচ্ছি। আপনি বললেন চৈতন্যের অন্তর্ধানের পরে স্বরূপ দামোদরের কড়চা শেষ হয়েছিল। কিন্তু চৈতন্যের অব্যবহৃত পরেই তো দামোদরও নিখোঁজ হন!
তুহিন মুখোপাধ্যায়— হ্যাঁ, কয়েকদিন বাদে। চৈতন্যের অন্তর্ধানের পর যখন কিছু আলাপ-আলোচনা চলছে যে, ওঁকে বৃন্দাবনে পৌঁছে দেওয়া হবে, উনি আর ওড়িশাতে ঢুকবেন না ইত্যাদি ইত্যাদি, এগুলো স্বরূপ জানতেন। অর্থাৎ তথ্য আছে সেখানে। এবং স্বরূপকে কয়েকদিন বাদে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ঠিক পরের দিন নয়। কাজেই তাঁর কড়চায় কিছু তথ্য বা ইঙ্গিত ডেফিনিটলি ছিল। সেই কড়চা লোপাট হয়ে গেল কীভাবে? আজও তো তার পুথি পাওয়া যায়নি। বাংলাতে মুরারি গুপ্তের কড়চা— যেটা সংস্কৃতে লেখা হয়েছিল। চৈতন্যের অন্তর্ধানের পর সবচেয়ে আগে লেখা হয়েছিল এই বইটা, বাকি সব বই পরে। এবং এটা যখন লেখা হয়, সেইসময়ে চৈতন্যের সমসাময়িক মানুষজন বেঁচে আছেন। যেমন, অনেকে ওড়িশা থেকে চলে এসেছেন এবং তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এই বইটা লেখা। এই বইটার মূল পুথিও আজ অবধি পাওয়া যায়নি। এবং তার বদলে যেটা রেকমেন্ড করা হয়েছে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের তরফ থেকে সেটা হচ্ছে, উনি তো অবতার ছিলেন, অবতারের ওভাবে মৃত্যু হয় না। অবতার অন্তর্হিত হন, মিলিয়ে যান। এই জায়গাটায় কিন্তু দুই তরফ থেকেই সম্পূর্ণ চেপে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছে, গোপন করার চেষ্টা হয়েছে।
তন্ময়— চৈতন্যের মৃত্যুতে সাধারণ মানুষকে জগন্নাথে লীন হওয়া বা সমুদ্রে ডুবে যাওয়া ইত্যাদি তত্ত্ব গেলানো সম্ভব হলেও, একইসঙ্গে যে স্বরূপ দামোদর বা গদাধর পণ্ডিতেরও অন্তর্ধান হল— এঁরা তো বাংলার বৈষ্ণব সমাজের নেতৃস্থানীয় ছিলেন, তাঁদের অনুপস্থিতিকে কেন্দ্র করে বঙ্গীয় মহলে কোনো চাঞ্চল্য ওঠেনি বা চর্চা হয়নি?
তুহিন মুখোপাধ্যায়— দুটো জিনিস বলি আপনাকে। স্বরূপ দামোদরকে যে পঞ্চতত্বের এক তত্ত্ব হিসাবে ধরা হল, পশ্চিমবাংলায়— মানে পশ্চিমবাংলা বলা ভুল হবে, বাংলাতে স্বরূপ দামোদর কিন্তু খুব বড়ো কেউ ছিলেন না। স্বরূপ দামোদর কোনোদিনই সেভাবে বাংলাতে কিছু কাজকর্ম করেননি বা ছিলেন না। উনি বাংলা থেকে সরে গিয়েছিলেন। এবং বেনারস বা এরকম কোনো একটা তীর্থ ঘুরে-টুরে তারপর তিনি পুরীতে চৈতন্যের সঙ্গে দেখা করেন এবং ভিড়ে যান তাঁর সঙ্গে। এবং চৈতন্য যে-সময়ে বাংলায় ভক্তি আন্দোলন গড়ে তুলছেন, তিনি খুব কম দিনই চৈতন্যের সঙ্গে, বাংলার ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে ছিলেন। ফলে, স্বরূপ দামোদর যখন বাংলাতে ছিলেন, সেভাবে ওঁকে কোনোদিন ফিল্ডে দেখা যায়নি। কাজেই আকর গ্রন্থগুলোতে সেভাবে তাঁর উল্লেখ পাওয়া যায় না। এবং চৈতন্য সন্ন্যাস নিয়ে চলে যাওয়ার পর পরই উনি বেনারস চলে যান, যতদূর মনে পড়ছে আমার। তারপর তিনি চৈতন্যের সঙ্গে আবার দেখা করেন পুরীতে গিয়ে। ফলে, বাংলায় তাঁর ততটা প্রভাব ছিল না কোনোকালেই। দ্বিতীয় ব্যক্তি হলেন গদাধর। গদাধরও চৈতন্য নীলাচলে চলে যাওয়ার পরে পরেই নীলাচলে চলে যান। অবশ্য সেটা নিয়ে দ্বিমত আছে। কেউ বলেন সঙ্গে গিয়েছিলেন, কেউ বলেন খানিক পরে গিয়েছিলেন। এবং সেখানে ক্ষেত্রসন্ন্যাস নিয়ে বাস করতে আরম্ভ করেন। অর্থাৎ, উনি নীলাচলের বাইরে যাবেন না। সেই অর্থে গদাধর পণ্ডিত বা তাঁর পন্থীদেরও বাংলায় পরবর্তীকালে কোনো শক্তপোক্ত খুঁটি ছিল না। অবশ্য প্রথমদিকে একটা প্রভাবের জায়গা ছিল। কারণ, গৌর-নিতাইয়ের মূর্তির আগে কিন্তু বহু জায়গাতে গদাই-গৌরাঙ্গের মূর্তির আরাধনা করা হত।
পরবর্তীতে যখন নিত্যানন্দের প্রভাব প্রচণ্ডভাবে বাড়তে আরম্ভ করল এবং গদাধরের অনুপস্থিতি— তখন দেখা গেল এখানে গদাধর পণ্ডিতের প্রভাবটা ক্রমশ এখানে কমতে শুরু করেছে। এবং চৈতন্যের জীবদ্দশাতেই যখন বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলোর খেয়োখেয়ি আরম্ভ হচ্ছে— দুর্ভাগ্যজনক হলেও কিন্তু ঘটেছিল, তখন কিন্তু গদাধর গোষ্ঠী ক্রমশ দুর্বল হতে আরম্ভ করে। এঁদের দু-জনের অন্তর্ধান নিশ্চয়ই কিছু মানুষকে নাড়া দিয়েছিল কিন্তু বড়ো কোনো প্রভাব বাংলাতে ফেলেনি।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : শুভদীপ চক্রবর্ত্তী— দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— আমার পরের যে-প্রশ্ন, সেটা হয়তো চৈতন্যকেন্দ্রিক কিন্তু এই অন্তর্ধান-প্রসঙ্গ থেকে খানিকটা দূরের। ধর্ম ও রাজনীতির মিশ্রণের বর্তমান সংজ্ঞা এবং তার প্রয়োগ যথেষ্ট গোলমেলে ও বিতর্কিত। কিন্তু ওড়িশার তৎকালীন রাজনীতির প্রেক্ষাপটে চৈতন্য কি ধর্মকে রাজনীতির অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন?
তুহিন মুখোপাধ্যায়— এই সম্বন্ধে তথ্যের বাইরে গিয়ে আলোচনা করতে চাই না। চৈতন্য রাজনীতির মধ্যে একার্থেই ঢুকেছিলেন। কারণ তিনি চেয়েছিলেন, প্রতাপরুদ্রের শাসন বা সিংহাসনটা টিকে থাকার প্রয়োজন আছে। কেন? না, তিনি যে মতটার প্রচার করছিলেন বা যে-মতটা বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল— তার জন্য প্রতাপরুদ্র যে প্ল্যাটফর্মটা তৈরি করে দিয়েছিলেন ভক্তি আন্দোলনের স্বার্থেই সেটার প্রয়োজন ছিল। আমি বলতে চাইছি, চৈতন্য যে ভক্তি আন্দোলন গড়ে তুলছিলেন, সেখানে একটা বড়ো প্ল্যাটফর্মের দরকার ছিল। সিকিউরিটি এবং প্ল্যাটফর্ম— উভয় দিক থেকেই। যে-রোলটা প্রতাপরুদ্র প্লে করছিলেন। বিভিন্ন কারণে। সেখানে প্রতাপ রুদ্রের রাজনৈতিক স্বার্থও ছিল, শুধুই ভক্তি ছিল না। পরবর্তীকালে অবশ্য তাঁর ভক্তিটাই প্রধান হয়ে উঠেছিল, কিন্তু প্রাথমিকভাবে রাজনৈতিক স্বার্থই ছিল। যেটা চৈতন্যের ক্ষেত্রে তখন ছিল না। কিন্তু এই প্ল্যাটফর্মটাকে উনি ভীষণ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এত জায়গা থাকতে উনি নীলাচল বেছে নিয়েছিলেন সন্ন্যাসের পর, তার কিন্তু একটা বড়ো কারণ ছিল ওখানে প্রতাপ রুদ্রের প্ল্যাটফর্মটা পাওয়া যেতে পারে। সার্বভৌমের সাহায্যও। সার্বভৌমের সঙ্গে চৈতন্যের আত্মীয়দের যোগাযোগ ছিল এবং সার্বভৌমের সঙ্গে চৈতন্যের বাবার একটা সম্পর্ক ছিল। ভক্তি আন্দোলনের স্বার্থে প্রতাপরুদ্রের সিংহাসন টিকিয়ে রাখাটা প্রয়োজন। ফলে সেটাকে তো রাজনৈতিক কাজ বলা যেতে পারে।
খেয়াল করে দেখুন, যে-সময়ে চৈতন্য ‘প্রতাপরুদ্র-সংত্রাতা’ নাম পাচ্ছেন, অর্থাৎ প্রতাপরুদ্রের রক্ষাকর্তা, তার আগের ঘটনা কী? সেটা হচ্ছে, প্রতাপরুদ্র আগ বাড়িয়ে হোসেন শাহকে আক্রমণ করতে যাচ্ছিলেন। সে-সময় চৈতন্য এই বলে বাধা দেন যে কী করতে যাচ্ছ, মরতে যাচ্ছ? কারণ, চৈতন্যের কাছে খবর ছিল, হোসেন শাহ তখন এতটাই শক্তিশালী যে ওঁর সঙ্গে প্রতাপরুদ্র আগ বাড়িয়ে লড়তে গেলে হেরে যাবেন। এবার এই খবরগুলো কোথা থেকে আসত? সেটা হচ্ছে, চৈতন্য যখন প্রথমবার বৃন্দাবন যাবেন বলে বেরিয়েছিলেন এবং রামকেলি থেকে ফিরে আসেন, তখন কিন্তু রূপ এবং সনাতন— তখনকার দবীর খাস ও সাকর মল্লিক— ছদ্মবেশে ওঁর সঙ্গে দেখা করেন। গভীররাতে চাদর মুড়ি দিয়ে। এঁদের সঙ্গে চৈতন্যের আগে থেকে কিছু চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিল। এটা কৃষ্ণদাস কবিরাজের লেখায় পাওয়া যায়। এখন এঁরা যেহেতু হোসেন শাহের ডান হাত, বাঁ হাত— ফলে হোসেন শাহ কখন শক্তিশালী, কখন তিনি দুর্বল, কোথায় দুর্বল, কেন দুর্বল— এই তথ্যগুলো ক্রমশ আসতে থাকত তাঁর কাছে। সেই কারণেই প্রতাপরুদ্রকে তিনি যেতে দেননি যুদ্ধে। উল্টোদিকে চৈতন্য রামকেলি থেকে ব্যাক করলেন, বৃন্দাবন না-গিয়ে। একটা লেম এক্সকিউজ দিলেন যে এত লোকজন নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। চাইলে উনি একাই যেতে পারতেন। তার প্রমাণ হল উনি একাধিকবার বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন। গৌড়ভ্রমণের সময়ে তিনি একা গেছেন, দাক্ষিণাত্যে গিয়েছেন, সন্ন্যাস গ্রহণের সময় গিয়েছেন, রাঢ়ে একা একা ঘুরে বেড়িয়েছেন— ফলে এটা কোনো কারণই নয়। উনি যেন ওখানে যাবেন বলেই বেরিয়েছিলেন এবং ওখান থেকেই তাই ফিরে আসেন। এবং উনি চলে আসার পরেই রূপ-সনাতনের একজন চলে গেলেন বৃন্দাবনের দিকে, আরেকজন যেটা করলেন সেটা হচ্ছে, দেশের বাড়ি গিয়ে বসে থাকলেন। হোসেন শাহ গিয়ে তাঁর কাছে নানান অনুরোধ করল কিন্তু তিনি বললেন ভালো লাগছে না। তাঁকে জেলে পুরেছিল কিন্তু ঘুষ দিয়ে তিনি বেরিয়ে এলেন। বেনারসে চলে গেলেন। এবার হোসেন শাহের ডান হাত, বাঁ হাত দুটো ভেঙে যাওয়ার জন্য যেটা হল, আবার যখন উনি ওড়িশা আক্রমণ করলেন, তখন সেটাই হয়ে গেল তাঁর শেষ ওড়িশা-যুদ্ধ। কাজেই এভাবে হোসেন শাহকে দুর্বল করে দেওয়া, তাঁর ভেতরকার খবর জোগাড় করে দেওয়া, রূপ ও সনাতনকে সাইফার করে দেওয়া— এগুলো তো ডেফিনিটলি রাজনৈতিক কাজ। কাজেই কিছু পরিমানে তো উনি রাজনীতির মধ্যে ঢুকেছিলেন।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সোমা মুখোপাধ্যায়— প্রথম পর্ব
তন্ময়— চৈতন্যের জীবনী তো বাংলার কবিরাও লিখেছেন, ওড়িয়া কবিরাও লিখেছেন। আমার যেটা কৌতূহল সেটা হচ্ছে, চৈতন্য ওড়িশার কথোপকথনের জন্য কী ভাষা ব্যবহার করতেন? বাংলা নাকি ওড়িয়া? এ-বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়?
তুহিন মুখোপাধ্যায়— দুটো কথা বলি। একটা হচ্ছে, বাংলাতে চৈতন্যের যে-জীবনীগুলো লেখা হয়েছে, মানে আকরগ্রন্থগুলো, তাতে কোনো জায়গায় এটা পাওয়া যায়নি যে তাঁরা কোন ভাষায় ওড়িশার মানুষদের সঙ্গে কমিউনিকেট করতেন। সংস্কৃতে যেগুলো লেখা হয়েছে বাংলা ছাড়াও, তাতেও এরকম কিছু পাইনি। বরং মনে হয়েছে, প্রতাপরুদ্রের সঙ্গে সংস্কৃতেরও কিছু একটা সম্পর্ক ছিল। কারণ, কবিকর্ণপুর চৈতন্যের ওপর যে-দুটো নাটক লেখেন, একটা নাটক, আরেকটা মহাকাব্য— যেটা প্রতাপরুদ্রের সামনে অভিনীত হয়েছিল, সেটা কিন্তু সংস্কৃতে লেখা। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, চৈতন্য সম্ভবত ওড়িয়া জানতেন। এবং এটা মনে হওয়ার কারণ হল, একটা অভিমত আছে যে চৈতন্যের পূর্বপুরুষ সম্ভবত ওড়িশার বাসিন্দা ছিলেন। সেখান থেকে শ্রীহট্টে চলে আসেন। পরবর্তীতে সেখান থেকেই নবদ্বীপে যান। এবং এই মতটার মধ্যে যদি বিন্দুমাত্র সত্যতা থাকে— একদম অসম্ভব নয় কিন্তু সত্যতা থাকার— তাতে চৈতন্য ওড়িয়া ভাষা অল্পস্বল্প জানতেন। উনি প্রচণ্ড ধী-শক্তিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। এবং বাংলার সঙ্গে ওড়িয়ার প্রচুর মিল আছে। আপনি ওড়িয়া শুনলে দেখবেন, ৮০ শতাংশ কথাই আপনি বুঝতে পারছেন। মানে অর্থ বুঝতে পারছেন। ফলে বাংলা থেকে যাওয়া কোনো মানুষ, বিশেষ করে ওইরকম ধী-শক্তিসম্পন্ন কোনো মানুষ, মেধাসম্পন্ন মানুষ— তাঁর পক্ষে ওড়িয়া বুঝে নেওয়া বা শিখে নেওয়া খুব একটা কঠিন কিছু ছিল না। কাজেই আমার মনে হয়েছে উনি ওড়িয়াতেই কমিউনিকেট করতেন। এবার রাজার সঙ্গে হয়তো কখনও সংস্কৃতে কথা বলতেন, কখনও ওড়িয়ায়।
তন্ময়— ওড়িয়ার সাহিত্যগুলোতেও এই বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেই?
তুহিন মুখোপাধ্যায়— ওড়িয়া সাহিত্যে চৈতন্য-জীবনী গোত্রীয় যেটুকু ব্যাপার এসেছে, সেগুলো ওড়িয়াতেই লেখা। এবং তার সংখ্যা খুবই কম। সেখানে কথোপকথনও ওড়িয়াতেই লেখা। চৈতন্যের জীবনী হিসাবে খুব কম সংখ্যাতেই এইসব লেখা হয়েছে। বেশিরভাগই অন্য বিভিন্ন লেখার মধ্যে চৈতন্যের কথা এসেছে। সেগুলোতে কিন্তু চৈতন্য সম্পর্কে যেটুকু যা বর্ণনা আছে এবং কথোপকথন আছে— সবই ওড়িয়াতে লেখা।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সোমা মুখোপাধ্যায়— দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— আপনি হুগলি জেলার মানুষ। আমি গঙ্গা তীরবর্তী জনপদ নিয়ে কাজ করার সময় দেখেছি যে গঙ্গা তীরবর্তী হুগলি এবং হাওড়া জেলার অনেক জনপদ আছে— ধরুন, আন্দুল কিংবা নিমাইতীর্থ ঘাট ইত্যাদি— যেগুলি নিয়ে প্রচলিত আছে চৈতন্য ওই পথ দিয়ে গিয়েছিলেন বা ওখানে গিয়েছিলেন এবং সেখানে চৈতন্যের পদধূলি পড়েছিল। কিন্তু চৈতন্যচরিত কাব্যগুলো দেখলে ত্রিবেণী ছাড়া হুগলির আর কোনো জায়গায় চৈতন্যের যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় না। হিতেশরঞ্জন সান্যালও তাঁর ‘বাঙ্গালা কীর্তনের ইতিহাস’-এ এ-কথাটাই বলেছেন যে, প্রচলিত আছে কিন্তু কোনো প্রত্যক্ষ বা লিখিত প্রমাণ নেই এই ব্যাপারে। আপনার কী মত এই বিষয়ে?
তুহিন মুখোপাধ্যায়— দেখুন আমার যেটা মনে হয়েছে এই সম্পর্কে, সেটা হচ্ছে, লোককথা যেমন ইতিহাস নয়, তেমনই ইতিহাসের যোগাযোগ ছাড়া লোককথা চট করে তৈরি হয় না। আমি কি ঠিক বোঝাতে পারছি ব্যাপারটা? ইতিহাসের সঙ্গে কোনো-না-কোনো একটা সম্পর্ক না-থাকলে একটা লোককথা তৈরি হয় না। অর্থাৎ, তার মধ্যে ইতিহাসের উপাদানও থাকে। এবার চৈতন্য যখন ওড়িশায় যান কিংবা পরবর্তী সময়ে যখন গৌড় ভ্রমণে যান বা বাংলায় আসেন, তখন তাঁর যাত্রাপথ সম্পর্কে কিন্তু আকর চরিতগ্রন্থগুলির মধ্যেই একাধিক মত আছে। কাজেই এটা ভাবার কোনো কারণ নেই সবটাই বস্তুনিষ্ঠভাবে বিবরণ লেখা হয়েছে। এই যে বিভিন্ন রুটগুলো... জয়ানন্দের বর্ণনার সঙ্গে বৃন্দাবন দাসের ও বৃন্দাবন দাসের সঙ্গে কৃষ্ণরাজ কবিরাজ মেলে না— এই যে তফাৎগুলো হচ্ছে, তাহলে একই জিনিস… ধরুন একটা ঘটনা ঘটছে আর সেটা পাঁচজন দেখছে। পাঁচজন পাঁচভাবে ব্যাপারটা বিশ্লেষণ করতে পারে। কিন্তু কোনো ঐতিহাসিক চরিত্র যখন কোনো একটা রুটে গেল, তখন তো সেটা পাঁচজনের কাছে বদলে যেতে পারে না।
লোককথা অনুযায়ী হাওড়া ও হুগলি জেলায় বিভিন্ন জায়গায় যদি তাঁর পদধূলি পড়ে থাকে, সেটা যে বাস্তবেও হয়েছিল— তার কোনো অর্থ নেই। কিন্তু লেখা হয়নি বলেই ঘটনাগুলোও হয়নি— এমনটা না-ও হতে পারে। যেমন, চাতরাতে একটি মন্দির আছে আমি জানি। এটা ট্রেনে করে যেতে গেলে, শেওড়াফুলি স্টেশন ক্রস করে বৈদ্যবাটির দিকে যেতে ডানদিকে পড়বে। দেখার মতো মন্দির। কামাখ্যা মন্দিরের চূড়াটা যেমন দেখতে, অনেকটা তেমনই। নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না, কিন্তু চৈতন্যের খুব ঘনিষ্ঠ একজন মানুষ ওখানে থাকতেন। এবং ওখানে চৈতন্য এসেছিলেন।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সাধন চট্টোপাধ্যায়— প্রথম পর্ব
তন্ময়— সে তো নিমাইতীর্থ ঘাটই আছে বৈদ্যবাটিতে। সেখানেও চৈতন্যদেব এসেছিলেন বলে শোনা যায়…
তুহিন মুখোপাধ্যায়— আপনি যদি নিমাইতীর্থ ঘাটে আসা এবং চাতরার ওই মন্দিরে আসার ঘটনা দুটোকে দেখেন, তাহলে কিন্তু একটা সত্যি হলে আরেকটা সত্যি হতেই পারে। কারণ, দুটোর মধ্যে দূরত্ব খুব বেশি হলে মাত্র এক-দেড় কিলোমিটারের। কাজেই উল্লেখ নেই বলেই ব্যাপারটা ভুল, এটা না-ও হতে পারে।
তন্ময়— সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা প্রশ্ন করি। চৈতন্যের মৃত্যুর পরে বিষ্ণুপ্রিয়ার জীবন সম্পূর্ণ রহস্যাবৃত। এবং বিষ্ণুপ্রিয়া কীভাবে মারা যান, কত বছর বয়সে মারা যান— এসব ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। বিষ্ণুপ্রিয়ার পরবর্তী জীবন সম্পর্কে আপনার কি কোনো ধারণা বা অভিমত আছে?
তুহিন মুখোপাধ্যায়— কিছু কিছু জানি। এ-ব্যাপারে জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল কিছুটা সাহায্য করে। এবং পরবর্তীকালে সমর্থিত হয়েছে এই তথ্যটা। বিষ্ণুপ্রিয়াকে কেন্দ্র করে একটা সম্প্রদায় গড়ে ওঠে। এবং যাঁদের প্রভাব মণিপুরের পুরোহিত সম্প্রদায়ের মধ্যে পৌঁছেছিল।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : সাধন চট্টোপাধ্যায়— দ্বিতীয় পর্ব
তন্ময়— সেই কারণে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী একটা ভাষা হয়ে উঠেছে।
তুহিন মুখোপাধ্যায়— হ্যাঁ। এবং তাঁকে কেন্দ্র করেই একটা সম্প্রদায় গড়ে ওঠে। তাছাড়া বিষ্ণুপ্রিয়ার যোগাযোগে রসরাজ সম্প্রদায়ের বংশীবদন— যাঁদের সেই বিখ্যাত কিছু গ্রন্থ ‘মুরলীবিলাস’, ‘বংশীশিক্ষা’ ইত্যাদি— বাঘনাপাড়ার যে শ্রীপাট, সেটা কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়া-প্রভাবিত বলে শোনা যায়। এবং বিষ্ণুপ্রিয়া দীর্ঘদিন গুরুমা হিসাবে কাজ করে গেছেন। কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়ার মৃত্যুর ব্যাপারটা আমি ঠিক জানি না। এটা বলতে পারব না। আরেকটা জিনিস যেটা, সেটা হচ্ছে, চৈতন্যের প্রথম মূর্তি বোধহয় নবদ্বীপ অঞ্চলে পুজো করা আরম্ভ করেছিলেন বিষ্ণুপ্রিয়া। কাজেই বিষ্ণুপ্রিয়া খুব সসম্মানে ছিলেন এবং দীর্ঘদিন তাঁর জীবদ্দশাতে তিনি একটি সম্প্রদায়ের নেত্রী হিসাবে কাজ করে গেছেন।
তন্ময়— এবার আমার শেষ প্রশ্ন। শেষ প্রশ্নটা বিস্তৃত একটা ক্যানভাসের প্রশ্ন। সেটা হচ্ছে, চৈতন্যের অন্তর্ধানের যতগুলো সম্ভাব্য কারণ আজ অবধি আলোচিত, আপনি প্রত্যেকটা যুক্তি দিয়ে খণ্ডন করেছেন এবং নিজের একটা হাইপোথিসিস প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমার প্রশ্ন হল, আপনার কি মনে হয় যে চৈতন্য মৃত্যুর রহস্যের কোনোদিন সমাধান হবে প্রকৃতপক্ষে?
তুহিন মুখোপাধ্যায়— না, কোনোদিন সমাধান হবে না এই রহস্যের। তার কারণটা হচ্ছে, এটার সমাধান হতে হলে সরকারি তরফ থেকে যে-উদ্যোগ দরকার, সেই উদ্যোগ এখানে নেই। এটার জন্য ভেরি বিগ পুলিশ অপারেশন হওয়া দরকার। একাধারে ফরেন্সিক এবং গোয়েন্দা দপ্তর— সবটা মিলিয়ে এটা হওয়া দরকার। না-হলে এটা সম্ভব নয়। যার জন্য যে-মতটাই দেখা হোক না কেন— সবটাই সম্ভাব্য। আমিও শেষ করেছি সম্ভাব্যতার জায়গা থেকে, এছাড়া কোনো উপায় নেই। আজকে যখন ইংল্যান্ডে শেক্সপিয়ারের সমাধি খুঁজে পাওয়া যায়, তারা কিন্তু ঠিক সরকারি সাহায্য নিয়ে খুঁজে বার করে কবরটা সত্যি শেক্সপিয়ারেরই কিনা। কিন্তু এটা আমাদের এখানে হয় না। আর আমাদের এখানে আর্কিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টের অবস্থা খুবই খারাপ। আপনাকে জাস্ট একট ছোট্ট তথ্য দিই, বুঝতে পারবেন। হরিহরপুর দুর্গ, যেটাকে শর্টে বলা হয় হরিপুর দুর্গ। ওখানে রসিকরায়ের মন্দির যেটা রয়েছে, বিষ্ণুপুরীয় মন্দিরের মতো অনেকটা গড়ন। ইটের মন্দির। এর তিনটে দেওয়ালের থিকনেস হচ্ছে তিন ফুট চার ইঞ্চি করে।
তন্ময়— আপনি কি হরিপুরগড়ে গিয়েছিলেন?
তুহিন মুখোপাধ্যায়— তখন আমি সময় করে উঠতে পারিনি। কিন্তু ওটার সমস্ত ডিটেলস আমার কাছে আছে। এবং সেটাও ওড়িশারই ঐতিহাসিকরা লিখে গেছেন। তাতেই বলা হচ্ছে, তিনটে দেওয়ালের থিকনেস তিন ফুট চার ইঞ্চি করে। আর পশ্চিমদিক অর্থাৎ পিছনের দিকের দেওয়ালটা— যেখানটায় চৈতন্যের সমাধিক অবশিষ্টাংশ আছে বলে অনুমান করি আমি, সেই দেওয়ালটার থিকনেস সাত ফুটের মতো। এবং শোনা যায় সেখানে একটা গুপ্তকক্ষ আছে। লোকাল জনশ্রুতি আরকি। তাতে নাকি রাজারা সোনা-দানা রাখতেন। সোনাদানাটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ, কালাপাহাড়ে মন্দির আক্রমণ, মন্দির ধ্বংসের পরেও অন্তত ওইভাবে মন্দিরের দেওয়ালে গুপ্তকক্ষ করে সোনাদানা রাখা সম্ভব নয়। তা আমি ভুবনেশ্বর হেডকোয়ার্টার— অর্কিওলজিক্যাল সার্ভেতে, জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনটে দেওয়ালের থিকনেস যা, চতুর্থ দেওয়ালের থিকনেস তার দ্বিগুণ কেন? বলছে আমাদের জানা নেই। আমাদের সাতটা দিন সময় দিন, আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব। সাতদিন বাদে যখন ফোন করলাম তখন বললেন, আপনি তো ঠিকই বলেছেন ওটা তাই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এর কারণ কী? তার উত্তরে বললেন, ওটা হয়তো ভূমিকম্প থেকে বাঁচানোর জন্য। আশ্চর্য যুক্তি! ভূমিকম্প বেছে বেছে ওই দেওয়ালটাকেই ক্ষতিগ্রস্থ করবে আর বাকিগুলোকে করবে না? ভূমিকম্প কি পিন পয়েন্টেড হয়? আমি ’৭১ সালে গিয়ে ওল্ড রাজগীর ঘেরা আছে দেখেছি। নোটিস দিয়ে, কাঁটাতার দিয়ে। তার ৩০ বছর বাদেও গিয়ে আমি দেখেছি একই অবস্থা। এক চামচ মাটি সরানো হয়নি। এই তো আর্কিওলজির অবস্থা আমাদের দেশে।
আরও পড়ুন : ঈর্ষাক্ষাৎকার : তুহিন মুখোপাধ্যায়— প্রথম পর্ব
তন্ময়— মানে কনক্লুশন হচ্ছে, নতুনতর প্রযুক্তি বা নতুনতর প্রজন্মে এই রহস্যের সমাধান হবে বলে মনে হয় না…
তুহিন মুখোপাধ্যায়— না, সমস্যার সমাধান হবে যদি সেইরকম কেস হয়। যেমন রামমন্দিরের নিচে কী ছিল সেটা খুঁড়ে বার করো, জ্ঞানবাপীর নিচে কী ছিল খুঁড়ে বার করো— এইরকম আরকি…
তন্ময়— মানে রাজনৈতিক অভিসন্ধি কোনো জড়ায়, তবেই…
তুহিন মুখোপাধ্যায়— একদমই। আজকে যদি সেন্ট্রালে যারা আছে তারা হোক কিংবা ভবিষ্যতে যে-ই থাকুক না কেন, যদি এমনটা হয় চৈতন্যের সমাধি খুঁজে বার করার ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ আছে, তখন দেখবেন সরকারি ব্যবস্থা নড়ে-চড়ে বসবে। তাতে সত্যিটাই বেরোক বা মিথ্যেটাই বেরোক— কিছু একটা দাঁড় করাবে। তাদের পছন্দসই-ই কিছু একটা দাঁড় করাবে। সত্যি কী পাওয়া গেল, সেটা আমাদের আওতায় আসবে না। তবে নাড়াচাড়া হবে। কিন্তু আমি মনে করি যতই সম্ভাব্য হোক সত্যিটা কোনোদিনই সামনে আসবে না। এটা আমার ধারণা।
তন্ময়— অন্তর্ধানের প্রেক্ষিতে বাংলার ইতিহাসের দুই কেন্দ্রীয় পুরুষ চৈতন্যদেব এবং সুভাষচন্দ্রের মিল খুঁজে পান আপনি?
তুহিন মুখোপাধ্যায়— হ্যাঁ, একাধিক জায়গাতে খুঁজে পাই। শুধু অন্তর্ধান কেন? অন্তর্ধান রহস্য তো রয়েছেই, তাছাড়াও দু-জনেই ছিলেন সেই মাপের গণনায়ক। এঁদের চেয়ে বড়ো গণনায়ক কিন্তু বাঙালির ইতিহাসে এসেছে বলে আমি জানি না। এটা তো সবচেয়ে বড়ো মিল। চৈতন্য যেহেতু আগে— সেটা ক্যারিশমাই বলুন, বাঙালির সেন্টিমেন্টের জায়গা বা সফটকর্নার, যা খুশি বলুন না কেন— চৈতন্যের পরে এমনটা যদি কাউকে ঘিরে আবর্তিত হয়ে থাকে, সেটা কিন্তু সুভাষ বসু। এবং দু-জনেই কিন্তু স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। সেই সঙ্গে সামাজিক উন্নতি তো চেয়েছিলেনই, সুভাষচন্দ্রের লেখাগুলো পড়লেই জানা যায়। আর চৈতন্য তো নিজে তাঁর আটটি শ্লোকের বাইরে কিছু লিখে গেলেন না। কিন্তু চৈতন্য যে একটা জিনিস চেয়েছিলেন, সেটা প্রমাণিত। সেটা হল, ব্রাহ্মণ্যবাদের যে-নাগপাশ নিচের তলার মানুষদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল তার থেকে তাঁদের মুক্তি দিয়ে একটা ধর্মীয় গণতান্ত্রিক অধিকার তাদের তিনি ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তখন তো আমাদের নাগরিক অধিকার বা ইত্যাদি কনসেপ্ট তো ছিল না, এগুলো অনেক পরে এসেছে। তখন সবকিছুই ধর্মীয় ব্যাপারকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হত। সেটা সমাজ সংস্কারই বলুন আর যা-ই বলুন। এই কনসেপ্টগুলোই পরবর্তীকালে ইংরেজদের হাত ধরে এসেছে। যাই হোক, চৈতন্যদেব তো সেটা চেয়েছিলেন। এখানেও সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর মিল খুঁজে পাই। ঠিক যেভাবে সুভাষচন্দ্র ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এবং চৈতন্য যেটা করতে চেয়েছিলেন, সেটা করতে পারলে তো জাত-পাতের ব্যাপারটা তুলে দেওয়া যায়। তাহলে তো একটা অন্যরকম পরিবেশ হয়ে যায়। যে-জায়গা থেকে রামকৃষ্ণকে বলতে হয়েছিল যে, এক পথেই জাত-পাতের মতো কুপ্রথাকে মুছে দেওয়া যেতে পারে আর সেটা হল ভক্তি। যেটা গৌরনিতাই শুরু করেছিলেন। ভক্তির মাধ্যমে জাত-পাতটা তুলতে চেয়েছিলেন। ভক্তিই একমাত্র রাস্তা। এখন আমরা এই সময়ে দাঁড়িয়ে সেটা ভাবব না, কিন্তু তখন এইভাবেই ভাবার জায়গাটা ছিল। এটা কিন্তু একটা বিরাট কাণ্ড করেছিলেন চৈতন্য। ফলে সুভাষচন্দ্র এবং চৈতন্যকে আমি অনেক জায়গায় এক করে ফেলি। এবার বড়ো তফাতের জায়গাটা অন্য আলোচনা। একজন যুদ্ধের মাধ্যমে কাজটা করতে চেয়েছিলেন, আরেকজন অন্য পথে। সেটা তো আলাদা কথা…
(সমাপ্ত)
অনুলিখন - শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
Powered by Froala Editor