‘জন্ম যেন এই শহরেই’, কলকাতার সঙ্গে বারবার একাত্ম হতে চাইতেন আশা ভোঁসলে

কী আছে কলকাতায়? চারদিকে এত ধুলো, ময়লা, আবর্জনা! তারপরেও কেন বারবার ফিরে আসেন এখানে? প্রশ্ন করলেন সলিল চৌধুরী (Salil Chowdhury)। বিপরীতে বসে আছেন আশা ভোঁসলে (Asha Bhosle)। যাঁর কণ্ঠের স্পর্শে দুলে ওঠে সারা দেশ। কখনও আমেরিকা, কখনও ইংল্যান্ডে ছুটে বেড়াচ্ছেন গানের টানে। তবুও, ফিরে আসা। এই কলকাতায়। শান্ত মুখে নম্র হাসিতে উত্তর দিলেন আশাজি, ভালোবাসা আছে এখানে।

কলকাতার সঙ্গে তাঁর প্রায় ৭০ বছরের সম্পর্ক। সেই পাঁচের দশকের শুরু থেকে। ততদিনে তিনি মাতিয়ে দিয়েছেন মুম্বইকে। দিদি লতা মঙ্গেশকরের (Lata Mangeshkar) পাশেই তৈরি করছেন নিজের পরিচয়। শাস্ত্রীয় রাগের আলাপ ভেঙে বলিউডি সিনেমার গানের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে গড়ে তুলছেন স্বতন্ত্র সত্তা। আর সেই সময়েই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ডাকে প্রথমবার তিনি এলেন কলকাতা। অবশ্য এই শহরটা খুব অচেনা কোনোদিনই নয়। তাঁর বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর কলকাতায় ছিলেন বেশ কয়েকদিন। পোশাক-আশাকেও ছিল বাঙালিয়ানার ছাপ। শরৎচন্দ্রের ‘দত্তা’, ‘পথের দাবী’, রবীন্দ্রনাথের ‘নৌকাডুবি’ ইত্যাদি উপন্যাসের সঙ্গে পরিচয় ছিল কমবেশি। কিন্তু প্রথমবার শহরটা দেখে মনের মধ্যে তৈরি হল একগুচ্ছ প্রশ্ন। মুড়ি জিনিসটা ঠিক কীরকম? মুম্বইতে তো মানুষ পানিপুরি খায়। তাহলে ‘ফুচকা’ কোথা থেকে এল? বাঙালি কি সত্যিই মাছ খেতে এত ভালোবাসে?

সময় যত এগিয়েছে, ততই বিস্তারিতভাবে জেনেছেন এই শহরটাকে। বলা ভালো সারা বাংলাকে। অনুষ্ঠান করতে গেছেন দূরদূরান্তে। একজন অবাঙালি শিল্পী, যাঁর ভারতজোড়া খ্যাতি, তাঁর কি আদৌ এত কৌতূহলী হওয়া দরকার ছিল? ভাষা সম্বন্ধে সামান্য ধারণা তৈরি করতেন, গান গাইতেন, চলে যেতেন। যেমনটা হয় আজকের দিনে। তা সত্ত্বেও বাঙালির ভাবনা, সংস্কৃতি, খাদ্য, জীবনযাত্রা বিষয়ে তিনি আরও জানতে চেয়েছেন। বুঝতে চেয়েছেন বাঙালিকে। তবেই তো তাঁর গান ছুঁতে পারবে বাংলার হৃদয়কে। এও যেন এক ধরনের রেওয়াজ। বহু বর্ণে রঙিন ভারতের তানপুরার প্রতিটি তার ছুঁয়ে চিনতে শেখা নিজের দেশকে। তবে, তিনি একা নন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিল্পীদের মধ্যেই বোধহয় পরস্পরের আত্মীয় হয়ে ওঠার একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিল সেই সময়ে।

আশা ভোঁসলে বাংলা গানের জগতে আনুষ্ঠানিকভাবে পা রাখেন ১৯৫৬-৫৭ সাল নাগাদ। ততদিনে গণপতরাও ভোঁসলের সঙ্গে তাঁর বিবাহ ও বিচ্ছেদের পর্ব সমাপ্ত হয়েছে। দিদি লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গেও খারাপ হয়েছে সম্পর্ক। আরও আকর্ষণীয় বিষয়, এই বছরেই শচীন দেববর্মণের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন লতা। সেই ঘটনা আশা ভোঁসলের উত্থানের কাজ আরও সহজ করে দেয়। বাংলায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও পরিচয় ছিল দীর্ঘদিনের। সেই সূত্রেই বারবার আসেন কলকাতায়। আর প্রতিবারই তাঁকে অবাক করে এই শহর। প্রায়ই চলে যান নিউ মার্কেটে, ঘুরে বেড়ান শহরের অলিগলিতে। বন্ধুদের কাছে খোঁজ করেন চাবি বাঁধা শাড়ি কোথায় পাওয়া যায়? কিংবা সর্ষে বাটা দিয়ে মাছ খেতে কেমন লাগে? সন্দেশ জিনিসটাই বা কীরকম? যত জেনেছেন, তত তাঁর মনে হয়েছে এই শহরের যেন জন্ম তাঁর। তিনি এই শহরেরই মেয়ে।

আরও পড়ুন
লতা মঙ্গেশকর ও তাঁর একনিষ্ঠ পূজারী

তা সত্ত্বেও পাঁচ-ছয়ের দশকে আশা ভোঁসলের বাংলা গানের সংখ্যা তুলনায় অনেক কম। রাহুল দেববর্মণের সঙ্গে বিয়ের পরে বরং বাংলায় তাঁর সচল যাতায়াত। সিনেমার বাঁকবদলও কি একটা কারণ? বিশেষ করে আটের দশকে। স্বর্ণযুগের ছায়া পিছনে ফেলে ‘অ্যাকশন’ ছবির ঘরানার সঙ্গে স্বতঃসিদ্ধভাবে খাপ খেয়ে যেত তাঁর কণ্ঠ। বয়স তখন প্রায় পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই। তবুও কমেনি গলার সেই মোহময়ী আকর্ষণ। রাহুল দেববর্মণ তো বটেই, বাপ্পি লাহিড়ী, কুমার শানু, অমিত কুমারদের সঙ্গে জুটিতে গেয়েছেন একের পর এক জনপ্রিয় গান। গিনেস ওয়ার্ল্ড বুক রেকর্ড বলছে সব ভাষা মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি গান গাওয়ার কৃতিত্ব তাঁর। গেয়েছেন প্রায় ১১০০০ গান। বাংলাতেও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের পরেই আসবে তাঁর কণ্ঠে গাওয়া গানের সংখ্যা। গেয়েছেন রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি এবং বাঙালি এক সময়ের অন্যতম শেষ্ঠ আকর্ষণ ‘পুজোর গান’।

আরও পড়ুন
বৃষ্টির শব্দ রেকর্ডের জন্য সারারাত ভেজা বারান্দায় কাটিয়েছিলেন রাহুল দেববর্মণ

একবার কলকাতার কোনো একটি প্রেক্ষাগৃহ থেকে অনুষ্ঠান করে বেরিয়েছেন তিনি। হঠাৎ পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে এসে পড়লেন এক ভদ্রমহিলা। যথেষ্ট বয়স্ক, মাথার সব চুলই শ্বেতশুভ্র। ‘আশাদি’ নয়, তাঁকে ডাকলেন ‘দুর্গা মা’ আর ‘কালী মা’ বলে। কণ্ঠে তাঁর কাতর আর্তি। আবার কবে ফিরে আসবেন তিনি এখানে? চোখের জল বাঁধ মানল না আশা ভোঁসলেরও। তিনি তো এক অত্যন্ত সাধারণ মহিলা। সম্বল বলতে শুধু গান। জীবনে সয়েছেন অনেক দুঃখ, অনেক বিচ্ছেদ। বিগতযৌবনে ভালোবাসার আশ্রয় খুঁজেছিলেন রাহুল দেববর্মণের কাছে। কটাক্ষ সঙ্গ ছাড়েনি। তাঁকে কিনা ‘দেবী’-র সঙ্গে তুলনা! এই ভালোবাসার জন্যই হয়তো বারবার ফিরে আসা। ‘অবাঙালি’ হয়েও বাংলার সঙ্গে মিশে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। শিল্পীর যেমন দেশ হয় না, ভালোবাসারও তো হয় না কোনো বেড়াজাল...

তথ্যঋণ : সলিল চৌধুরী ও আশা ভোঁসলের আলাপচারিতা, ডিডি বাংলা

Powered by Froala Editor