যখন সত্যজিৎ রায়ের মরদেহ নন্দনে শায়িত ছিল অগণিত অনুগামীর শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য, তখনও কিছু মানুষের মাঝে এক প্রৌঢ় থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছেন। মাথায় বিস্তৃত টাক, চুল বেশিরভাগই পাক ধরেছে। কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। যত সন্ধে ঘনিয়ে আসতে লাগল, তত সেই ব্যক্তি আরো শোকাতুর হয়ে পড়লেন। কাঁদছিলেন। অবশেষে মরদেহ যখন কেওড়াতলা মহাশ্মশানে শায়িত হল। পায়ের কাছে বসে হাউ হাউ করে কাঁদছিলেন সেই প্রৌঢ়। কপাল চাপড়ে কান্না। কেউ কেউ কাঁধে, পিঠে হাত রেখে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন… সেই চেষ্টায় মাঝে মাঝে থামছিলেন।
সাদাকালো টিভির পর্দায় সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছে। একজন বললেন - "কামু বাচ্চাদের মত কাঁদছে হাউ হাউ করে… কাঁদবে না? এত বছরের সম্পর্ক!"
কিংবদন্তী সত্যজিৎ রায়ের দেহকে পূর্ণ মর্যাদায় শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছে কলকাতা পুলিশ। পায়ের কাছে মাথা নিচু করে বসে আছেন কামু মুখোপাধ্যায়। এক অব্যক্ত অধিকারবোধ ওখানে থাকার। আর একটু পরেই দেহ চলে যাবে ইলেকট্রিক চুল্লিতে, এক জ্যোতিষ্কের আগুনে মিশে যাওয়া।
সত্যজিৎ রায়ের একটি গল্প আছে 'পটলবাবু ফিল্মস্টার’। মাঝে মাঝে কামু মুখোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়লে, তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলির কথা মনে পড়লেও একই কথা মনে হয়। নায়ক, সোনার কেল্লা, ফটিক চাঁদের মতো সিনেমা করার পরেও - উনি স্বল্প-উপস্থিতির অতিথি চরিত্রই করেছেন সব থেকে বেশি। কিছুক্ষণের উপস্থিতি, কখনও হয়তো সংলাপও নেই। তাতেও কী প্রচণ্ড স্ক্রিন প্রেজেন্স! নিজের সর্বস্ব দিয়ে একটা ছাপ রেখে যাওয়ার সচেতন প্রয়াস। চারুলতায় কয়েক মুহূর্তের জন্য অতিথি শিল্পী। অথচ চারুলতার আগে ১৯৫৯-এ 'সোনার হরিণ' ছবিতে আবদুল্লা নামক একটি নেগেটিভ চরিত্রে উনি ছবির অনেকটা জুড়ে অভিনয় করেছেন। শোনা যায়, কামু মুখোপাধ্যায় সত্যজিৎ রায়ের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন এত অল্প স্ক্রিন প্রেজেন্সের জন্য। সত্যজিৎ রায় তাঁকে বোঝান - স্বল্প সময়ে ইমপ্যাক্ট রাখাই আসল মুনশিয়ানা। আর নায়ক ছবিতে কামুকে দিয়েছিলেন একটু গুরুত্ব পূর্ণ চরিত্র - প্রীতীশ সরকার। কিন্তু এরপর 'সোনার কেল্লা' আর অনেক পরে 'ফটিকচাঁদ' বাদ দিলে, 'গুপি গাইন বাঘা বাইন' থেকে 'গুপি বাঘা ফিরে এলো' পর্যন্ত সত্যজিৎ রায় এবং সন্দীপ রায় পরিচালিত একের পর এক ছবিতে তাকে পেয়েছি ইমপ্যাক্টফুল অতিথি শিল্পী হিসেবেই।
এই ব্যাপারটা বোধহয় বাংলা সিনেমার অন্যান্য পরিচালকরাও বুঝে গেছিলেন… কামু মুখোপাধ্যায় বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সুবর্ণ অতিথি শিল্পী। 'সোনার হরিণ' এবং 'কখনো মেঘ'-এর মতো ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রাভিনেতা হিসেবে সুযোগ পেলেও, অন্য বেশির ভাগ ছবিতেই হয় অতিথি শিল্পী নয়তো অল্প সময়ের জন্য দেখা যায়, এমন চরিত্র পেতেন। সবাই তো ওঁর মানিকদার মতো 'অর্জুন'-এর চরিত্র দিতে পারবেন না। তাই ওঁকে কখনও হতে হল ডাকাত, দুশ্চরিত্র বিজনেস ক্লায়েন্ট, ভিলেনের ডান হাত ইত্যাদি।
১৯৬৪ থেকে ১৯৯২ - সত্যজিৎ রায় এবং সন্দীপ রায়ের সঙ্গে দশটি ছবিতে কাজ করেন কামু মুখোপাধ্যায়। আর ১৯৫৯ থেকে ১৯৯২ অবধি প্রায় তিন দশক ধরে অন্যান্য পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেন মাত্র সতেরোটি ছবিতে। ১৯৫৯-এ প্রথম কাজ করার পরেও, পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয় চারুলতায় একটি গুরুত্বহীন অতিথি চরিত্রের জন্য। সোনার কেল্লা-য় মন্দার বোসের মতো হেভিওয়েট চরিত্র করার পাশাপাশি ওঁকে দেখছি মৌচাকে অল্পসময়ের জন্য হিন্দুস্তানি দারোয়ানের চরিত্রে, স্বয়ংসিদ্ধায় খলনায়কের মোসাহেব হতে। এ-দুর্ভাগ্য কামু মুখোপাধ্যায়ের মত ক্ষণজন্মা শিল্পীর, বাংলার সিনেমার, না আমাদের? বাংলা সিনেমা তো চিরকাল চরিত্রাভিনেতাদের মাথায় তুলে রেখেছে! একের পর এক সিনেমায় নায়ককে ছাপিয়ে অভিনয় করে গেছেন চরিত্রাভিনেতারা। তাহলে কামু মুখোপাধ্যায়ের বেলা এমন কেন হল?
কামু মুখোপাধ্যায় নিজেও বুঝতে পারতেন, ওঁর অভিনয় দক্ষতার সদ্ব্যবহারের সুযোগ বাংলা ছবিতে উনি সে অর্থে পাচ্ছেন না। কখনো ওঁর স্বভাব-কৌতুক মিশিয়ে বলতেন ‘মন্দার বোসের বাজার মন্দা’; আবার ডায়েরিতে লিখে রাখতেন –
'যেহেতু আমার জন্ম হল কয়লাখনিতে
খনির কুলি পারল নাকো আমায় চিনিতে
মনের ব্যথা মনে চেপে ঘুরি হেথা সেথা,
মানিকদা এক চিনল আমায় ঘুচল মনের ব্যথা।'
সত্যিই কামু মুখোপাধ্যায়কে ছোটো ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন সত্যজিৎ রায়। ওঁর ছবিতে কোনো চরিত্র না থাকলেও, এমনকি একটি কয়েক মুহূর্তের অতিথি চরিত্র হলেও একটানা ইউনিটের সঙ্গে থাকতেন কামু। সত্যজিৎ রায় নিজে স্বীকার করে গেছেন কামু মুখোপাধ্যায়ের সাংগঠনিক দক্ষতার কথা, উনি কতটা নিশ্চিন্ত থাকতেন কামুর ওপর কোনো দায়িত্ব দিয়ে। কতটা সপ্রতিভ ছিলেন কামু। হয়তো একসময় কামু মুখোপাধ্যায় নিজেই প্রায়োরিটি বেছে নিয়েছিলেন অভিনয় জীবনে - মানিকদার পাশেই থাকবেন, অন্য পরিচালকদের থেকে যা পাচ্ছেন, তার থেকে ভালো কিছুর আশা নেই… তাই এটা হারাতে চান না।
পরিস্থিতি বোধহয় পরিবর্তন হচ্ছিল আশির দশকে এসে । গৌতম ঘোষের 'পার' এবং বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবি 'ফেরা'-তে কাজ করলেন কামু। ছোটো হলেও ভালো চরিত্র। 'ফেরা' ছবিতে মন্টু দত্ত নামক এক যাত্রা কোম্পানির মালিকের ঝকঝক চরিত্রায়ণ অন্য সব চরিত্রকে ছাপিয়ে যায় অল্প সময়ের মধ্যেই। যাকে বলে - আ ক্লাস অ্যাপার্ট!
কিন্তু ১৯৯১-এর পর তাঁকে আর কাজ করতে দেখা গেল না। ১৯৯২-এ সত্যজিৎ রায় চলে গেলেন। আর কামু মুখোপাধ্যায়কেও আর রূপোলি পর্দায় দেখতে পেলাম না আমরা। সত্যজিৎ রায় প্রয়াত হওয়ার পর ওঁর কীর্তি, চলচ্চিত্র, ওঁর সঙ্গে কাজ করা বিশিষ্ট অভিনেতাদের নিয়ে ছোটোদের, বড়োদের… সকলের জন্য একের পর এক অনুষ্ঠান হতে থাকে টিভিতে। কিন্তু কখনো কামু মুখোপাধ্যায়কে ডেকে কোনো অনুষ্ঠান করা, বা তাঁর সাক্ষাৎ নেওয়া চোখে পড়েনি চট করে। তাঁর মানিকদা চলে যেতেই, কামুও বিস্মৃত হয়ে গেলেন?
কয়েক বছর পর একদিন বেসরকারি সংবাদ মাধ্যমে জানা গেল, কামু মুখোপাধ্যায় পক্ষাঘাতে পঙ্গু। শয্যাশায়ী। ঠিক করে কথাও বলতে পারছেন না। সেই সংবাদ মাধ্যম উল্লেখ করেছিল, কোনো ছবির শুটিং করতে গিয়ে পড়ে গিয়ে বিপত্তি; একটি চোট লেগেছিল যা ক্রমে কাবু করে ফেলেছে। ভীষণ খারাপ লাগছিল কামু মুখোপাধ্যায়কে ওভাবে শুয়ে শুয়ে কথা বলতে দেখে। তারপর একদিন খবরে পড়লাম কামু মুখোপাধ্যায় আর নেই। তেমন চাঞ্চল্যকর কিছু না। একটি ছোট্ট খবর সংবাদ পত্রে -
‘অভিনেতা কামু মুখোপাধ্যায় তাঁর সিআইটি রোডের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বয়স হয়েছিল ৭২ বছর।
মৃত্যুর কারণ -- দশ বছর ধরে দীর্ঘ রোগভোগ; রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস।’
শেষে একটা কথা খুব বলতে ইচ্ছে করছে…
প্রীতীশ সরকার অথবা মন্দার বোস দুটি চরিত্রই ট্রেনের কামরার দৃশ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ১৯৯১-এ মুক্তি পাওয়া একটা অখ্যাত বাংলা ছবি 'পলাতকা'-তেও কামু মুখোপাধ্যায় একটি অতিথি চরিত্রে অভিনয় করেন - ট্রেনের সহযাত্রী। দৃশ্যটি পুরোটাই ট্রেনের ভেতরে। সেই সহজাত স্মার্ট কামু মুখোপাধ্যায়। বিশ্বাসযোগ্য মিথ্যে বলা এবং অস্বীকার - দুটোই স্মার্টলি করতে পারেন।
এই চরিত্রে একই সঙ্গে প্রীতীশ সরকার এবং মন্দার বোসের ছায়া দেখতে পাই। এই স্বল্প সময়টুকু দর্শকের মনে জায়গা করে নেবে শিল্পী কামু মুখোপাধ্যায়ের নিজ-গুণে। জীবনের অভিজ্ঞতায় যা শিখেছেন, অর্জন করেছেন… কোনো ভুলচুক নেই। আর কোনো পরিচালকের গাইডেন্স বা লিডের বোধহয় দরকার পড়ত না তাঁর।
Powered by Froala Editor