নেদারল্যান্ডসের শহর বলতে প্রথমেই হয়তো মনে আসে আমস্টারডামের কথা। বাদ রাখা যাবে না রটারডাম বা হেগ-কেও। সেই তুলনায় লেইডেন (Leiden) শহরের নামটি প্রায় অপরিচিত। এমনিতেও খুব একটি বড়ো নয়, চোখধাঁধানো জৌলুস বা স্থাপত্যকর্মেরও নিদর্শন কম। খুবই শান্ত, বেশি নয় জনসংখ্যাও। কিন্তু কবিতা পড়তে হলে যেতে হবে লেইডেনে। কোনো বিশেষ লাইব্রেরি নয়, শহরের দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা রয়েছে কবিতার আখর। চলার পথে অনায়াসে মুখস্থ হয়ে যাবে নেরুদা, লোরকা, রিলকের কবিতা। এটাই লেইডেনের বিশেষত্ব।
লেইডেনের মূল আকর্ষণ যদিও এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়টি। ১৫৭৫ সালে তৈরি হওয়া লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয় (Leiden University) নেদারল্যান্ডসের প্রাচীনতম। ১৩ জন নোবেলজয়ীর কীর্তি মিশে রয়েছে এর সঙ্গে। তৎকালীন যুবরাজ উইলিয়াম অরেঞ্জ স্পেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইয়ে লেইডেনের ভূমিকায় মুগ্ধ হয়ে তৈরি করেন বিশ্ববিদ্যালয়টি। রবীন্দ্রনাথেরও স্পর্শ রয়েছে এখানে। তবে বর্তমানে সাধারণ পর্যটককে মুগ্ধ করে কবিতায় মোড়া বাড়িদের সৌন্দর্য। শহরবাসীও গর্ব করে তাদের ‘কবিতার শহর’-কে নিয়ে।
শুরুটা হয়েছিল ১৯৯২ সালে। ‘তেগেন ব্লিড’ (Tegen-Beeld) নামের একটি কবিতাপ্রেমী সংগঠন প্রথম উৎসাহ দেখায় শহরকে কবিতায় মুড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে। পাশে এসে দাঁড়ায় কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা। রাশিয়ান কবিতা মারিনা তেসভেতজার একটি কবিতা খোদাইয়ের মাধ্যমে শুরু হয় কাজ। আর শেষ হয় ২০০৫ সালে ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার ‘দে প্রোফুন্দিস’ (De Profundis) কবিতার মাধ্যমে। ২০১০ সালে লেখা হয়েছে আরেকটি কবিতা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে মোট ১০১টি বাড়ির শরীর ছুঁয়ে আছে কবিতারা। সামিল হয়েছে ইয়েটস, নেরুদা, শেকস্পিয়র, কামিংস, রিলকের কবিতা। বাদ যাননি ডাচ কবি পিয়েত পালৎজেনস ও জে. সি ব্লোয়েম-ও। চিন, জাপান, মরক্কো, সুরিনাম, তুরস্কের কবিরা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে এখানে। উপস্থিত এক ভারতীয় কবিও। নবম শতকের কবি বল্লানা-র (Vallana) একটি সংস্কৃত কবিতা প্রতিনিধিত্ব করছে ভারতীয় সাহিত্যের। অধিকাংশ কবিতার নিচে লেখা থাকে ডাচ কিংবা ইংরেজি ভাষার অনুবাদ।
আরও পড়ুন
কবিতাকে হাতিয়ার করে বিপন্ন ভাষা-সংরক্ষণ, নেপথ্যে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল পোয়েট্রি লাইব্রেরি
আরও পড়ুন
কবিতার সূত্রে শিল্পবৈচিত্রের মিলনসমাবেশ, সাক্ষী তিলোত্তমা
২০১৫-তে চালু হয় আরেকটি পরিকল্পনা। এবার কবিতা নয়, পদার্থবিদ্যা ও গণিতের বিভিন্ন সমীকরণ খোদাই করা হবে দেওয়ালে। যতই হোক, লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ই এই শহরের প্রাণকেন্দ্র। উইলেব্রর্ড স্নেলিউস, পিয়েতের ভ্যান মুসচেনব্রোয়েক, হেইকে ক্যামেরলিংঘ-এর মতো বিজ্ঞানী গবেষণা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। আইনস্টাইনও ছিলেন কিছুদিন। এখনও পর্যন্ত মাত্র ছটি দেওয়ালেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে গাণিতিক সূত্র। কবিতা আর অঙ্ক ভালোবেসে হাত ধরে দাঁড়িয়ে এখানে। যার দেখা মিলবে না পৃথিবীর অন্য কোনো শহরে।
উৎসবের শহর হিসেবেও কমবেশি খ্যাতি আছে লেইডেনের। আয়োজন সীমিত হলেও, অভাব নেই উদ্দীপনার। সারা বিশ্ব থেকে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের শহরবাসীরা বরণ করেন আত্মীয়ের মতো। কবিতাকে দেওয়ালে নিয়ে যারা ঘর করেন, তারা তো আসলে বিশ্বনাগরিক। অনায়াসে তাঁরা যেন বলতে পারেন, শুধু কবিতার জন্য জন্ম। আর কবিতাই তাঁদের দিয়েছে অমরত্বের সন্ধান।
আবর্জনা, জঞ্জাল, ট্রাফিকের হট্টগোল, পোস্টার-হোর্ডিং-এর দৃশ্যদূষণমুক্ত একটি শহর। আর দেওয়াল জোড়া অসংখ্য কবিতা। ‘কল্লোলিনী’ কলকাতাকে লেইডেনের মতো সাজিয়ে তুলতে চাওয়া কি খুব বেশি দাবি করে ফেলা হবে?
Powered by Froala Editor