বছর কুড়ির রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখাশোনা করতে এসে পড়লেন নওগাঁ জেলার পতিসরে। সেই ছেলেবেলায় যে গণ্ডির মধ্যে বন্দি হয়ে দিন কেটেছে, তার খড়ির দাগ মুছে গিয়েছে। সমস্ত পৃথিবীকে নতুন করে দেখছেন যেন। এর আগেই শিলাইদহ গিয়েছেন তিনি। এরপর এলেন পতিসর। এই পৃথিবী জোড়াসাঁকোর ঐশ্বর্যে মোড়া পৃথিবী নয়। এখানে মানুষের দিন কাটে জীবনের সঙ্গে লড়াই করে। সেই লড়াইয়ে কখন যেন নিজেকেও মিলিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্যের মধ্যে যেমন তার প্রতিফলন ঘটেছে, তেমনই ছাপ পড়েছে কবির জীবনেও।
পতিসরে এসে কৃষকদের জীবনকে কাছ থেকে দেখলেন রবীন্দ্রনাথ। দেখলেন কীভাবে সুদখোর মহাজনদের হাতে পড়ে সর্বস্বান্ত হতে হচ্ছে নিরীহ কৃষকদের। ২০ বছরের রবীন্দ্রনাথ অবশ্য তখন ভাবতে পারেননি এই সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় কী। ভারতে তখন ব্যাঙ্কের কোনো ধারণা নেই। রবীন্দ্রনাথও এই ধারণার সঙ্গে পরিচিত হলেন অনেক পরে। এদেশে কৃষিব্যাঙ্কের গোড়াপত্তন রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই। ১৯০৫ সালে পতিসরের কালীগ্রামেই তৈরি হল ভারতের প্রথম কৃষিব্যাঙ্ক। এভাবে নামমাত্র সুদে টাকা ধার পাওয়া যায়! কৃষকরা যেন প্রথমে ভাবতেই পারেননি সেকথা। তবে ধীরে ধীরে সংশয় কাটল। আর ঠাকুরবাড়ির ছোটো ছেলে হয়ে উঠল সেইসব কৃষকদের একজন। তাদের সুখদুঃখের সঙ্গী।
এখানে সময়টা একটু খেয়াল রাখা উচিৎ। ১৯০৫ সাল, অর্থাৎ যে-বছর বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাবে উত্তাল হয়ে উঠেছিল অখণ্ড বাংলাদেশ। স্বদেশি আন্দোলনের জোয়ার এসেছিল বাংলার অর্থনীতিতে। যদিও তার বেশিরভাগটাই হয়েছিল শহর কলকাতাকে কেন্দ্র করে। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ছুটে গিয়েছিলেন পদ্মার কোলে। কৃষিব্যাঙ্কের পাশাপাশি গড়ে তুললেন একটি হাইস্কুল, একটি দাতব্য চিকিৎসালয়। কিন্তু ব্যাঙ্ক তো তৈরি হল। তার লগ্নি আসবে কোত্থেকে? প্রথম পর্যায়ে কীভাবে লগ্নির টাকা জোগাড় করেছিলেন তিনি, সেকথা বিশদে জানা যায় না। গবেষকরাও সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি বিষয়টিকে। টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতিচারণায় যা তথ্য জানা যায়।
এটুকু ধরে নিলে হয়তো খুব ভুল হবে না যে শান্তিনিকেতনের আশ্রমের মতোই প্রথমে বেশ অর্থকষ্টের মধ্যেই যেতে হয়েছে কালীগ্রাম কৃষিব্যাঙ্ককেও। তবে দরিদ্র কৃষকদের মুখের হাসি সব দেনা-পাওনা চুকিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের রেশ মিলিয়ে গিয়েছে। ব্রিটিশ সরকারের রাজধানী সরে গিয়েছে দিল্লি শহরে। কিন্তু এদেশের কৃষি অর্থনীতি রবীন্দ্রনাথের চিন্তা থেকে সরে গেল না। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভেবে গিয়েছেন প্রজাদের কথা। ছেলে রথীন্দ্রনাথকে কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে পড়তে বিলেতে পাঠালেন। রথীন্দ্রনাথ ফিরে এলে তাঁকে নিয়ে গেলেন পতিসর। এদিকে ১৯১০ সালে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বন্যাত্রাণের জন্য যে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন তার কিছুটা থেকে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে তিনি সেই টাকায় দুটি ট্রাক্টর কিনে দিলেন। আর রথীন্দ্রনাথ মাঠে নেমে প্রজাদের শেখাতে শুরু করলেন ট্রাক্টর চালানোর পদ্ধতি। সত্যিই যেন ব্রিটিশ কৃষি অর্থনীতির সামাজিক কাঠামো ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছিল সেদিন।
আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের শেষ মিক্সচার ও এক বিস্মৃতপ্রায় ওষুধের দোকানের গল্প
কিন্তু এর মধ্যেই একদিকে শান্তিনিকেতনের আশ্রম অন্যদিকে পতিসরের গ্রামীণ উদ্যোগ, দুইয়ের খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তখনই যেন হঠাৎ অলৌকিকভাবে এসে পড়ল নোবেল পুরস্কারের খবর। ১৯১৩ সালের ১৩ নভেম্বর। পুরস্কারমূল্য ১ লক্ষ ৮ হাজার টাকা। তখনকার হিসাবে বেশ লোভনীয় সেই মূল্য। রবীন্দ্রনাথ গেলেন পতিসরে। প্রজারা তখন তাঁর জন্য সংবর্ধনার ব্যবস্থা করেছেন। দরিদ্র কৃষকরা জানেন না, নোবেল পুরস্কার কাকে বলে। শুধু জানতেন, রবীন্দ্রনাথের এই সাফল্য তাঁদেরও সাফল্য। আর এই উষ্ণ আন্তরিকতার কাছে রবীন্দ্রনাথ সমর্পণ করলেন পুরস্কারের প্রায় সমস্ত অর্থমূল্য। কালীগ্রাম কৃষিব্যাঙ্কের খাতায় সেই সব থেকে বড়ো লগ্নি। বাকি যেটুকু হাতে থাকল, ঢেলে দিলেন বিশ্বভারতী তৈরির কাজে।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য এই কৃষিব্যাঙ্ককে টিকিয়ে রাখতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। ঠিক কতদিন পর্যন্ত ব্যাঙ্ক চালু ছিল, তাও জানা যায় না। পতিসরের গ্রামবাসীরা বলেন এই ব্যাঙ্ক চলেছিল ২০ বছর। আবার ব্যাঙ্কের খাতায় ২৫ বছর পর্যন্ত লেনদেনের হিসাব পাওয়া যায়। তবে শেষ পর্যন্ত যে ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই। এমনকি লগ্নির টাকাও ফেরত পাননি রবীন্দ্রনাথ। যেটুকু টাকা ছিল, তাই দিয়ে বাকি আমানতকারীদের যতটা সম্ভব শোধ দিয়েছেন। জোড়াসাঁকোর জমিদারবাড়ির ছেলে হয়ে হয়তো সারা জীবন আরামেই কাটিয়ে দিতে পারতেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু মানুষের দারিদ্র্যের সঙ্গী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সেই দারিদ্র্য শেষ দিন পর্যন্ত তাঁরও সঙ্গী হয়ে ছিল। বিশ্বভারতীর জন্য টাকা সংগ্রহ করতেও নাটকের দল নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন সারা দেশ। বারবার বিদেশে যাওয়ারও অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল অর্থ সংগ্রহ করা। হয়তো উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাবে অনেক উদ্যোগই সফল হয়নি। কিন্তু এদেশের অর্থনীতির গভীরে যে বিকল্পের সন্ধান তিনি করেছিলেন, তার গুরুত্বকে সত্যিই অস্বীকার করা যায় না।
আরও পড়ুন
যেতে হয়নি সুইডেনে, রবীন্দ্রনাথের জন্য কলকাতাতেই হাজির হয়েছিল নোবেল পদক
তথ্যসূত্রঃ ব্যাংকার রবীন্দ্রনাথ, আব্দুল খালেক খান, বাংলা নিউজ ২৪
রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর বাণিজ্য-মনস্কতা, রাহুল রায়, পরবাস
নওগাঁর পতিসর কাছারিবাড়ী, বাংলাদেশ প্রতিদিন
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
সামনেই মৃত্যু, নাৎসিদের হাতে বন্দি ইহুদি শিশুরা সাহস খুঁজল রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’-এ