সেইসময়টাকে বলা হয় ইউরোপের নবজাগরণ। মধ্যযুগের অন্ধকার আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। আর নতুন সময়কে রাঙিয়ে দিচ্ছেন নতুন যুগের শিল্পীরা। শুধু তো চিত্রশিল্প নয়, সঙ্গে ভাস্কর্য। নতুন রূপে সেজে উঠছে ইউরোপ। আর ইউরোপের এই নবরূপায়ণের কথা বললেই মনে পড়ে কত শিল্পী, ভাস্করের নাম। তার মধ্যে মিকেলেঞ্জেলোর নাম আসবেই।
মিকেলেঞ্জেলো বলতেই প্রথম মনে আসে সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদে আঁকা বিরাট চিত্রশিল্প। তবে ছবি আঁকা দিয়ে শুরু করলেও আসলে মূর্তি তৈরিতেই তাঁর উৎসাহ ছিল। খুব রগচটা মানুষ ছিলেন মিকেলেঞ্জেলো। যখন যা মনে আসত, বলে দিতেন। কারোর সঙ্গেই তাঁর ঠিক বনিবনা হত না। একবার করলেন কী, তরুণ এক ভাস্করের গড়া মূর্তি দেখে মুখের উপর বলে দিলেন, মূর্তিটি তেমন ভালো হয়নি। সেই ভাস্কর তখন কষিয়ে এক ঘুঁষি বসালেন মিকেলেঞ্জেলোর নাকে। সেই ভাঙা নাক নিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিলেন তিনি।
এরকম বদ মেজাজ নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। শিল্পী মানেই কি বদমেজাজি হন? কে জানে!
ফ্লোরেন্সে বসেই চিত্রকলা থেকে ভাস্কর্যশিল্পের শিক্ষা ও অনুশীলন করলেন মিকেলেঞ্জেলো। তারপর ভাগ্যান্বেষণের জন্য গেলেন রোম। সেখানে তাঁর কাজ ভালো লেগে যায় পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াসের। এতটাই ভালো লেগে গেল, যে তিনি বললেন কেবল তাঁর কাছেই কাজ করতে হবে। অন্য কারোর কাছে যাওয়া চলবে না।
মিকেলেঞ্জেলো থেকে গেলেন। পোপের নির্দেশ অনুযায়ী নানান মূর্তি তৈরি করতেন। বেশিরভাগ সময়েই কোনো কাজ থাকত না। তখন নিজের মতো অনুশীলন করতেন। ভাস্কর্যের মধ্যে তাঁকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করত মানব শরীরের বিভিন্ন ভাঁজ ও ঢাল। পেশীর গঠন, শিরার অবস্থান - এইসব বিষয়গুলো খুব খুঁটিয়ে বোঝার চেষ্টা করতেন মিকেলেঞ্জেলো। একটা মূর্তি তৈরি করার আগে বিভিন্ন দিক থেকে মাপজোক করতেন। শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অনুপাত হত নিখুঁত। মূর্তি তৈরির এইসব অনুপাত তাঁর আঁকা ছবিতেও ছাপ ফেলেছিল। মনে হত যেন ছবিগুলিরও ভার আছে। তাই তো তাঁর ছবিগুলিকে বলা হয় মূর্তিপ্রতিম। অর্থাৎ মূর্তির মতো। সমতলে আঁকা ছবিগুলোর যেন তৃতীয় একটি মাত্রা আছে।
কিন্তু গোঁ ধরে বসেছিলেন মিকেলেঞ্জেলো। ছবি তিনি আঁকবেন না। রোমের যে প্রাসাদে পোপ থাকতেন, সেই প্রাসাদের নাম ‘ভ্যাটিকান’। সেই প্রাসাদের মধ্যেই একটা গির্জা, নাম সিস্টিন। মিকেলেঞ্জেলোকে বারবার পোপ অনুরোধ করেন, সেই সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদে সুন্দর করে বাইবেলের নানা কাহিনি এঁকে দিতে। কিন্তু মিকেলেঞ্জেলো তাঁর জেদ ছাড়েন না। ছবি তিনি আঁকবেন না। মূর্তি তৈরির যে আস্বাদ তিনি পেয়ে গেছেন, পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস সেটা বুঝতেন। কিন্তু সবাই সেকথা বুঝবে কেন? কিছুদিনের মধ্যেই রটে গেল, আসলে মিকেলেঞ্জেলো ভয় পেয়েছেন। তাই ছবি আঁকার কাজে হাত দিচ্ছেন না। আঁকতে পারলে তো আঁকবেন।
এই কথা কানে যাওয়া মাত্র ক্ষেপে গেলেন মিকেলেঞ্জেলো। ঠিক করলেন, ছবি তিনি আঁকবেন। এবং এঁকে দেখিয়ে দেবেন ছবি আঁকা কাকে বলে। ততদিনে মূর্তি তৈরি শিখতে তিনি লুকিয়ে শবদেহ জোগাড় করেছেন। মোমবাতির আলোয় লুকিয়ে লুকিয়ে সেইসব মৃতদেহ কেটেকুটে দেখতেন ভিতরের কলকব্জা। সেসবের স্কেচ নিতেন। ছবি আঁকার জন্য সেইসব স্কেচগুলিকেই কাজে লাগালেন তিনি।
গির্জার ভিতরে কাঠের ভারা বাঁধা হল। তার উপরে পাটাতন। পাটাতনের উপর বসে, শুয়ে ছবি আঁকেন মিকেলেঞ্জেলো। এ তো আর ক্যানভাসে আঁকা ছবি নয়! ছাদের দেয়াল যেন তাঁর নাকের কাছে চলে আসে। যখন মাথা আঁকেন, তখন জানেন না কোথায় পা আঁকবেন। যখন পা আঁকেন, তখন মাথা কোথায় দেখতে পান না। সেইসঙ্গে তুলিতে একটু বেশি রং উঠলেই টুপটুপ করে জামাকাপড়ের উপর পড়ে। এইসব ভেবেই তো কাজ নিতে চাননি তিনি। কিন্তু অপমানের তাপ যে সহ্য করতে পারেন না তিনি।
মিকেলেঞ্জেলোর ছবি এমনিতে বেশ পছন্দই হচ্ছিল পোপের। তবু মাঝে মাঝে এসে দেখে যেতেন, আর সেইসঙ্গে ছোটোখাটো কিছু নির্দেশ দিতেন শিল্পীকে। মিকেলেঞ্জেলোর সেটুকুই পছন্দ হত না। ছবির ব্যাপার তিনি পোপের থেকে ভালো বোঝেন। একদিন করলেন কী, ভারা থেকে একটা বেশ বড় আকারের হাতুড়ি ফেলে দিলেন নিচে। হিসেব করে ফেলেছিলেন। যাতে পোপের ঘাড়ের উপর না পড়ে হাতুড়ি। কিন্তু বেশ ভড়কে গিয়েছিলেন পোপ।
পোপ আর বিরক্ত করতে আসেননি। মিকেলেঞ্জেলো আর গির্জার ঘর থেকে বেরোননি। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাও হয় ঘরের মধ্যেই। ছবি আঁকার কাজ শেষ হয়ে আসে। দেখতে দেখতে সাড়ে-চার বছর কেটে যায়। শিল্পী কাজ শেষ করেন। গোটা ছাদ জুড়ে তখন বাইবেলের নানা কাহিনির চিত্ররূপ। একদম কিনারা দিয়ে পরীদের সারি। ছাদের মাঝখান দিয়ে নিউ টেস্টামেন্টের ছবি। মানুষের সৃষ্টি। সৃষ্টির প্রথম ছয়দিন, নোয়ার নৌকা, মহাপ্লাবন। গির্জার গোলকাকার ছাদে সেইসব ছবি দেখতে মানুষের ভিড় ভেঙে পড়ে। আর সেইসঙ্গে শিল্পীকে দেখতেও তাঁদের বিপুল আগ্রহ। মিকেলেঞ্জেলো তখন সাড়ে-চার বছরের পরিশ্রমের ভারে নুয়ে পড়েছেন। পিঠ বেঁকে গেছে ধনুকের মত। ঘাড় অবশ হয়ে গেছে।
আবারও সিস্টিনের দেয়ালে ছবি আঁকতে ডাকা হয় মিকেলেঞ্জেলোকে। ছাদ আঁকার প্রায় তিরিশ বছর পরে। গির্জার এক কোণে বেদীর উপর শেষ বিচারের ছবি। সৃষ্টির অন্তিম বিচারের দিন অজস্র মানুষ কবর থেকে উঠে এসেছেন। ছবি খুব বেশি আঁকেননি তিনি। তবে তাঁর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে, সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যে শিল্পীর ধর্ম!
তথ্যসূত্র: পশ্চিম ইওরোপের চিত্রকলা, অশোক মিত্র
Powered by Froala Editor