“ও বাবুল পেয়ারে
ও রোয়ে পায়েল কী ছম্ ছম্
ও সিসকে সাঁসোঁ কী সরগম
ও নিসদিন তুঝে পুকারে মন”
বীরভূম জেলার নলহাটির ছোট্ট ছেলেটি মাত্র নয় বছর বয়সে শুনেছিল লতার গাওয়া ‘ও বাবুল পেয়ারে’। গানটি শোনার পর সে কী বুঝেছিল, সে নিজেও জানে না, কিন্তু লতা মঙ্গেশকরের (Lata Mangeshkar) কণ্ঠ তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল এক অন্য জগতে।
খুব ছোটো বয়স থেকে লতা মঙ্গেশকরের গানই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। প্রথমে তাঁর মায়ের হাত ধরেই গানের হাতেখড়ি। এরপর নলহাটির গৌর দাস, শান্তিনিকেতনের চিত্তরঞ্জন মুখোপাধ্যায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন পণ্ডিত ধ্রুবতারা যোশীর কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিক্ষালাভ। তাই তাঁর গানের প্রতি একটা আলাদা টান থাকবে সে আর নতুন কথা কি!
সেই ছেলেটিই স্নেহাশিস চট্টোপাধ্যায় (Snehasis Chattopadhyay)। বর্তমানে তিনি শ্রীরামপুর দে স্ট্রিটের বাসিন্দা। সেখানেই তিনি নিজের ফ্ল্যাটে সর্বস্ব দিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘লতা মঙ্গেশকর আর্কাইভ’ (Lata Mangeshkar Archive)। এই আর্কাইভ গড়ে তোলার পিছনের ইতিহাসটাও, কম আকর্ষণীয় নয়।
কিংবদন্তি গায়ক মহম্মদ রফির মৃত্যুর পর উত্তরপ্রদেশের ‘সঙ্গীত’ নামক একটি পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। সেই পত্রিকার বিভিন্ন লেখায় পাওয়া গেল রফির গানের সংখ্যা কোথাও ২৫,০০০, কোথাও ২৬,০০০ আবার কোথাও তারও বেশি। সে-সময় কলেজ পড়ুয়া স্নেহাশিসের মনে হাজারও প্রশ্নের ঝড় উঠল। একজন মানুষ একজীবনে এত গান করতে পারেন! আর যদি করেও থাকেন সঠিক সংখ্যাটাই বা কী? আর মহম্মদ রফির মতো একজন শিল্পী, তাঁর গাওয়া গানের পূর্ণাঙ্গ তালিকা বলার মতো কেউ নেই এই দেশে! তার চেয়েও আশ্চর্য লেগেছিল, একটি পত্রিকাতেই রফির গানের সংখ্যা এক-একজন এক-একরকম লিখছেন। আবার সেটা তাঁরা ছাপছেনও, অথচ তাঁদের মনে কোনোরকম সংশয় হচ্ছে না! মহম্মদ রফিরই যদি এইরকম অবস্থা হয় তবে বাকিদের? তাঁদের নিয়েও ঠিক এইরকমই গল্প হয়ে চলেছে! এইরকম হাজার কৌতূহল চলছে তাঁর মনে। কিন্তু এই গল্প কী করে বন্ধ হবে, সত্যিটা কী করে সকলের সামনে আনা যাবে, সেই কথাই ভেবেছিলেন তিনি। এরপর ১৯৮২ সালে প্রথম লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া গান নিয়ে কাজ করার কথা ভাবলেন। দীর্ঘ আশি বছরের সংগীত জীবনে সুরসম্রাজ্ঞী প্রায় ৩৮টি ভাষায়, প্রায় সাত হাজারের কাছাকাছি গান গেয়েছেন। শুধুমাত্র সংখ্যায় নয়, বৈচিত্র্যে এবং মাধুর্যে সেইসব গান মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছে। হিন্দি, বাংলা, মারাঠির পাশাপাশি অহমিয়া, ভোজপুরি, ছত্তিশগড়ি, ডোগরি, গাড়ওয়ালি, গুজরাটি, কন্নড়, কোঙ্কনি, মগধী, মৈথিলী, মালয়ালাম, মণিপুরী, নেপালি, পাঞ্জাবি, রাজস্থানি, ওড়িয়া, সংস্কৃত, প্রাকৃত, সিন্ধি, তামিল, তেলেগু, উর্দু ইত্যাদি দেশীয় ভাষায় অসংখ্য গান গেয়ে মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে আসন লাভ করেছেন ভারতরত্ন লতা মঙ্গেশকর। তবে শুধু দেশীয় ভাষায় গান করেই থেমে থাকেননি। ইংরাজি, সিলোনিজ, রাশিয়ান, ডাচ, মালয়, সোয়াহিলি, ল্যাটিনের মত বিদেশি ভাষাতেও গান রয়েছে তাঁর। এইসব অজস্র কালজয়ী গানের ‘ডেটাবেস’ থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। নাহলে কালের নিয়মে সেগুলি বিলুপ্তির পথে চলে যাবে। সেই ডকুমেন্টশনের ভাবনাটি প্রথম ভেবেছিলেন হুগলীর শ্রীরামপুরের দে স্ট্রিটের বাসিন্দা স্নেহাশিস চট্টোপাধ্যায়। প্রায় তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি লতা মঙ্গেশকরের গান নিয়ে কাজ করে চলেছেন।
১৯৮২ সালে যখন স্নেহাশিস লতার গান নিয়ে কাজ করার কথা ভাবেন তখন কাজ করার পদ্ধতি তাঁর জানা ছিল না। সেইসময় তিনি যে গান শুনতেন সেই গানই খাতায় লিখে রাখতেন। এরপর ‘দেশ’ পত্রিকার একটি লেখা থেকে দমদম চিড়িয়ামোড়ের বিখ্যাত রেকর্ড সংগ্রাহক সুরাজলাল মুখোপাধ্যায়ের কথা তিনি জানতে পারেন। যিনি হারুবাবু নামে পরিচিত। তারপর শান্তিনিকেতন থেকে সোজা দমদমের চিড়িয়ামোড়ের রেডিও গলি। সেখানেই দেখা পেলেন রেকর্ড সংগ্রাহক সুরাজলাল মুখোপাধ্যায়ের। সেইদিন থেকেই শুরু হয়েছিল স্নেহাশিস চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণার কাজ। হারুবাবুই তাঁকে বলেছিলেন, কাজ যদি করতে হয় বিক্ষিপ্তভাবে হবে না, কম্পানির ক্যাটালগ ধরে করতে হবে। বুঝিয়েছিলেন ডিস্কোগ্রাফি কাকে বলে। নিজে হাতে ধরে চিনিয়েছিলেন শিয়ালদহ স্টেশনের চোরাবাজার, সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের ধারে লেনিন সরণির ফুটপাথ বা ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মতো পুরনো রেকর্ড বিক্রির সব আখড়া। এছাড়া হারুবাবু তাঁর খেরোর খাতা, বুকলেট, ক্যাটালগ, রেকর্ড লেবেল খুঁটিয়ে কিভাবে দেখতে হয়, সেগুলো কিভাবে নোট করতে হয় সবই শিখিয়েছিলেন হাতে ধরে। সেখান থেকেই বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া গানের তথ্য সংগ্রহ, বাণী লিপিবদ্ধ করা ও সুর-তাল চিহ্নিত করে তা থেকে গানের তালিকা তৈরি ইত্যাদি আনুষাঙ্গিক কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে ‘লতা গীতকোষ’-এর কাজেরও সূত্রপাত ঘটেছিল। স্নেহাশিসের গবেষণায় উঠে এসেছে লতা মঙ্গেশকরের প্রায় ৭০০০ গানের তালিকা। লতা যে ৩৮টি ভাষায় গান করেছেন, তাও তিনি সংগ্রহ করেছেন। কখনও হায়দ্রাবাদ বা কখনও উড়িষ্যা যেখানেই গেছেন সেখান থেকেই সংগ্রহ করেছেন লতার গানের অরিজিনাল রেকর্ড। কবি বলেছিলেন- “খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফেরে পরশ-পাথর।” ঠিক সেইরকম ভাবেই খুঁজে গেছেন বারবার। শুধু বাংলা, হিন্দি ভাষাতেই নয় বিদেশি গানের রেকর্ডও তাঁর সংগ্রহে আছে। সঙ্গীতপ্রেমীরা লতা মঙ্গেশকরের ৩৪টি ভাষার গান শুনতে পাবেন স্নেহাশিসের শ্রীরামপুরের ‘লতা মঙ্গেশকর আর্কাইভ’-এ। শ্রীরামপুরে হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট জুড়ে এই আর্কাইভ গড়ে উঠেছে। ১৯৯৫ সাল থেকে এই আর্কাইভ গড়ে তোলার কাজ চলছে। সেখানে গেলে দেখা মিলবে লতার সমস্ত সংগীত সংক্রান্ত বই, গ্রামোফোন রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডি-সহ যাবতীয় সংগ্রহ। এছাড়া বর্তমানে আধুনিক উন্নত প্রযুক্তির পাশাপাশি স্নেহাশিস তার সংগ্রহকে ডিজিটালাইজডও করছেন। দুষ্প্রাপ্য উপাদান সংগ্রহের জন্য তিনি ভিনরাজ্যে গিয়েছেন বারবার, যাঁদের ওইসব জায়গায় যাতায়াত রয়েছে তাঁদের সাহায্যও নিয়েছেন। ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তিনি লতা মঙ্গেশকরের ১২ খণ্ডের এনসাইক্লোপিডিয়া ‘লতা গীতকোষ’। এখনও তিনটি খণ্ডের কাজ করে চলেছেন। তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০১ সালে স্নেহাশিস চট্টোপাধ্যায়ের নাম উঠেছে ‘লিমকা বুক অফ রেকর্ডস্’-এ।
নীরবে থেকেই সুর সম্রাজ্ঞীকে নিয়ে কাজ করে চলেছেন স্নেহাশিস। নীরবে কাজ করলেও তাঁকে চিনতেন লতা মঙ্গেশকর, সেটাই যেন স্নেহাশিসের কাছে বড়ো প্রাপ্তি। বেশ কয়েকবার সামনাসামনি সাক্ষাৎ-ও হয়েছে সুরসম্রাজ্ঞীর সাথে। ‘লতা গীতকোষ’-এর প্রথম খণ্ডের কাজ চলাকালীন সুরসম্রাজ্ঞীকে চিঠি লিখেছিলেন স্নেহাশিস। তখন তিনি বিশ্বভারতীর ছাত্র। শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেনের মতো সঙ্গীত ব্যক্তিত্বদের। লতার সঙ্গে ১৯৯৬সালে প্রথম চাক্ষুষ পরিচয় হয় যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। সেইসময় জনপ্রিয় প্রেজেন্টার হরিশ ভিমানী ও আদিনাথ মঙ্গেশকরের সহযোগিতায় তাঁর বহুকালের স্বপ্ন পূরণ হয়। সেদিন লতা স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় তাঁর কাজের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়ে ব্যক্তিগত ফোন নম্বর দিয়েছিলেন। সেই সূচনা, এরপর বহুবার ফোনে কথা হয়েছে। লতা তাঁর নিজের গানের তথ্যের প্রয়োজনেও ফোন করেছেন স্নেহাশিসকে।
একবার আঠাশে সেপ্টেম্বর লতা মঙ্গেশকরের জন্মদিনে স্নেহাশিস ফোন করে শুভেচ্ছা জানানোর সময় তাঁর নিজের কণ্ঠে একটি গান শোনাতে চেয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সুরসম্রাজ্ঞী তাতে সম্মতি জানিয়েছিলেন। সেদিন তিনি একটি দাদরা শুনিয়েছিলেন। তারপর প্রতিবছরই তাঁর জন্মদিনে লতার গাওয়া গান নিয়ে একটি সিডি তৈরি করে পাঠাতেন গবেষক স্নেহাশিস। যেন গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো। লতাও খুশি হতেন। ২০০৬ সালে কাজের প্রয়োজনে স্নেহাশিস মুম্বাইতে লতার বাড়ি প্রভুকুঞ্জে যান। সেখানে গিয়ে বিস্ময় বালকের মত সমস্ত বাড়ি ঘুরে দেখেন, এমনকি প্রিয় শিল্পীর কাছে তাঁর শোবার ঘরটিও দেখতে চান। লতা নিরাশ করেননি। তাঁর ঘরে একটি সিঙ্গেল খাট, একটি ছোট ওয়ারড্রব, একটি ড্রেসিং টেবিল— কোথাও কোনো আতিশয্য নেই। তাঁর গানের ঘরের বাইরের দরজায় টুপি পরা এক শিশুর ছবি আছে। যেখানে লেখা, ‘সাইলেন্স প্লিজ্, জিনিয়াস ইনসাইড’। এই লেখাটি গবেষককে খুব আকর্ষণ করেছিল। সুরসম্রাজ্ঞী স্নেহাশিসের গানের স্কুলের নামকরণ করেন ‘স্বরগঙ্গা’। একটি চিঠিতে ‘স্বরগঙ্গা’কে শুভেচ্ছাও জানিয়েছিলেন।
১৯৯৭ সালে লতা মঙ্গেশকর বিশ্বভারতীতে আসেন দেশিকোত্তম সম্মান নিতে। সেইদিন তাঁর অনুরাগী ভক্তদের অনুরোধে গান করেন সরস্বতী বন্দনা। সেইসময় সাধারণ মানুষের হাতে ছিল না মুঠোফোন। তাই সাধারণ মানুষ সেই গান রেকর্ড করতে পারেননি। তবে গবেষক স্নেহাশিস চট্টোপাধ্যায় অনেক খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ গানটি রেকর্ড করেছেন। সেই গানটিও তিনি সংগ্রহ করে রেখেছেন তাঁর আর্কাইভে।
স্নেহাশিস চট্টোপাধ্যায়ের ‘লতা গীতকোষ’ গ্রন্থ এখনও পর্যন্ত ১২টি খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে আছে ৫৭৩০টি গানের তথ্য। এই খণ্ডগুলিতে বাংলা, হিন্দি (১৯৪৫-১৯৯০), মারাঠি ভাষার গানের বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। তাঁর এই বইগুলির ভূমিকা লিখেছেন মান্না দে, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সবিতা চৌধুরী, যশ চোপড়া, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, এ.আর.রহমানের মতো প্রথিতযশা ব্যক্তিগণ। ২০০২ সালে গবেষকের সঙ্গে লতার সাক্ষাৎ ঘটে তাজবেঙ্গল হোটেলে। সেখানেই কথোপকথন সূত্রে লতা খবর নেন মারাঠি গানের কাজ কতদূর এগিয়েছে সে বিষয়ে। বহু ভাষায় সংগীতসাধনা করলেও মাতৃভাষার প্রতি সকলের মতনই তাঁরও দুর্বলতা ছিল তা বোঝা যায়।
লতার জীবদ্দশায় তাঁর শেষ জন্মদিনে (২০২১) গবেষক স্নেহাশিসের উপহার ছিল মারাঠি ভাষায় গাওয়া গানের সম্পূর্ণ সংকলন – ‘লতা গীতকোষ’ (খণ্ড-১২)। এই বইটির প্রচ্ছদ তৈরি হয়েছে তেরো বছর বয়সের লতা মঙ্গেশকরের ছবি দিয়ে।
লতার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত ‘লতা গীতকোষ’ গ্রন্থে গবেষক তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। বাকি খণ্ডগুলি তিনি লতার হাতে তুলে দিতে পারবেন না— সেটি তাঁর কাছে কষ্টেরও বটে।
আমাদের বাঙালির গর্ব, পশ্চিমবঙ্গবাসীর গর্ব শ্রীরামপুরের স্নেহাশিস চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর গড়ে তোলা ‘লতা মঙ্গেশকর আর্কাইভ’। এই আর্কাইভ যেন এক মন্দির, সেই মন্দিরের দেবী হলেন লতা মঙ্গেশকর, আর পূজারী হলেন লতা-গবেষক স্নেহাশিস চট্টোপাধ্যায়।
গবেষক স্নেহাশিস আশা রাখেন, ভবিষ্যতে লতার গান নিয়ে আরও অনেক গবেষণা হবে এবং তাঁর একান্ত অনুরোধ লতা অনুরাগীরা একবার হলেও ‘লতা মঙ্গেশকর আর্কাইভ’ দর্শন করুন। স্নেহাশিসের গড়ে তোলা ‘আর্কাইভ’ এবং ‘লতা গীতকোষ’ ভাবী প্রজন্মের জন্য এক অমূল্য সম্পদ হয়ে উঠবে।
Powered by Froala Editor