খবরটা চোখে পড়তেই সেদিন শিউরে উঠেছিল আমেরিকার নাগরিকরা। কী করে নৃশংস হতে পারে এত বড়ো মাপের একজন মানুষ? শুধুমাত্র সন্দেহের বশে স্ত্রীকে গুলি করার মতো ঘৃণ্য অপরাধের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত অবশ্যই। প্রমাণ তো সব হাতের কাছেই আছে। শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। তারপর রাজকীয় জীবন ত্যাগ করে আজীবন কাটাতে হবে অন্ধ কারাগারে। কিংবা হয়তো মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে গ্রিফিথ জেঙ্কিনস গ্রিফিথের (Griffith Jenkins Griffith)। কিন্তু যে সাজা ঘোষণা করা হয়েছিল তাঁর জন্য, তা আরো আশ্চর্য করেছিল সাধারণ মানুষকে। আইনজীবী আর্ল রজার্সের (Earl Rogers) বুদ্ধিমত্তার সামনে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল আমেরিকার বিচারব্যবস্থাকে।
গল্পটা শুরু করা যাক গ্রিফিথের জীবনকাহিনি দিয়ে। ওয়েলস থেকে ১৮৬৫ সালে যখন তিনি আমেরিকার পেনসিলভেনিয়াতে পৌঁছোন, তখন তাঁর কপর্দকশূন্য অবস্থা। বিরাট দেশে না আছে কোনো পরিচিত, না কোনো নির্দিষ্ট থাকার জায়গা। কিছুদিন কাজ করলেন বিভিন্ন সংবাদসংস্থায়। মূলত নেভাদার খনি অঞ্চলের খবর নিয়েই ছিল কাজকর্ম। আর সেভাবেই ব্যাপক অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন খননকার্য এবং সেই সংক্রান্ত ব্যবসা বিষয়ে। বেশিদিন সময় লাগল না ভাগ্য ফিরতে। ১৮৮২ সালের মধ্যে তিনি হয়ে গেলেন কোটিপতি। বিয়ে করলেন ম্যারি অ্যাগনেস ক্রিশ্চিনা মেসমারকে (Mary Agnes Christina Mesmer)। যিনি ছিলেন সে সময়ের লস এঞ্জেলসের অন্যতম ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের কন্যা। সবই চলছিল ঠিকঠাক। বিলাসবহুল জীবনযাত্রার পাশাপাশি দানধ্যানের জন্যও খ্যাতি ছিল দুজনের। কয়েক হাজার একর জমির উপর গড়ে তুললেন ‘গ্রিফিথ পার্ক’। জানালেন, এই শহর তাঁকে যা দিয়েছে, তার উন্নতির জন্য এটি তাঁর তরফ থেকে সামান্য উপহার।
তবে গ্রিফিথ কখনই ভুলতে পারেননি যে, তিনি আসলে এই দেশের মানুষ নন। বিরোধীপক্ষের লোকেরাও বারবার এই বিষয়টি তুলে তাঁকে ভুলতেও দেয়নি কোনোদিন। অর্থ উপার্জন কিংবা উচ্চবংশে বিবাহ, কোনোটাই তাঁকে প্রাপ্য সামাজিক সম্মান দেয়নি আমেরিকার মাটিতে। তাছাড়া প্রায়ই পরিহাসের পাত্র হতেন কম উচ্চতার জন্য। মুখে যাই বলুন না কেন, একটা তীব্র ঘৃণা সব সময়েই পুষে রাখতেন মনের মধ্যে। তার সঙ্গে ছিল অর্থের অহংকার। যেন টাকা দিয়েই তিনি জয় করে নিতে পারেন গোটা আমেরিকাকে। গ্রিফিথের চরিত্রের গুণপনা এখানেই শেষ নয়। চূড়ান্ত মদ্যপ ছিলেন তিনি। আর মাদকাসক্ত অবস্থায় তাঁর অপমানের হাত থেকে রেহাই পায়নি কোনো পরিচিত ব্যক্তি। অবশেষে শুরু করেন স্ত্রীর উপর সন্দেহ।
১৯০৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ছুটি কাটাতে দুজনেই তখন সান্টা মনিকাতে। অধিকাংশ সময়েই মদ্যপ হয়ে থাকতেন গ্রিফিথ। বচসা বাড়তেই গুলি চালান স্ত্রীকে লক্ষ্য করে। টলমল হাতের নিশানা ফসকে গেল সামান্যের জন্য। বুলেট ক্রিশ্চিনার বাঁ চোখ ভেদ করে ঢুকে গেলেও প্রাণে বেঁচে গেলেন কোনোরকমে। খুব একটা দেরি হল না গ্রিফিথকে গ্রেপ্তার করতে। ক্রিশ্চিনার সাক্ষ্য এবং ঘটনার প্রমাণ দেখে সকলেই নিশ্চিত ছিল যে অন্তত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা তাঁকে ভোগ করতেই হবে। আর সেখানেই প্রবেশ ঘটল আর্ল রজার্সের।
আরও পড়ুন
‘ভূত’ হয়ে নিজেরই খুনের তদন্ত! আজও রহস্যে মোড়া এই কাহিনি
১৮৯৭ সাল থেকে ওকালতি শুরু করলেও, কয়েক বছরের মধ্যেই খ্যাতির চূড়ান্তে পৌঁছে গেছিলেন আর্ল। সারা জীবনে ৭৭টি হত্যাকাণ্ডের মামলায় জিতেছিলেন ৭৪টি। গ্রিফিথের মামলায় তিনি কিন্তু হত্যার চেষ্টাকে অস্বীকার করেননি, বরং প্রমাণ করলেন যে গ্রিফিথ আসলে মাদকাসক্ত। আর এই সমস্ত ঘটনা ঘটেছে বিকারগ্রস্ত অবস্থাতে। ফলে অবিলম্বে তাঁর চিকিৎসা প্রয়োজন। গ্রিফিথের নেশার ব্যাপারে অবগত ছিল সবাই। ক্রিশ্চিনাও বারবার বলেছে যে মদ্যপান করলেই যেন অন্য মানুষ হয়ে যান গ্রিফিথ। ফলে ঘুরে গেল মামলার রায়। হত্যার চেষ্টায় অভিযুক্ত নয়, বরং তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হল বিকারগ্রস্ত অবস্থায় বিপজ্জনক অস্ত্রসহকারে আক্রমণের অভিযোগে। সাজা হল মাত্র দু’বছরের।
আরও পড়ুন
সহস্রাধিক মানুষকে খুন, নাক কেটে শাস্তি দিত বাস্তবের গব্বর সিং
জেল থেকে বেরিয়ে অবশ্য নিজেকে অন্যভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন গ্রিফিথ। যুক্ত ছিলেন জনসেবার কাজেও। কিন্তু আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আর্ল রজার্সের কী পরিণতি হল? যে যুক্তিতে বাঁচিয়েছিলেন তাঁর মক্কেলকে, সেই নেশায় ক্রমে ডুবে গেলেন তিনি। গ্রিফিথের মামলার আশ্চর্য সাফল্যের ফলে হয়ে উঠলেন অত্যন্ত অহংকারী। যেন গ্রিফিথের চরিত্রের সমস্ত বৈশিষ্ট্য ভর করল তাঁর উপরে। ‘মদ’ রিপু গ্রাস করল তাঁর ব্যক্তিগত জীবন আর কর্মজগতকে। ১৯২২ সালে অতিরিক্ত মদ্যপানের প্রভাবে মারা যান তিনি।
তার ঠিক দশ বছর পরে প্রকাশিত হয় ‘দ্য কেস অফ দ্য ভেলভেট ক্লস’ নামের একটি বই। লেখকের নাম এরলে স্ট্যানলি গার্ডনার (Erle Stanley Gardner)। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন আইনজীবী পেরি ম্যাসনের (Perry Mason) অদ্ভুত ‘কেস’-এর বিবরণ ধরা রইল সেখানে। পরবর্তী ৯০ বছরে ৭০টি উপন্যাস, রেডিও ও টিভি সিরিজে কালজয়ী হয়ে উঠল চরিত্রটি। আর্লের জীবন ও কাজকর্মের ছায়াতেই তৈরি হয়েছিল এই চরিত্র। কিন্তু নামটি ‘পেরি’ কেন? কারণ, আর্লের জন্মস্থান নিউ ইয়র্কের পেরিতে। জীবন থেকে বিনোদনের বহু মাধ্যমে অমর হয়ে রইল তাঁর বর্ণময় চরিত্র।
Powered by Froala Editor