চল্লিশের দশকের শেষের দিক। নিজের ঘরে বসে কাজ করছেন শচীন দেববর্মণ। স্ত্রী মীরাও কাজে ব্যস্ত। তারই মধ্যে গুনগুন করছে শচীন-মীরার আদরের সন্তান, পঞ্চম। প্রথমে অবশ্য নাম ছিল টুবলু; পরে সেটাই বদলে গেল পঞ্চমে। নামেই যার সুর, তাঁর কাজও যে সুর নিয়েই হবে তাতে আর আশ্চর্য কোথায়! না, অবাক হওয়ার এখনও বাকি আছে।
পঞ্চমের তখন মাত্র নয় বছর বয়স। হঠাৎ সেই ছোট্ট ছেলেটি আপনমনেই তৈরি করে ফেলল একটি গান। শচীনকর্তা তো অবাক! মাত্র নয় বছর বয়সেই তৈরি করে ফেলল আস্ত একটা গান। আর তা নেহাৎ ফেলনার নয়! ১৯৫৬ সাল। ‘ফান্টুস’ ছবির সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে শচীনকর্তা। তখনই মনে পড়ল বেশ কিছু বছর আগে ছোট্ট পঞ্চমের তৈরি করা প্রথম গানটি। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে ওই সিনেমার সঙ্গে জুড়ে দিলেন। গানটি ছিল ‘অ্যায় মেরে প্যায়ারি টোপি পালাট কে আ’। ধীরে ধীরে সেই ছোট্ট পঞ্চম বড়ো হল। আর তাঁর হাত ধরেই বলিউডের প্লেব্যাক জগতে একটা বড়ো বাঁক এল। রাহুল দেববর্মণ (সংক্ষেপে আরডি) সেই বাঁকেরই অন্য নাম, একটি জলজ্যান্ত অধ্যায়।
একটা সময় বলা হত, আরডি ফ্যানের আওয়াজ থেকেও সঙ্গীত তুলে আনতে পারেন। অতি সামান্য, তুচ্ছ শব্দকেও সুরের রূপ দিতে পারেন। কথাগুলো একেবারেই কল্পনা নয়। ‘শোলে’র কথাই মনে করুন। সেই বিখ্যাত গান ‘মেহবুবা মেহবুবা’-এ রাহুল ব্যবহার করেছিলেন ফাঁকা বিয়ারের বোতল। সেই বোতলের মুখে ফুঁ দিয়ে সেই সঙ্গীতটি তৈরি করা। এবং যতবারই এই গানটির কথা বলা হয়, সেই দৃশ্যটিই সামনে ভেসে আসে। ‘সাত্তে পে সত্তা’ সিনেমায় একটি গানে গায়িকাকে দিয়ে গারগেলও করিয়েছিলেন। বৃষ্টির শব্দ রেকর্ড করবেন বলে কোনো কৃত্রিম উপায়ের সাহায্য নেননি তিনি। সত্যিকারের বৃষ্টি পড়ার সময়, সারারাত বাড়ির বারান্দায় ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন; স্রেফ রেকর্ড করবেন বলে। এমন ভাবনা এবং নিষ্ঠা এর আগে কি খুব একটা এসেছিল? সঙ্গীতবোদ্ধারা অবশ্য বলেন, আরডি না থাকলে এসব কিছু হতই না…
প্রতিভা তো ছিলই। আর তাঁর সদব্যবহারও করেছেন রাহুল দেববর্মণ। এমনই সদব্যবহার করেছেন যে, স্বপ্নের মধ্যেও সুর এসে ধরা দিত। তৎক্ষণাৎ উঠে সেটা ঝালিয়ে নিতেন। আর গান? ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে একের পর এক হিট গান দিয়েছেন ভারতীয় সিনেমাকে। সেই গান এখনও ভুলতে পারেনি কেউ। রাহুল দেববর্মণ আজ কিংবদন্তি। বলিউডের এমন এক নক্ষত্র, যাকে কেউই কোনো কালে অস্বীকার করতে পারেনি। কিন্তু তাঁর শেষের দিনগুলো? আরডি’র জীবনের দিকে তাকালে বড়ো বেশি করে চোখে পড়ে ওইসব। এতটা অবহেলা কি প্রাপ্য ছিল তাঁর?
আশি-নব্বইয়ের দশক। বলিউডে পা রেখেছেন নতুন সব পরিচালক। প্রত্যেকের অনুপ্রেরণা একজনই— পঞ্চম দা। কিন্তু পঞ্চম তখন কী করছেন? অনেক ছবিতেই সুর দিচ্ছেন বটে; কিন্তু সেসব করতে হয় বলে। সেরকম কাজ আর আসছে না তাঁর কাছে। অথচ মানুষটা সর্বক্ষণ সুরের মধ্যে ডুবে আছে। নতুন নতুন সুর তৈরি করছেন, নিয়ে আসছেন নতুন স্বাদ। কিন্তু তাঁকে বোঝার কেউ নেই! ব্যক্তিগত জীবনও সুখী হল না। মুম্বইয়ের বাড়িতে আহত, একা সম্রাটের মতো বসে থাকতেন আরডি।
এমন সময় একটি সিনেমার অফার নিয়ে এলেন বিধু বিনোদ চোপড়া। এদিকে আরডি’র শরীরও ভেঙে গেছে অনেক, হার্ট দুর্বল। তবুও রাজি হলেন রাহুল দেববর্মণ। কাজ করলেন জীবনের শেষ ছবিতে, ‘১৯৪২ আ লাভ স্টোরি’-তে। সঙ্গে সঙ্গে আপনার মনের মধ্যে বেজে উঠল কয়েকটি গান। ‘কুছ না কাহো’, ‘প্যায়ার হুয়া চুপকে সে’, এবং সর্বোপরি ‘এক লড়কি কো দেখা জো অ্যায়সা লাগা’। বলিউডের সর্বকালের সেরা প্রেমের গানের মধ্যে প্রথম সারিতে থাকবে এটি। এবং এই সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনার জন্যই শেষ ফিল্মফেয়ার পুরস্কারটি পান পঞ্চম।
আরও পড়ুন
ভালো লাগছে না মুম্বাই, সব ছেড়ে কলকাতায় ফিরতে চেয়েছিলেন শচীন কর্তা!
কিন্তু, ঘড়ির কাঁটা যেন জানান দিচ্ছিল আসল মুহূর্তের। এই পুরস্কারপ্রাপ্তি দেখে যেতে পারেননি রাহুল দেববর্মণ। ৪ জানুয়ারি, ১৯৯৪। শক্তি সামন্তের বাড়ির পার্টি থেকে ফিরে এলেন তাড়াতাড়ি। কয়েকদিন আগেই বাইপাস সার্জারি হয়ে গেছে। তবুও, আরডি তো আরডি-ই। ঘরে এসে সেই যে শুলেন, আর উঠলেন না। ভারতের সঙ্গীতের আকাশ থেকে খসে পড়ল উজ্জ্বল একটি তারা। সত্যিই গেলেন কি!
তথ্যসূত্র-
১) ‘TBI Blogs: Did you know he composed his first song at 9? More interesting facts about RD Burman’, The Better India
২) ‘সবকিছু থেকেও কেন সঙ্গীহীন, সহায়হীন, কপর্দকশূন্য হয়ে চলে গেলেন আরডি বর্মণ’, শর্মিলা মাইতি, এবেলা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
অভিমান বুকে নিয়েই অকালপ্রয়াণ আরডি-র, মৃত্যুর পর পেয়েছিলেন ফিল্মফেয়ার