৪ ডিসেম্বর, ১৯০৮। এক রাজদ্রোহী কবির বিরুদ্ধে মামলা চলছে খুলনা আদালতে। আর সেই মামলায় রাজসাক্ষী নাকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অন্তত আদালতের রেকর্ড তাই বলে। যদিও যে কবিতার বইয়ের বিরুদ্ধে মামলা, সেটা উৎসর্গ করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথকেই। তাই ছোটলাট অ্যান্ড্রু ফ্রেজারের মতলব ছিল রবীন্দ্রনাথকেও কাঠগড়ায় তোলা। কিন্তু সরকারপক্ষের আইনজীবী জানালেন, তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রুজু করলে তা আইনত টিকবে না। তাই কবিগুরুকে রাজসাক্ষী করার ব্যবস্থা। যাতে তাঁর মুখ দিয়েই বলিয়ে নেওয়া যায়, কবিতাগুলি যথেষ্ট আপত্তিকর।
এর মধ্যেই হাজিরার দিন আদালতে পৌঁছতে একটু দেরি হয়ে গেল রবীন্দ্রনাথের। কলকাতা থেকে খুলনা গিয়ে হাজিরা দেওয়া তো আর সহজ নয়। তাঁর দেরি দেখে বিচারক শমন পাঠানোর উদ্যোগ নিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ঠিক সময়ে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত হলেন রবীন্দ্রনাথ। তবে ব্রিটিশ সরকারের ফন্দি সেখানে আদৌ টেকেনি। আদালতে উপস্থিত বৃদ্ধ উকিল কালিপদ রায় জানিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তখন আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন -- স্বাধীনতাকাঙ্ক্ষী তরুণের পক্ষে উত্তেজক কবিতা বা গান লেখা আদৌ অস্বাভাবিক নয়। ওকালতি তার পেশা নয়, সুতরাং কবিতা বা গান কী পরিমাণ উত্তেজক হলে সেটা আইনত দণ্ডনীয় হবে সেটা তাঁর জানা নেই।
সেই মামলায় অবশ্য আসামী দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। বিচারে তাঁর কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। সেই কবির নাম ছিল হীরালাল সেন। খুলনার সেনহাটী জাতীয় বিদ্যালয়ের (বর্তমান দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটী গ্রাম) শিক্ষক ছিলেন হীরালাল সেন। ১৯০৮ সালে প্রকাশ পায় তাঁর লেখা কবিতার বই ‘হুঙ্কার’। দেশ তখন স্বাধীনতার নতুন স্বপ্ন দেখছেন। আর সেই স্বপ্ন জ্বেলে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়েই।
রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অবশ্য কখনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কিন্তু পুলিশের সন্দেহভাজনের তালিকায় তাঁর নাম ছিল। লালবাজারের খাতায় তাঁর পরিচয় ছিল, ‘Robi Tagore, I. B. Suspect Number 11’। শোনা যায় জোড়াসাঁকো থেকে কবি রাস্তায় পা দিলেই গুপ্তচর মারফত খবর পৌঁছে যেত হেড-অফিসে। বিশেষ করে পুলিশের সন্দেহ ছিল, বিপ্লবী আন্দলনের জন্য বিদেশ থেকে যেসব অস্ত্রশস্ত্র এসে পৌঁছচ্ছে তার সঙ্গেও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অবশ্য এই পর্যায়ের বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও অস্ত্র আদানপ্রদানের ব্যাপারে তাঁর জড়িত থাকার কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু জাপানে গিয়ে কবি বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন বলেও সন্দেহ হয় পুলিশের।
আরও পড়ুন
পাবজি-ফৌজি চর্চা, রবীন্দ্রনাথ ও কিছু 'হযবরল'
১৯০৮ সালে কারাদণ্ড দেওয়া হয় হীরালাল সেনকে। মুক্তি পান ১৯১০ সালে। তাঁর মুক্তির পরেই অবশ্য যোগাযোগ করেন রবীন্দ্রনাথ। নিয়ে আসেন শান্তিনিকেতনে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মচর্যাশ্রমে। সেখানে তখন শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত অনেকেই পুলিশের তালিকায় সন্দেহভাজন। এঁদের মধ্যে ছিলেন কালীমোহন ঘোষ, নগেন্দ্রনাথ আইচ প্রমুখ। এর মধ্যেই হীরালালের আগমন রীতিমতো চিন্তায় ফেলেছিল ব্রিটিশ সরকারকে। রবীন্দ্রনাথ কি তাহলে রাজদ্রোহের টোল খুলে বসলেন? আইনি পথে অবশ্য এই বিদ্যালয় বন্ধ করা যায় না। তাই শেষ পর্যন্ত সমস্ত সরকারি কর্মচারীর কাছে নির্দেশ পৌঁছল, তাঁরা যেন কোনভাবেই নিজেদের সন্তানদের সেখানে ভর্তি না করেন।
তবে শেষ পর্যন্ত পুলিশের উৎপাতে বাধ্য হয়ে হীরালালকে ব্রহ্মচর্যাশ্রম থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে নিয়োগ করলেন জমিদারির কাজে। তবে সেদিন যে আসামীর ‘বিরুদ্ধে’ সাক্ষী দিতে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর সঙ্গে পরবর্তীকালে বেশ মধুর সম্পর্কই গড়ে উঠেছিল।
আরও পড়ুন
বিশ্বভারতী এবং একটি পাঁচিল: রবীন্দ্রনাথের শিক্ষারীতির ভিতটাই দুর্বল হয়ে পড়ছে কি?
রবীন্দ্রনাথ নিজে অবশ্য সাহিত্যচর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু সেই সাহিত্য তো সময়ের ডাককে অস্বীকার করে নয়। আর তাই উত্তাল সময়ের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল বরাবরই। ফলে পুলিশের সন্দেহ যে একেবারে অমূলক ছিল, একথা বলা যায় না। কিন্তু আইনি পদক্ষেপ তাঁরা কিছুই নিতে পারেননি। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের বই নিষিদ্ধ না হলেও নিষিদ্ধ হয়েছিল বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিদ্রোহী রবীন্দ্রনাথ’ বইটি (১৯৩২)। এরপর রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’-র উপরেও কড়া নজর ছিল গোয়েন্দা বিভাগের। সেই বই বাজেয়াপ্ত না হলেও বাজেয়াপ্ত হয়েছিল সমালোচনামূলক লেখা ‘সর্বহারার দৃষ্টিতে রাশিয়ার চিঠি’ (১৯৩৬)।
আসলে কবিতা তো সবসময়ই লড়াইয়ের অস্ত্র। অথচ অস্ত্র আইনে বোমা-পিস্তল এমনকি দা-কাটারিও নিষিদ্ধ করা যায়। কিন্তু কবিতার বিরুদ্ধে তো অস্ত্র আইন চলে না। তেমনই কবির বিরুদ্ধেও মামলা রুজু করা সহজ নয়। অবশ্য কবিতায় যদি সমকালের কথা উঠে আসে, তাহলে শাসক রাজদ্রোহের আইনে তাঁকে শাস্তি দিতে পারে। কিন্তু যে কবিতা সর্বকালের নিপীড়িত মানুষের কথা বলে, তার বিরুদ্ধে এমন আইনও টেকে না। রবীন্দ্রনাথের কবিতা সেইরকমই। তিনি নজরুলের মতো গর্বিত ‘হুজুগের কবি’ নন। কিন্তু যুগযুগান্তরের মানুষের মুক্তির কবি।
আরও পড়ুন
‘এ দেশে হতভাগা মানুষের সমস্ত প্রাপ্য দেবতা নিচ্চেন হরণ করে’, ক্ষুব্ধ রবীন্দ্রনাথ
তথ্যসূত্রঃ
ব্রিটিশ শাসনে বাজেয়াপ্ত বাংলা বই, শিশির কর
রবিজীবনী, প্রশান্ত কুমার পাল
রবীন্দ্রনাথ ও বিপ্লবী সনাজ, চিন্মোহন সেহানবীশ
কাঠগড়ায় রবীন্দ্রনাথ, প্রথম আলো
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
বৃষ্টিভেজা শ্রাবণে প্রয়াত রবীন্দ্রনাথ, শেষযাত্রার ধারাবিবরণী দিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র