মাত্র কয়েকমাস আগের কথা। যুক্তরাষ্ট্রে বক্তৃতা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন কিংবদন্তি লেখক সালমান রুশদি। নেপথ্যে তাঁর গ্রন্থ ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’। বলতে গেলে এই গ্রন্থের বিষয়বস্তুই তাঁকে ‘শত্রু’ করে তুলেছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলিতে। বিশেষত, আরবের রাষ্ট্রে। আজও ইরান-সহ একাধিক দেশেই নিষিদ্ধ তাঁর এই কালজয়ী গ্রন্থ। তা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলি প্রতিবাদে সামিল হয়েছে ঠিকই, তবে সেখানেও কি সবসময় সাদর আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সাহিত্যকে?
এই প্রশ্নই ঘুরে ফিরে আসে র্যাডক্লিফ হলের লেখা ‘দ্য ওয়েল অফ লোনলিনেস’-এর (The Well Of Loneliness) প্রসঙ্গ উঠলে। বিশ শতকের কুড়ির দশকে এই গ্রন্থ সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা ইউরোপেই। এমনকি ব্রিটেনে তৈরি করা হয়েছিল বিশেষ ডিভিশন বেঞ্চে। মামলা করেছিলেন হাজার হাজার মানুষ। শেষ পর্যন্ত ঘটা করেই নিষিদ্ধ করা হয় এই গ্রন্থটি। কিন্তু কী কারণে বিতর্কের ভাগীদার হয়ে ওঠে এই উপন্যাস?
১৯২৮ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থটির মূল চরিত্র স্টিফেন গর্ডন। নামটা শুনে হয়তো মনে হতে পারে, ইনি একজন পুরুষ। তবে ব্যাপারটা ঠিক তার উল্টো। গর্ডন একজন মহিলা। তবে তাঁর চারিত্রিক আচার-আচরণ পুরুষদের মতোই। ছোটো থেকেই তাঁর ভালো লাগে পাড়ার তরুণীদের কিংবা স্কুলের বান্ধবীকে। ছোটো করে চুল কাটতে কিংবা পুরুষালী পোশাক পরতে ভালোবাসেন তিনি। নিয়ম করে প্রতিদিন হাজির হন জিমে। পুরুষালি স্বভাবের কারণেই একটা সময় বাড়ি থেকে বহিষ্কৃত হন স্টিফেন। কার্যত তাঁকে এক ঘরে করে ব্রিটিশ সমাজও। শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সে পালিয়ে যান তিনি। সেখানেই অ্যাম্বুলেন্স-চালিকার সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। গড়ে ওঠে সম্পর্ক।
হ্যাঁ, লেসবিয়ানিজম বা সমকামিতাই এই গ্রন্থের বিষয়। যে-সময়ের কথা হচ্ছে তখন ইংল্যান্ডে সমকামিতা যে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ এমনটা নয়। যুক্তরাজ্যে, গে বা পুরুষ-পুরুষের সম্পর্কই কেবলমাত্র অপরাধ বলে বিবেচিত হত তৎকালীন সময়ে। অন্যদিকে লেসবিয়ানিজম আইনত নিষিদ্ধ না হলেও, বিষয়টিকে খানিকটা বাঁকা চোখেই দেখত সমাজ। র্যাডক্লিফের ভাষায় বলতে গেলে, লেসবিয়ানিজম নিয়ে সর্বদাই নিস্তব্ধতা বিরাজ করত দেশজুড়ে।
এই মানসিকতাতেই বদল আনতে চেয়েছিলেন র্যাডক্লিফ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরই এই গ্রন্থের প্রেক্ষাপট সাজানো হয়ে গিয়েছিল তাঁর। অবশ্য এমন একটি বিতর্কিত বিষয় নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশের সাহস পাননি প্রথমে। ১৯২৬ সালে বেস্টসেলারের মুকুট ওঠে তাঁর উপন্যাস ‘অ্যাডাম’স ব্রিড’-এর মাথায়। পেয়েছিলেন প্রিক্স ফেমিফা এবং জেমস টেইট ব্ল্যাক প্রাইজ। এই বিপুল জনপ্রিয়তার পরই এই গ্রন্থের মূল কাজ শুরু করেন র্যাডক্লিফ।
তবে এতকিছুর পরেও খুব একটা সুবিধা হয়নি তাঁর। গ্রন্থ প্রকাশের কয়েকদিনের মধ্যেই তুমুল ঝড় ওঠে যুক্তরাজ্য-জুড়ে। নিষিদ্ধ হয় ‘দ্য ওয়েল অফ লোনলিনেস’। জানানো হয়েছিল, এই গ্রন্থ ‘নষ্ট’ করে দিতে পারে একটা গোটা দেশের যুবসমাজকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই গ্রন্থকে ছাড়পত্র দিলেও, সে-দেশেও খুব বেশি সরবরাহ করা হয়নি এই বই-এর কপি। এর প্রায় তিন দশক পর, ষাটের দশকের শুরুর দিকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় ব্রিটেন। প্রথমবার সর্বসমক্ষে আসে র্যাডক্লিফের গ্রন্থটি।
তবে বিতর্ক থামেনি। সত্তর-আশির দশকেও একাধিক সমাজকর্মী ও মনোবিদ প্রশ্ন তুলেছিলেন র্যাডক্লিফের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। অভিযোগ উঠেছিল, মিসোজিনিস্টিক ফ্রেমেই তিনি ধরেছেন লেসবিয়ানিজমকে। যা সম্পূর্ণ সত্যি নয়। পাশাপাশি সমকামী সম্পর্কের মধ্যেও যে আনন্দ লুকিয়ে থাকে, তা নাকি সঠিকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেননি র্যাডক্লিফ।
‘দ্য ওয়েল অফ লোনলিনেস’ প্রকাশের ৯০ বছর বাদে, ২০১৯ সালে একটি বিশেষ গবেষণা চালানো হয় এই গ্রন্থটির ওপর। সেই সুবাদেই প্রথমবারের জন্য প্রকাশ্যে আসে তৎকালীন সময়ে ব্রিটিশ বিচারকদের কাছে জমা পড়া অজস্র চিঠি। অভিযোগের পাশাপাশি সে-সব চিঠিতে অনায়াসেই খুঁজে নেওয়া যায় আশ্বাসবাণীর কথাও। অর্থাৎ, ঠিক-ভুলের ঊর্ধ্বে গিয়ে বহু সমকামী নারীর দৈনিক যন্ত্রণাকে স্পর্শ করতে পেরেছিল এই গ্রন্থ তাঁতে সন্দেহ নেই কোনো। সন্দেহ নেই, এই গ্রন্থ আওয়াজ তুলেছিল সমকামী অধিকার নিয়ে। যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ থেকে সুদূর মেক্সিকো পর্যন্ত। আজ একুশ শতকে দাঁড়িয়ে যেখানে কাতার বিশ্বকাপে ‘হারাম’ সমকাম, হাজার হাজার প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষ লড়াই করে যাচ্ছেন অধিকার আদায়ের জন্য, সেখানে আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগেই এই গ্রন্থ-ভাবনা সত্যিই অবাক করে যে-কাউকেই…
Powered by Froala Editor