কলকাতার মাত্র কয়েকশো বছরের ইতিহাসের মধ্যেই এমন অজানা সব তথ্য লুকিয়ে আছে, আজকাল সেগুলো কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু সেইসব ইতিহাসের অকাট্য প্রমাণ হিসাবে থেকে গিয়েছে বিভিন্ন সংবাদপত্র। বিশেষ করে বিজ্ঞাপন অংশের দিকে তাকালে রীতিমতো অবাক হতে হয়।
১৭৯২ সালে 'ক্যালকাটা গেজেট' পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপনের কথাই ধরা যাক। জানা যাচ্ছে, ১ নং পারকিন্স লেনের একটি বাড়ি থেকে বছর ১৫ বয়সের এক ক্রীতদাস পালিয়ে গিয়েছে। কোনো 'মহানুভব' ব্যক্তি যদি সেই বালকটিকে মালিকের হাতে তুলে দেন, তাহলে ৫০ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। এখন বালকটিকে চিনবেন কী করে? ক্রীতদাস হওয়ার কারণেই তার হাতে পায়ে আছে মোটা লোহার বেড়ি। সেই বেড়ি যদি খুলেও ফেলে, তাহলেও পায়ে আছে একটি কালো দাগ এবং হাতে ও পিঠে অনেকগুলি পোড়া দাগ। স্পষ্টই বোঝা যায়, এসবই তার উপর অত্যাচারের চিহ্ন। এমন অমানবিক অত্যাচারের মধ্যেই দিন কাটত ক্রীতদাসদের। তাও খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। মাত্র দুশো বছরের কিছু আগে কলকাতা শহরেই এমন দৃশ্য দেখা যেত।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো ভারতবর্ষেও ক্রীতদাস প্রথার ইতিহাস বেশ পুরনো। কখনো কখনো তা ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়েছে, আবার কখনো খানিকটা কমেছে। তবে সম্পূর্ণ নির্মূল হয়ে যায়নি কখনোই। ইংরেজরা যখন এদেশে আসে, তখন তারা এই প্রথার সঙ্গে পরিচিত হয়। তাছাড়া ইউরোপের দেশগুলোতেও ততদিনে আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা 'নিগ্রো'দের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। শিক্ষিত রুচিবান ইংরেজরা তাই এই অমানবিক প্রথা নির্মূল করার চেষ্টা করলেন, একথা মনে করলে বেশ ভুল হবে। বরং এদেশে ক্রীতদাস প্রথা রীতিমতো প্রাণ ফিরে পেয়েছিল ব্রিটিশদের হাত ধরেই। লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংসের সময়কার দুটি আইনি নির্দেশের কথা বলা যায়। প্রথমটিতে বলা হয়েছিল, যেসব ডাকাতদের ফাঁসি দেওয়া হবে তাদের পরিবারের লোকজন রাষ্ট্রের দাস হয়ে থাকবে এবং সরকার যেখানে খুশি তাদের ব্যবহার করতে পারবে। অন্য একটি নির্দেশে বলা হয়, সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের অযথা জেলখানায় ভরে না রেখে তাদের বিভিন্ন জায়গায় গোলাম হিসাবে ব্যবহার করা যায়।
'গোলাম', এই ছিল তখনকার ক্রীতদাসদের পোশাকি নাম। কাজকর্ম করতে হত সাধারণ ভৃত্যদের মতোই। তবে কোনোরকম মানবিক অধিকারই তাদের ছিল না। মালিকের ইচ্ছে অনুযায়ী সমস্ত কাজ করতে হত। জীবনে ছুটি অবশ্য একবার পাওয়া যেত, সেটা মৃত্যুর সময়। প্রাথমিকভাবে এদেশের মানুষদেরই গোলাম হিসাবে ব্যবহার করা হত। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, ভারতীয়দের প্রতি ইংরেজদের একটা প্রচ্ছন্ন সম্ভ্রম ছিল। অন্যান্য উপনিবেশে যার ছিঁটেফোঁটাও দেখা যায়নি। তাই এদেশে অনেক আফ্রিকান ক্রীতদাসকে নিয়ে আসা হয়েছিল।
১৭৬৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডিরেক্টরের লেখা একটি চিঠি থেকে জানা যায়, মাদাগাস্কার থেকে একটি জাহাজ কলকাতা এসে পৌঁছবে। তাতে যতগুলি সম্ভব গোলাম পাঠানো হবে। এবং কলকাতায় প্রতিটি গোলামের দাম হবে ১৫ পাউন্ড। অর্থাৎ মাদাগাস্কার দ্বীপ থেকে মানুষ কিনে তাকে কলকাতায় ক্রীতদাসের কাজে লাগানো হবে। ১৭৬৪ সালেও অনুরূপ গোলাম কেনাবেচার কথা জানা যায়।
দেখতে দেখতে বাংলায় গোলাম কেনাবেচার বড় বাজার গড়ে উঠল। আর তার কেন্দ্র অবশ্যই কলকাতা। তবে কলকাতায় গোলামি ব্যবসার সূত্রপাত কিন্তু ব্রিটিশদের হাতে নয়। তার আগেই পর্তুগীজ এবং মগ দস্যুরা খিদিরপুর অঞ্চলটিকে ঘিরে রীতিমতো বাজার গড়ে ফেলেছিল। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সেই পথেই হেঁটেছেন ইংরেজরা। শুধুই ইংরেজরা নন, অনেক ভারতীয়ও বাড়িতে 'গোলাম পুষতেন'। ১৮২৫ সালের 'সমাচার দর্পণ' পত্রিকার একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বর্ধমানের এক বৈষ্ণবী পরিবার তাঁদের মেয়েকে কলকাতায় রামদুলাল সরকারের কাছে শ্রাদ্ধের দান হিসাবে সমর্পণ করতে আসছিলেন। কিন্তু শ্রাদ্ধের ক্রিয়াকর্ম ততদিনে শেষ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা মত পরিবর্তন করে কন্যাকে নগদ ১৫০ টাকার বিনিময়ে রাজা কিষানচাঁদের কাছে বিক্রি করে দেন।
কলকাতার ক্রীতদাসপ্রথার ইতিহাস আজ বিস্মৃতপ্রায়। সেইসব অন্ধকার দিনের কথা মনে করলে লজ্জায় চোখ বুজতে হয়। তবে তখনও কিছু মানুষ ছিলেন, যাঁদের মনে মানবিক মূল্যবোধগুলি বেঁচে ছিল। ফলে বিভিন্ন জায়গায় অসন্তোষ জমা হচ্ছিল। ক্রীতদাসরা তো প্রায়ই পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। সেইসঙ্গে অসন্তোষ তৈরি হচ্ছিল ভারতবর্ষ এবং ইংল্যান্ডের সাধারণ শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও। ফলে অষ্টাদশ শতকের শেষদিক থেকেই এই ব্যবস্থার উপর লাগাম টানা হতে থাকে। ক্রীতদাসপ্রথা বন্ধ করার জন্য আদালতের নির্দেশও দেওয়া হয়। তবে তারপরেও বহুদিন পর্যন্ত এই ব্যবস্থা চালু ছিল। উনিশ শতকের শুরুর দিকেও গোলামদের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। তবে ঠিক কতদিনে এই নির্মম প্রথা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়েছিল, সে-সম্পর্কে সঠিক জানা যায় না আজও।
তথ্যসূত্র: টাউন কলিকাতার কড়চা, বিনয় ঘোষ
Powered by Froala Editor