জলপাইশাখার মধ্যে দিয়ে যেতে

(প্রথম পর্ব)
ছবি - থ্রু দ্য অলিভ ট্রি’জ
পরিচালনা – আব্বাস কিয়ারোস্তামি
দেশ – ইরান
সাল – ১৯৯৪

কোকের ত্রয়ীর তিন নম্বর ছবি - ‘জলপাইশাখার মধ্য দিয়ে যেতে’।

ছবি শুরু হয়েছে। পরিচালক ‘আলি’ আমাদের (অর্থাৎ ক্যামেরার) মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের নাম বলেন, এবং জানান, তিনি এই ছবিতে পরিচালকের ভূমিকায় অভিনয় করছেন।

অর্থাৎ? – এই ছবিটি কৃত্রিম, কেননা সমস্ত ছবিই কৃত্রিম।

এই ছবিটি একটি পরিচিত ফর্ম অর্জন করে নিচ্ছে – অর্থাৎ, সিনেমা-র মধ্যে সিনেমা (সিনেমা উইদিন সিনেমা)।

ক্যামেরার আওতার মধ্যে যে সিনেমা, অন্তর্বর্তী সিনেমা – সেটি তুলছেন আলি (অভিনেতা), ক্যামেরার বাইরে বা পেছনে যে সিনেমা – সেটি তুলছেন কিয়ারোস্তামি, তাই নয় কি?

আমরা দেখছি, শুটিং ইউনিটের মেম্বার শ্রীমতি শিভা দৌড়ে আসছেন, আলি-কে বলছেন, ‘আপনি এদিকে আসুন, মেয়েগুলিকে কিছু খেতে দিতে হবে, যারা অভিনয়ের জন্য এসেছে।’

আলি আমাদের বিদায় জানিয়ে তাঁর সঙ্গে চলে যাচ্ছেন।

এখানে কূটাভাষ তৈরি হচ্ছে- আলি কি বাস্তব থেকে সিনেমার আওতায় চলে যাচ্ছেন?

নাকি, সিনেমা থেকে বাস্তবের আওতায়?

ক্যামেরা দৃশ্যটিকে একেবারে পেইন্টিং-এর মতো ধরেছে, ইম্প্রেশনিস্ট পেইন্টিং ও পারস্য মিনিমালিস্ট পেইন্টিং-এর সঙ্গে ভীষণ মিল!

ব্যাকগ্রাউন্ডের কেন্দ্রে একটি সবুজ-খয়েরি গাছ, গাছের নিচে কালো পোশাক পরা মেয়েরা সারি হয়ে আছে। ফোরগ্রাউন্ডের জমি সবুজ ঘাসে ঢাকা, পরিচালক-অভিনেতা আলি একটি শাদা জামা পরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

আর দেখুন, ঐ দূরে, একেবারে কর্নারে, একটি মেয়ের হ্যান্ডব্যাগ দেখা যাচ্ছে! ওটির রঙ কমলা।

সুন্দর কম্পোজিশন – বাস্তবকে নির্বাচন করা হচ্ছে একজন শিল্পীর চোখ দিয়ে।

বাস্তব সর্বদা শিল্পে বিকৃত, সম্পাদিত, পরিমার্জিত অবস্থায় ধরা দেয়।

বাস্তবকে সামগ্রিক ভাবে কখনোই ধরে ফেলা যাবে না, কারণ মূল বাস্তবকে ব্যক্তির আপেক্ষিক দৃষ্টি দেখতে বা বুঝতে পারে না।

আরো দেখুন, এখানে ক্যামেরার দৃষ্টি হচ্ছে আব্বাস কিয়ারোস্তামির দৃষ্টি, এবং একই সঙ্গে আমাদের (দর্শকের) দৃষ্টি।

সিনেমাটি দর্শকের কাছে সমর্পণ করে দেওয়া হচ্ছে। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণই সিনেমাটিকে সম্পূর্ণ, স্বয়ম্ভর করে তুলবে।

পরের শট, উলটো দিক থেকে নেওয়া হচ্ছে। কিউবিস্ট প্রয়োগ, বাস্তবের এক পিঠ দেখলে অপর পিঠও দেখতে হবে।

ফের পেইন্টিং সদৃশ শট- সারিবদ্ধ সবুজ গাছ, সারিবদ্ধ কালো পোশাক পরা মেয়েরা, খয়েরি মাটি, সবুজ ঘাস। দূরে আবছা পাহাড়।

 তাহেরে, এক রূপবতী, লাজুক, বুদ্ধিমতী ইরানি কন্যা, অভিনয়ের জন্য এসেছে। আলি তাকে নির্বাচন করছেন।

আরেকটি রূপবতী সপ্রতিভ মেয়ে, তারও নাম জানতে চাওয়া হল। সে নাম বলে, তাহেরে।

অর্থাৎ, তাহেরে হল আপেক্ষিক রাশি, সে অনেকের মধ্যে যে কেউ হতে পারে।

ঘটনাচক্রে প্রথম তাহেরে হয়ে যাবে এই ছবির ‘নায়িকা’।

সম্ভাব্য অভিনেত্রীদের নাম টুকে নিচ্ছেন আলি।

পাশ থেকে একটি স্থানীয় ব্যান্ডের ড্রাম বাজানোর আওয়াজ আসতে থাকে। টাইটল দেখানো হচ্ছে।

কুকুরের ডাক শোনা যায়। ড্রামের শব্দের সঙ্গে সেটি চমৎকার ভাবে মিলে গিয়ে এক সুরসংগতি তৈরি করে।

দৃশ্যগত বাস্তব, অর্থাৎ ইমেজ হল পেইন্টিং-এর উপাদান। শিল্পিত ফ্রেমে ধরলে দৃশ্য-বাস্তবের সবটাই পেইন্টিং হয়ে উঠতে পারে।

ধ্বনিগত বাস্তব, অর্থাৎ ‘শব্দ’ হল মিউজিকের উপাদান। শিল্পিত কানে সমস্ত শব্দ (মায় কুকুরের ডাকও!) সাংগীতিক হয়ে যেতে পারে।

ছবি ফের শুরু হয়েছে।

পিওভি শট, গাড়ির উইন্ড স্ক্রিনের এপাশে ক্যামেরা, আমরা গাড়িচালকের দৃষ্টিতে সামনের রাস্তা দেখছি।

কোকের গ্রামে ১৯৯০ সালে ভূমিকম্প হয়েছিল, এখনও ধ্বংসের চিহ্ন আছে। প্রকৃতি আদিম, পেইন্টিং-তুল্য, ঝাঁঝালো সবুজ।

গাড়ির রেডিও-তে ঐতিহাসিক ক্যালেণ্ডার শোনা যাচ্ছে।

‘আজ, ১৯৯৩, ৩০ মে, ১৪১৩ চান্দ্র হিজরি সনে আজকের দিনে ১৩৫৩ বছর আগে...’

কী ঘটনা ঘটেছিল, আর শোনা যায় না। একজন গাড়িতে উঠেছে, তার সঙ্গে গাড়িচালক শ্রীমতী শিভার কথাবার্তা রেডিও-র আওয়াজ ঢেকে দেয়।

প্রচুর ভেড়া রয়েছে রাস্তায়। তারা সরে যাচ্ছে।

ধ্বংসপ্রাপ্ত রাস্তা আমরা এগোচ্ছি, আদিম প্রকৃতি দিয়ে এগোচ্ছি, ইতিহাসের মধ্যে যেন ঢুকে যাচ্ছি।

অদেখা রেডিও ভাষ্যকার তার ভূতুড়ে কণ্ঠে এই মাত্র মধ্যযুগের ইতিহাসের কথা বলছিল!

আমরা যেন টাইম ট্রাভেল করছি! এই গাড়িটি কি স্থান থেকে স্থানে নিয়ে যায়, নাকি সময় থেকে সময়ে?