মুকুজ্জের দপ্তর - ২১
আগের পর্বে
প্রথম ভূতের গল্পেই এক দুর্দান্ত চমক দিলেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। ভৌতিকতার সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন একধরণের মনস্তত্ত্ব ও দার্শনিক ভাবনা। একই ছবি দেখতে পাওয়া যাবে সত্যজিৎ রায়ের ‘অনাথবাবুর ভয়’ গল্পেও। যেখানে গল্পের রূপক কতকটা প্রকাশিত, কতকটা নয়। ইমদাদুল হকের লেখায় বারবার উঠে আসে একধরণের বিচিত্র চিত্রণ। বরেন গঙ্গোপাধ্যায় এবং কণা বসুমিশ্রের গল্পেও বারবার চরিত্র হয়ে উঠে আসেন অশরীরীরা। সত্যসন্ধানী অর্জুন-কাহিনি হলেও ‘শমননন্দন যমনন্দন’ একটি ভৌতিক উপন্যাস। এখানেও অশরীরীর উপস্থিতি। আবার অবাক লাগলেও নবারুণ ভট্টাচার্যের লেখাতেও বারবার উঠে এসেছেন ভূতেরা। সেই ভূত কখনও অশরীরী। আবার কখনও তারা ক্ষয়ে যাওয়া অতীতের গণস্মৃতি। হার্বাটের শুরুতেই যার আভাস পাওয়া যায়। কিছু টুকরো টুকরো চিহ্ন আর ‘মৃতের সহিত কথোপকথন’-এর মধ্য দিয়ে খুঁজে দেখা হয়েছে হার্বাটের চরিত্রকে।
'গু-গা-বা-বা'-তে সম্ভব অসম্ভব সব রকম ভূতের তালিকা ধরিয়ে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। বাঁকা থেকে সোজা, রোগা থেকে মোটা- বাদ যায় নি কিছু। তাঁর জিনিয়াস পিতাও পান্তভূতের জ্যান্ত ছানাকে যেমন জোছনা রাতে প্রেতিনী মায়ের সঙ্গে ক্রীড়ারত দেখতে পেয়েছেন - 'আবোল তাবোল'-এর এই কবিতাটি দ্বিধাহীনভাবেই বিরল এবং বিশুদ্ধ ভৌতিক কবিতা লিখবার সার্থক দৃষ্টান্ত।
খোদ ভূতের দৃষ্টি থেকেই প্রেমের গল্প (কিংবা প্রেমিক ভূতের গল্প) লিখেছেন শিশির লাহিড়ী - 'ফুলশয্যা' গল্পের বিদেহী নায়ক জীবিতা স্ত্রীর সঙ্গে নানাবিধ উপায়ে রোমান্স চালিয়ে গিয়েছে। তারই জবানিতে গল্পটি জমে উঠেছে। দুটি পিঠোপিঠি জগতের মধ্যে যৌন ইশারা দেওয়া নেওয়া চলতে থাকে এবং জগতদুটি ক্রমে একাকার হয়ে যায়। খাঁটি রোমান্টিক অনুভূতিই মিলবে গল্পটিতে - দেদার কৌতুক যার সঙ্গে জোড়কলম করে দেওয়া থাকে।
প্রেমিক ভূতের উলটো দিকে থাকতে পারে? বৈরাগ্যবান ভূত! হতেই পারে। এবং এই নিয়ে গল্প লিখবার সফল নমুনা পাচ্ছি সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ে।
'পারাপার' গল্পটি শৈশবের নস্টালজিয়াকে ভরিয়ে তুলেছে অতিপ্রাকৃতের মায়াময় আলোয়। সাধক পিতামহের আত্মা এক মধ্যরাতে দুই নাতিনাতনিকে ভবিষ্যৎ জানিয়ে যান... বহুদিন যাবত বন্ধ পূজার কক্ষে ধ্যানাসনে আরূঢ় মূর্তি কথা বলে মন্দ্র, গম্ভীর স্বরে। হুবহু মিলে যায় তাঁর অশনি সংকেত। স্মৃতিজড়িত বাড়িটিকে গঙ্গা নদী সহসা গ্রাস করতে উদ্যত, পার ভেঙে উঠে আসছে জল। পরিবারটির সন্ত্রস্ততা দুই বালক বালিকার মুখে এসেছে এইভাবে -
'আমাদের বাড়িটা তলিয়ে যাবে?'
উত্তর নেই?
'আপনার বন্ধ ঘর কে খুলবে তাহলে?'
উত্তর এল - 'আমার ঘর খুলবেন স্বয়ং গঙ্গা। আমার সাধনা, আমার আত্মা তিনি ভাসিয়ে নিয়ে যাবেন জলে।'
ভূতের গল্পে 'পারাপার'-এর সমতুল মননশীলতা খুব বেশি মনে হয় না লক্ষ করা গেছে। ফিনিশিংটিও অসামান্য। লেখককে অনেক কৃতজ্ঞতা।
'শবসাধনা' গল্পটি লেখেন তারাপ্রণব ব্রহ্মচারী। এখানে ছায়া ফেলে আছে 'বেতাল পঞ্চবিংশতি'র মিথ। অতীন্দ্রিয় ঝিলিক দিয়ে লেখাটি ঝলসে ওঠে এবং শেষ হয় আশ্চর্য কবিতায়।
এখানেও গঙ্গার তীর এসেছে প্রেক্ষাপট হিসেবে। বেনারসের ঘাটে সন্ন্যাসীবেশে দাঁড়িয়ে থাকে নায়ক এবং সূর্যের রশ্মিধোয়া মুখে জন্ম মৃত্যুর চক্রটি নিয়ে নিজের প্রসন্নতা জানায় - 'অস্ত উদয়, উদয় অস্ত'! এই উক্তিটি করে।
তাকেই শুরুতে আমরা দেখেছি তান্ত্রিকের নির্দেশে শব কাঁধে নিয়ে সাধনস্থলে আগুয়ান হতে। শবটি ছিল এক যোগসিদ্ধের (শমীবৃক্ষের বেতাল-কে মনে পড়ছে?), যে জীবিত বহনকারীর কানে তার ফিসফিসে, একঘেয়ে স্বরে বলে গেছিল -পালাও! তান্ত্রিক নিজের সিদ্ধির জন্যে তোমাকে হত্যা করবে, যখন তুমি আমায় নামিয়ে রাখবে এবং নত হবে তার কাছে।... পালিয়ে যাও!
ভৌতিক গল্পে আধ্যাত্মিক সন্ধান ফিরে ফিরে এসেছে অবধূতের লেখাতেও। 'বশীকরণ' গ্রন্থটিকে অতীন্দ্রিয়, অলৌকিক ঘটনাবলীর স্মরণীয় অ্যানথোলজি বলে ধরতে পারি।
শেষ যা বলার, 'মুকুজ্জের দপ্তর'টি আজ থেকে মরজগতের খোলা খাতাটি বন্ধ করছে এবং বিদেহীদের একজন হিসেবে পাঠকের কাছে শোকাকুল বিনতি জানাচ্ছে।
Powered by Froala Editor