ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল বা হাওড়া ব্রিজের মতোই কলকাতার ঐতিহ্য হাতে টানা রিকশা। দীর্ঘদিন ধরে মানুষে টানা এই গাড়ির অমানবিক চরিত্রের বিরুদ্ধে সরব মানবাধিকার রক্ষার সংগঠনগুলি। হাতে টানা রিকশার পরিবর্তে সাইকেল রিকশা বা যন্ত্রচালিত রিকশার ব্যবহারও নতুন নয়। কিন্তু কলকাতার বুকে এখনও চলে ঐতিহ্যপ্রাচীন এই গাড়ি। কলকাতার ইতিহাসের অচ্ছেদ্য অঙ্গ রিকশার ইতিহাস।
রিকশার আবিষ্কার জাপানে। আবিষ্কারক হিসাবে কেউ দাবি করেন মার্কিন ব্যবসায়ী অ্যালবার্ট টোলম্যান, আবার কারোর মতে ধর্মপ্রচারক জোনাথন স্কোবি। তবে উনিশ শতকের মাঝামাঝি জাপানেই রিকশার প্রচলন শুরু হয়। সেদেশে এই গাড়ির নাম ছিল 'জিন-রিকি-শ'। অর্থাৎ মানুষে টানা গাড়ি। সেখান থেকে ভারতবর্ষে রিকশার আগমন ঘটে ১৮৮০ সাল নাগাদ। সিমলা প্রদেশে প্রথম রিকশার ব্যবহার শুরু করেন রেভারেন্ড জে ফর্দিস। লেডি ডাফরিনের স্মৃতিকথা থেকে এই খবর আমরা জানতে পারি। গোড়ায় একে 'জিন রিকশ' বা 'জেনি রিকশ' বলা হত। তারপর ছোট করে শুধু রিকশ।
কলকাতায় রিকশার ব্যবহার শুরু হয় ১৯০০ সালের আশেপাশে। কলকাতার চিনা অধিবাসীদের মধ্যেই প্রথম রিকশার ব্যবহার দেখা যায়। বউবাজার অঞ্চলের এইসমস্ত চিনা অধিবাসীরা মূলত কলকাতা ও খিদিরপুর ডকে খালাসির কাজ করত। মাল ওঠানোর সুবিধার জন্যই তারা রিকশার ব্যবহার শুরু করে। মাঝেমাঝে রাস্তায় যাত্রীদের দিকেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত তারা। কলকাতার বাইরে বাংলার অন্য কোথাও রিকশার প্রচলন ছিল বলে জানা যায় না। তবে ১৯০৫ সালে বর্ধমানে নির্মীয়মান কার্জন গেটের একটি ছবির সামনে রিকশা দেখা যায়। তবে চিনা অধিবাসীদের ভিতর দিয়ে রিকশা ক্রমশ কলকাতাবাসীর কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯১৪ সালে কলকাতা পুরসভার কাছে একটি আবেদনপত্র জমা পড়ে। তাতে যাত্রী পরিবহনের জন্য রিকশার ব্যবহার শুরু করার কথা বলা হয়। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার তৈরি করে 'হ্যাকনি ক্যারিজ অ্যাক্ট'। আর তারপরেই কলকাতার রাস্তায় পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নেয় হাতে টানা রিকশা। কলকাতার চিনা অধিবাসীদের পাশাপাশি জীবিকা খুঁজে নেয় একদল বিহারী শ্রমিক। কারখানার কাজ থেকে নিষ্কৃতি নিয়ে স্বাধীন ব্যবসায় নেমে পড়ে তারা। ততদিনে রিকশার জন্য নির্দিষ্ট ভাড়া বেঁধে দিয়েছে পুরসভা।
তবে কলকাতায় রিকশাচালকদের জীবিকা কোনোদিনই খুব সুরক্ষিত ছিল না। ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকেই কলকাতা পুলিশের নিগ্রহের মুখে পড়তে হত 'আনপড়' রিকশাচালকদের। দরিদ্র এই মানুষদের কাছ থেকে জুলুম করে ঘুষ নেওয়ার ঘটনা তো আখছার ঘটত। ১৯৫০ সালের পর আর নতুন করে কোনো রিকশাচালককে লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। কলকাতার রাস্তায় যানজটের সমস্যার কথা ভেবেই হাতে টানা রিকশার ব্যবহার কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় পুরসভা। ১৯৭২ থেকে ১৯৮২ সালের মধ্যে অন্তত ১২০০০ রিকশা বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ। তারপরেও ১৯৯২ সাল নাগাদ কলকাতার রাস্তায় রিকশার সংখ্যা ছিল অন্তত ৩০০০০।
পরের দিকে, ক্রমবর্ধমান ট্রাফিকের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছু হটেছে রিকশা। তার সঙ্গে মানবাধিকার রক্ষার সংগঠনগুলির দীর্ঘদিনের দাবি তো ছিলই। ২০০৬ সালে সবদিক বিবেচনা করে 'হ্যাকনি ক্যারিজ অ্যাক্টে' সংশোধনী প্রস্তাব আনে রাজ্য সরকার। তবে রিকশাচালকদের বিরোধিতার মুখে পড়ে এখনও বেআইনি ঘোষণা করা যায়নি রিকশাকে। তবে সরকারি উদ্যোগে হাতে টানা রিকশাচালকের যান্ত্রিক রিকশা বা অন্য কোনো কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে নানা সময়ে।
সূত্র - কলিকাতা দর্পণ, রাধারমন মিত্র
Imperial Simla, Pamela Kanwar
Little China stays alive in Eastern India, Ranjita Biswas
The Rickshaw walas and the Thela walas in India, Asim Mitra
Hackney carriage act ammendment, 2006