‘মৃতের সহিত কথোপকথন, প্রোঃ হারবার্ট সরকার’

মুকুজ্জের দপ্তর – ২০

আগের পর্বে

‘দা এক্সরসিস্ট’ অনুবাদ দিয়ে শুরু হুমায়ূন আহমেদের অলৌকিক রচনা। কারণ ছিল অর্থাভাব। এরপরেই ডোমিয়েন কারাসের অনুকরণেই আত্মপ্রকাশ করবেন মিসির আলি। প্রথম উপন্যাস ‘দেবী’-তে মিসির আলিও ব্যর্থ হন অলৌকিকতার যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিতে। এর পরবর্তী অধ্যায় ‘নিশীথিনী’-তেও আলো-আঁধারি অক্ষুণ্ণ থাকে। সেইসঙ্গে দেখা দেয় এক অদ্ভুত প্যারাডক্স। অলৌকিকতা থেকে একবার মুক্তি চাইছে নীলু, একবার তাকেই স্বীকার করে নেন। এরপর বৃহন্নলা গল্প হরর ফিকশন হতে হতেও হয়নি। বরং তাকে খাঁটি গোয়েন্দা গল্প বলা যেতে পারে। ‘শব’ এবং ‘ছায়াসঙ্গী’ গল্পের পূর্ণাঙ্গ রূপ ‘কুটু মিয়া’ উপন্যাস। ঢাকা শহরকে অপ্রত্যাশিত নরকে পরিণত করেন হুমায়ূন আহমেদ।


হতে পারে প্যাঁচটা পুরোনো। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ছোটদের জন্য  ভূতের গল্প লিখতে ব’সে তাকে ফিরে এমনই খুংখার বুনলেন - কে বলবে বেপাড়ার খেলুড়েটি এই মাঠে প্রথম খেলছেন?

মধ্যবিত্ত ফ্ল্যাট, গাঢ় সন্ধ্যে, বয়স্ক কথক, বালক শ্রোতারা।... ‘চতুর’ নামে একটি বিহারি ছেলে হচ্ছে গল্পের নায়ক এবং সেই বাচ্চা ভূতটিকে দেখতে-পাওয়ার কাহিনি অতি সাদামাটা। -‘এ কী শোনালেন কাকু, এ তো ফোর্থ ক্লাস গল্প’, ডুকরে উঠি-উঠি-প্রায় শ্রোতাদের জানানো হবে - ছায়াছবি সমাপ্ত হয় নাই।

মজলিসে আছি বটে চারজন, কিন্তু আমাদের একজন আসলে আমাদের সঙ্গে নেই! – যে এসেছে সে হচ্ছে চতুর – হ্যাঁ, নিজেকে নিয়ে গল্প শুনতে চতুর খুব ভালোবাসে! যেখানেই গল্পটা হোক, সে চলে আসে শ্রোতা সেজে... কারও না কারও বিশ্বস্ত রূপ ধ’রে। ‘এই যে আমি’, নিজের দিকে আঙুল তুলছেন কথক, ‘হতে পারে ‘আমি’ নই, বরং সেই চতুর – কিংবা সে হয়তো তোমাদেরই কেউ..’ – সিঁটিয়ে যাওয়া মুখগুলিকে তৃপ্তির সঙ্গে জরিপ ক’রে আরো জানাচ্ছেন ফ্ল্যাটতুতো কাকু, ‘মনে রেখো – আমাদের মধ্যে একজন আছে, যে চতুর।’    

আরও পড়ুন
গ্রেনেডের আঘাতে উড়ে গেল গব্বর সিং-এর চোয়াল

গল্প বলার ছলে অবচেতনায়-সুপ্ত আদিম ভয়টিকে খুঁচিয়ে জাগানো এবং নিজের সর্বস্বে তাকে ছড়িয়ে পড়তে দেওয়া... দুরন্ত উইট ব্যাতীত যা হওয়ার নয়। আড়াই পাতার গল্প, নাম - ‘সে আসে’।   

স্টোরি-উইদিন-স্টোরি ছকে, শ্রোতাদের ভয়ের কাহিনি বলবার মুহুর্তে স্বয়ং অশরীরীর উত্থান – এ কাণ্ড পাচ্ছি ইমদাদুল হক মিলনের লেখাতেও। ...পুব-বাংলার একটি মিথ হচ্ছে ‘নিমপাখি’, যাকে অনেকে ‘কু-পাখি’ বলেও চিনেছে। পাখিটি অশুভ এবং তাকে চাক্ষুস করা যায় না। - কারও মৃত্যু তক্ষুনি নিশ্চিত হয়, যখন শক্ত ঠোঁটে জমি আঁচড়ে ও ‘নিম’... ‘নিম’ আওয়াজে পাখিটি ডাক শুনিয়ে যায় কেবল তাকেই।  

এখানে ‘নিম’ শব্দটি আসলে ডায়লেক্ট, যার বিশেষ অর্থ আছে। এ’টি হচ্ছে বদলে-যাওয়া, পুববাংলার একটি অঞ্চলের ক্রিয়াপদ – ‘নেব’।  ‘নিম’... ‘নিম’, অর্থাৎ  নেব, নিয়ে যাব। ...নেওয়ার বস্তুটি কী সকলেই বুঝবেন।  নিমপাখি’র গল্পটি যিনি বালকদের খোলা দাওয়ায়, চাঁদের আলোয়, নিঝুম রাতে শোনাচ্ছেন; সহসা তাঁকে চমকে উঠতে দেখা গেল। ‘শুনতে পেলি তোরা?’ ‘কী, হরিদা?’ ‘ডাকল যে, নিম-নিম-নিম!... স্পষ্ট শুনলাম, উঠোন ঠোকরাচ্ছে!’ 

শ্রোতাদের দাবিতে বাকি গল্পটা বলতেই হল।... হরিদা-র ভূতপূর্ব মনিব অতীত-রাতে অবিকল এই শব্দটি শুনে আঁতকে ওঠেন এবং পরদিন তাঁকে দেখা যায় বিছানায় কাঠ-হয়ে-পড়ে-থাকতে, কষ দিয়ে গড়ানো রক্তের রেখা ততক্ষণে শুকিয়ে গিয়েছে। কেউ গলা টিপে খুন ক’রে গেছে – কিন্তু কে?

আরও পড়ুন
‘প্রকৃতি রহস্য সহ্য করে না, যদিও সে নিজেই খুব রহস্যময়’

আসর আর জমল না। ‘শরীরটা ভালো নেই’... ইত্যাদি ব’লে-ট’লে বেশ-অনেকটা বিহ্বল ভাবেই হরিদা বিদায় নিচ্ছেন, রাত্রি শেষ হ’লে যিনি হয়ে যাবেন নিজেরই গল্পের চরিত্র। - ভয়ের উৎসটি এখানে প্যাসিভ ও বিমূর্ত, সত্যজিৎ রায়ের ‘অনাথবাবুর ভয়’-তেও একই কৌশল; দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় পুরুষের আতংক-অভিব্যক্তি ছাড়া কোনও সূত্র রেখে এখানে যাওয়া হয় নি। - কেন সে ভয় পেয়েছে আমরা জানি না, শুধু আন্দাজই ক’রতে পারি এবং সেই আন্দাজও আবছা... অশুভের এই লুকিয়ে-থাকা (সুতরাং সর্বব্যাপী অস্তিত্ব) গুণিতকের হিসেবে বাড়িয়ে দেবে মূল ভয়কে।  

‘ভূতগাছ’ ও ‘রহস্যময়তা’ –ইমদাদুলের আরো দু’টি হরর গল্প। প্রটাগনিস্ট হচ্ছে কিশোর রবিন, যার সঙ্গে হোটেলের একটি ঝুপসি গাছ ‘কথা’ বিনিময় করে ও জানায়, তারই মতো কথা-বলা আরো দুটি গাছ দু’টি ভিন্ন জায়গায় আছে এবং তাদের সঙ্গে রবিনের শিগগিরই দেখা হবে। ...পাখি ও গাছ-এর মধ্যে অশুভ/প্যারানর্মাল শক্তির আরোপ একটি আদিম উপজাতীয় অভ্যাস, জড়বস্তু কিংবা জীবকে ‘টোটেম’ ব’লে গ্রাহ্য করার থেকে এ খুব দূরে নেই। 

দ্বিতীয় গল্পেও পাচ্ছি রবিনকে; তার চোখকে কাহিনির ‘লেন্স’ ক’রে তোলা হচ্ছে। –  শীতের অন্ধকারে রবিনেরই সঙ্গে আমরা দেখব রহস্যময় একটি লোককে উবু হয়ে বসে-থাকতে এবং মুঠো মুঠো আগুন অবলীলায় ‘খেয়ে’ ফেলতে... ইমেজটি যথেষ্ট bizzare ও তা দুঃস্বপ্নে টোকা দেয়। ( ‘আগুনের মুখ’ নামে নবারুণ ভট্টাচার্যের গল্পটি মনে পড়ে?)    

তিব্বতীদের পরলোক-ভাবনা ও অন্ত্যেষ্টি নিয়ে ডকুমেন্টেশনের নজির আছে বরেন গঙ্গোপাধ্যায়ে, গল্প-হিসেবেই একাধিক ভৌতিক সংকলনে এটিকে রাখা হয়েছে। এঁরই লেখা দুটি মৌলিক কাহিনি মনে পড়ল। প্রথমটির নায়ক ‘শিবকালী’ নামক জনৈক ভৌতিক মাঝি,  যাত্রাপালা নিয়ে তার তুমুল উৎসাহ;  যখন বানে ভেসে গিয়েছে গ্রাম... অথৈ জলে যাত্রীর সঙ্গে তার আলাপকেই বিশদ করা হয়েছে (‘শিবকালীর যাত্রা দেখা’ )। 

আরও পড়ুন
‘নিজে ভূত হয়ে ভয় পাচ্ছ! লজ্জা করে না?’

দ্বিতীয় গল্পে দেখছি একটি পুরোনো বাংলোয় কেবল রয়েছে দারোয়ান আর মালি, নবাগত অতিথি এলে তাকে আপ্যায়ন করার জন্যে দু’জনেই সহসা ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তিনটি চরিত্রের কেউই ‘শরীরী’ নয় – আসল কথাটি ভাঙা হবে ধীরে-সুস্থে। (কিন্তু গল্পের নামটা কী ছিল?)  

‘হাতুড়ে ডাক্তারের ভূতুড়ে রোগী’ – লেখিকা কণা বসুমিশ্র। দুর্যোগের রাত্রি ও জনৈক ডাক্তারের নৈশ-ভিজিট রাখতে বেরোনো – পুরাতন ছকে বিশ্বস্ত উপস্থাপনা। (ফ্রানৎস কাফকা-র প্রবাদপ্রতিম ‘কান্ট্রি ডক্টর’-এর প্রভাব?) 

‘হন্টেড হাউজ’ নিয়ে হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এবং প্রফুল্ল রায় বারম্বার লিখেছেন। অভিশাপের কিংবদন্তী এবং উপকারী-বিদেহীরা এঁদের লেখায় লভ্য। (গল্প হিসেবে যথেষ্ট উতরেছে ব’লে মনে হয় নি।) 

সত্যসন্ধানী অর্জুন-কাহিনি হিসেবেই পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলার জন্য লেখা হয়েছিল ‘শমননন্দন যমনন্দন’ এবং তা হলেও এটি হরর উপন্যাস। প্ল্যানচেটের ফেনোমেনা ও দুই যোগসিদ্ধের  দ্বৈরথ কাহিনিকে ভয়াল ক’রে তুলেছে। সমরেশ মজুমদারের প্রচুর লেখার ভিড়ে এটি শ্রেষ্ঠতর।    

আরও পড়ুন
লম্বা হাত বাড়িয়ে হজমের গুলি চেয়ে নিলেন ব্রহ্মদৈত্য

‘কাঙাল মালসাট’ ও ‘মসোলিয়ম’ আখ্যানে যেমন দেখেছি, বেগম জনসন কিংবা দন্ডবায়স জীবিত চরিত্র নয়...  তিন শতকের শহরে এরাই গহন নস্টালজিয়া, রাত্রির কোরাস। ভূতের গল্প-লিখিয়ে হিসেবে নবারুণ ভট্টাচার্যকে কেউই ধরবেন না – যদিও পরিহাসের কথা যে লেখকের প্রধান থিম আর কিছুই না - ‘ভূত’, যে-শব্দটিকে ঈষৎ ব্যপ্ত দ্যোতনায় দেখতে হবে। ভূত – অর্থাৎ ক্ষয়ে-যাওয়া অতীত, অবসিত কালেকটিভ মেমরি। ...সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ইতিহাসের ঠাট্টা ও ববিনে-জড়ানো লাশ, হারবার্ট সরকারের অকিঞ্চিৎকর আখ্যান শুরু হয় ঠাণ্ডা জলে কাটা-শিরার হাত ডুবিয়ে মরে-যাওয়ার পর; জড় শরীরটিকে ঘিরে ও ঘুরে দেখতে-দেখতে।  

ভুললে চলবে না,  আবোল-তাবোল লেখায় ভর্তি একটা ডায়েরি, দুটো বই (‘রেলগাড়িতে ভূত’ ও ‘ভূতের জলসায় গোপাল ভাঁড়’), পরলোক-তত্বের পাতা-বাদ-যাওয়া বই এবং বাতিল সাইনবোর্ড; এ ছাড়া লোকটির এভিডেন্স বলতে কিছু নেই এবং কাহিনিকারের যাবতীয় অন্বেষণ চলেছে এই সম্বলকেই পুঁজি করে; মৃতের সহিত বিভ্রান্ত কথোপথন বাদে যখন ইতিহাসও জানে না সে কী করবে।...

Powered by Froala Editor