‘নিজে ভূত হয়ে ভয় পাচ্ছ! লজ্জা করে না?’

মুকুজ্জের দপ্তর – ১৮

আগের পর্বে

ভূতেদের জন্য সরকারি প্রকল্প। হ্যাঁ, অবাক হওয়াই স্বাভাবিক। তবে এমনই আকর্ষণীয় গল্পের প্লট তৈরি করেছিলেন সৈয়দ মুজতবা সিরাজ। লিখেছেন ‘নিঝুম রাতের আতঙ্ক’ কিস্যায়। রামচন্দ্রপুরে এই প্রোজেক্ট। মোট ১৩টি প্রজাতির ভূতেদের জন্য বিশেষ অভয়ারণ্য। চাইলে সেখানে তাদের খাবারও খাওয়ানো যাবে। অভয়ারণ্যেই দেওয়া আছে সেই তালিকা। মুজতবা সিরাজ আরও এক কিস্যায় লিখেছেন এক সজ্জন ব্রহ্মদৈত্যের কথা। যিনি হাত বাড়িয়েই জানলা থেকে নিয়ে যেতেন হজমের গুলি। গল্পে সিরাজ লিখেছেন সেই ব্রহ্মদৈত্যের তীর্থে যাওয়ার ঘটনাও। সেখানেই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় গল্পের কেন্দ্রিয় চরিত্র ভবভূতির সঙ্গে।

সে শুধু জানে পথে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল। ...বাড়ি ফিরে দেখল কেউ তাকে টের পাচ্ছে না - শুধু একজন ছাড়া।
মণিপিসির বয়স হয়েছে। এমনিতে নির্ঝঞ্ঝাট, সমস্যা একটাই। তিনি একা একা কথা বলেন। - যাদের সঙ্গে, তারা কেউ বেঁচে নেই।
তার স্ত্রী, কন্যা এবং সে – তিনজনেই ভাবত, স্কিজোফ্রেনিয়া। এবং তা আর সারবে না।
নিজেকেই এখন অচেনা লাগছে। স্ত্রী উল বুনছে-তো-বুনছেই, যেমন-কে-তেমন... মুখ গুঁজে কমিকস পড়ছে মেয়ে। ...‘সুরমা!’ ‘মোম!’ ‘এই যে আমি!’
‘কপাল আমার! আয়, বোস। কী ক’রে এমন হল?’ - মণিপিসি।

তখন সে বুঝল, সে বেঁচে নেই। 

‘চোখের বাহিরে’ গল্পে এমনই চমক এনেছেন হীরেন চট্টোপাধ্যায়। এই থিম নিয়ে আরেকটি গল্প লিখেছিলেন শৈলেন ঘোষ। সেখানেও দেখেছি, একটি ভবঘুরে ছেলে রাতের বেলা এক প্রাসাদে অলিন্দে হেঁটে বেড়াচ্ছে যখন কেউ তাকে টের পাচ্ছে না। শুধু কথা বললে শুনতে পাচ্ছে গলা। যে শুনছে সে-ই আঁতকে উঠছে। 

শৈলেন ঘোষ (১৯৩১-২০১৬)

 

‘ভূ-ভূত!’ ...সকলে প্রাণপণ ডরালেও মানতে চাইছে না সে। - ‘আমি কেন ভূত হব? কেন আমায় মিছিমিছি ভয় পাচ্ছে এরা!’ 

বালক জানে না সে মরে গিয়েছে। নিজের অতীতটুকুই কেবল সে বইছে...। মাথার ওপর ছড়ানো যে-আকাশ এত চেনা ছিল- সেই আকাশও আর তাকে চিনতে পারবে না। 

দুটি গল্পই লেখা আত্মনেপদীতে। ভৌতিক গল্পের মিউজিয়ামে এরা বিশিষ্ট শো-কেস পাবে। নিজের ‘না-থাকা’ ভূতের কাছেই যখন অজানা, ‘আমি বেঁচে নেই’ - বুঝতে পেরে এখানে নিজেই শিউরে উঠতে হয়। এ ধরনের গল্পে লাগে অতি-বিশ্বাসযোগ্য উপস্থাপনা। ...হীরেন চট্টোপাধ্যায় ও শৈলেন ঘোষ দুজনেই এই কঠিন কাজটি উতরে দিয়েছেন।        

কিন্তু শৈলেনবাবুর গল্পটির নাম কী ছিল? – স্মৃতি বড় দুশমন। সে মুকুজ্জের সঙ্গে আজ বেইমানি করছে। বইও - কালের নিয়মে, অধুনা লোপাট।  

লজ্জা লজ্জা মুখ ক’রেই শুধোচ্ছি আপনাদের- ‘কেউ বলতে পারেন?’

মানুষ অতি অপদার্থ জীব কেননা সে পদে পদে ভুল করে এবং করতেই থাকে। তবু তার সান্ত্বনা যে সে একা নয়। ভূতেও ভুল করে। 

এই যেমন তার চিনতে ভুল হয় নিজেকে - তেমনই ভুল হয় লোক কিংবা ঠিকানা। এমনকি নিজের ধড়-মুণ্ডুর খবর ভুলে যায় এমন ভূতও আছে।  

ভূতের পেশা কী? অবশ্যই ভয় দেখানো। এ-জন্য তাদের কমিটিও বহাল। এই বিদ্যায় কতখানি পারদর্শী সে, ক প্লাস না গ মাইনাস তার রিপোর্ট যাওয়ারও রয়েছে নিয়ম। কোনও কোনও পিস হয় একদম হাবাগোবা, স্কোর খাতায় অবধারিত লাল কালি। তার দুর্দশা দেখলে মায়া হবে আপনারও।    

এমনই এক দুঃখী ভূতের গল্প লিখেছেন মহাশ্বেতা দেবী। শিরোনাম - ‘ভুলো ভূত’। 

মহাশ্বেতা দেবী (১৯২৬-২০১৬) 

 

রাতের দিকে মশারি টাঙিয়ে যেই শুতে যাবেন, দেখেন - তাঁর নাক বরাবর একটি মুণ্ডু শূন্যে ভাসছে। মুন্ডুর চোখ ছলোছলো, করুণ। - দেখে যথেষ্ট বিরক্ত হলেন।

‘আমার এখানে মুণ্ডু কেন?’ ধমক দিয়েই বললেন। 

ভূত ভয় পেল। ‘স্যার, আসলে ভুলে গেছি, ধড়টা কোথায় ফেলে এলাম! এখন ভয় দেখাতে যাই কী করে?’ 

সকলেই মানবেন যে এ-হেন ভূতের দরকার হচ্ছে স্রেফ দাবড়ানির। এই বেচারা-ভূতটির ভাগ্যেও জুটেছিল তাই। ...‘ভূত হয়ে ভয় পাচ্ছ? লজ্জা করে না!’ 

রেভারেন্ড লালবিহারী দে-র নাম এইখানে স্মরণ করা যাক। লোকগল্পের সংগ্রহে তিনিও এক ‘ভীতু ভূত’-এর ব্যথা জানিয়ে গেছেন। - ভৌতিক গল্পের প্রত্ন নিদর্শন।    

ভূতের ভয় পাওয়ার নমুনা আরো দেখা গেছে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ে। মনে করুন সেই অমর সিকোয়েন্স,  ‘গোঁসাইবাগানের ভূত’ উপন্যাসে রাম কবিরাজের নাম শুনে যখন হাপিস হয়ে গেছিল ওষুধ-নিতে-আসা বিদেহী। ... ‘নিধিরাম’, এই নাম হলেও সে রামচন্দ্রকে এত ডরায় কী ক’রে? ‘আনন্দমেলা’-র খুদে পাঠকরা তক্ষুনি তক্ষুনি সরব হন এবং ফাঁপরে ফেলেন লেখককে। ‘সাপের বিষ কি সাপকে লাগে?’ এহেন আমতা-আমতা উত্তরে কেই বা সন্তুষ্ট হবে!  

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় (জন্ম ১৯৩৫)

 

‘ইঁদারায় গণ্ডগোল’ – শীর্ষেন্দুর আরেকটি সিগনেচার গল্প। প্রায় সব রোগই যা খেলে সারে, তেমনই আশ্চর্য জলে টইটম্বুর কুয়োটি। ভাবনার কথা এই যে, ক’দিন হল কুয়োয় যা-ই নামানো হোক, দড়িটি কুচ ক’রে কেটে নেওয়া হচ্ছে। বালতি-ঘটি জমছে কুয়োয় তলায়, জলও থাকছে নাগালের বাইরে।  

কিন্তু  দড়িই বা কে কাটছে অত নিচে ব’সে? এ অশৈল (অশরীরী) কাণ্ড ছাড়া আর-কী। -  জমিদারের অনুরোধে প্রাজ্ঞ পুরুতমশাই এলেন অকুস্থলে।

‘কে আছিস, উঠে আয় – নাহলে থুতু ফেলব!’ ইঁদারায় ঝুঁকে তিনি হুংকার দিলেন।

‘থুতু ফেলবেন না! থুতু ফেলবেন না!’ শোরগোল উঠল তলা থেকে। একের পর এক উঠতে লাগল ধূম্রবৎ কালো কালো ছায়া। 

...’রামচন্দ্রকে ছাড়া ভূতেরা আর কীসে ভয় পায়?’ –কুইজে আপনি আর কক্ষনো পয়েন্ট হারাবেন না।   

খাঁটি ভূতের গল্পে উদ্ভট ও অপরূপ হিউমর। উপেন্দ্রকিশোর, ত্রৈলোক্যনাথ, পরশুরাম ও আশাপূর্ণার ছেড়ে-যাওয়া বেটনটি মহাশ্বেতা, শীর্ষেন্দু কী সহজেই তুলে নিলেন।

Powered by Froala Editor