The noblest pleasure is the joy of understanding.
- Leonardo da Vinci
ব্যক্তিগত দর্শন, অন্তত সত্যজিৎ রায় যেখানে পৌঁছেছিলেন, তা বুঝতে গেলে মানুষটার পঁয়ত্রিশখানা সিনেমা দেখাই যথেষ্ট নয়। বরং সাহিত্য, যা তাঁর অধিক মৌলিক রচনাও বটে, সত্যজিৎ লুকিয়ে রেখেছেন নিজের বিশ্ববীক্ষা।
এরকম কি বলা যায়, তিনি আসলে দু’রকম সময়ে আস্থা রাখতেন? ঝটিতি এদের নাম দিচ্ছি - মহাসময় এবং সভ্যতার সময়। ‘মহাসময়’ বলতে সত্যজিৎ এই সৃষ্টির আদি অবধি দেখতে চেয়েছিলেন; যে কারণে ফটিকচাঁদকে জাগলার হারুণদা বলেছিল, জাগলিং তো গ্রহ নক্ষত্রের মধ্যেও চলছে, এই ন’টা গ্রহ ঘুরছে অথচ ঠোকাঠুকি লাগছে না, এটা কি কম বড় জাগলিং? ...আর ‘সভ্যতার সময়’? সত্যজিৎ তখন চেয়েছিলেন আলতামিরার গুহার দিকে, ‘শঙ্কুর পরলোকচর্চা’ গল্পে জনৈক আদিম মানুষের আত্মা এসে সাদা দেওয়ালে বাইসন এঁকে দিয়ে যায় – ‘যে বাইসন’, প্রফেসর শঙ্কু-র বকলমে সত্যজিৎ রায় লিখছেন, ‘পিকাসো আঁকলেও গর্ব বোধ করতেন।’
আন্দ্রেই তারকোভস্কি-র ‘স্টকার’ মনে পড়ে? সেখানে একটি ‘জোন’ বা অঞ্চল ছিল, যেখানে নাকি ম্যাজিক ঘটে, মানুষের ইচ্ছাপূরণ হয়। এই অলৌকিকে বিশ্বাস করত ‘গাইড’ চরিত্রটা। পরিচালক দেখান, এই নির্বাচিত ‘জোন’-এর বাইরে সমস্ত বাস্তবতাই অলৌকিক দিয়ে আচ্ছন্ন; এই ‘বাস্তব’ যে আছে এবং তাকে যে ‘বোঝা’ যায়, তা-ই হল সৃষ্টির সেরা ম্যাজিক!
‘আগন্তুক’ ছবিতে বলা হয়েছিল সূর্য, চাঁদ, পৃথিবী এবং তিন চাকতির উপমায় সেই এক মহাজাগতিক ম্যাজিকের কথা। শঙ্কুকাহিনি ‘একশৃঙ্গ অভিযান’-এ একটা কল্পিত জায়গা রয়েছে, যার নাম ‘ডুংলুং ডো’। মানুষের কল্পনা জমে জমে রূপকথার প্রাণীগুলি জীবন্ত হয়ে উঠেছে, ‘নিষিদ্ধ দেশ’ তিব্বতের এক অজানা উপত্যকায় এই ‘স্বর্গ’, যার বাইরে এলে আমাদের চেনা বাস্তবের পরিধি আবার শুরু হয়েছে।
সত্যজিৎ এই কাজ বারবার করেছেন, মানুষের রূপকথা এবং ‘মিথ’কে জীবন্ত করে তোলার কাজ। ‘অঙ্কস্যার, গোলাপিবাবু ও টিপু’ গল্পে কল্পনার ‘পেগাসাস’ (বাংলাদেশে যার নাম ‘পক্ষীরাজ’) এক আশ্চর্য গোলাপিবাবুর কারসাজিতে জ্যান্ত হয়ে উঠেছিল। বা ধরা যাক ‘খগম’ গল্পটি। মহাভারতের চরিত্র খগম মুনির অভিশাপে সাপ হয়ে গেছিলেন সহস্রপাদ। তাঁকেই সত্যজিৎ পৌরাণিক যুগ থেকে আধুনিক সময়ে নিয়ে আসেন, ইমলিবাবার অভিশাপে ধূর্জটিবাবু সত্যিসত্যি কেউটে সাপ হয়ে যান।
আধুনিক প্রযুক্তি ও সভ্যতার ওপর কি আদৌ আস্থা ছিল সত্যজিৎ-এর? ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ সিনেমাতেই সিদ্ধার্থ চন্দ্রাভিযান নিয়ে বিরাগ লুকিয়ে রাখেনি। ‘আগন্তুকে’ এসেছে নেপচুন-গামী ‘ভয়েজার’ প্রসঙ্গ, যাকে এক কথায় সত্যজিৎ খারিজ করেছেন। ‘আদিম মানুষ’ যে শিকার করা শিখল অস্ত্র বানিয়ে, বানাতে জানল ইগলু বা পর্ণকুটির, সেই ‘প্রযুক্তি’ বরং অনেক শ্রেয়, তা প্রকৃতির সঙ্গে লগ্ন হয়ে আছে।
‘শঙ্কু ও বাগদাদের বাক্স’ গল্পে আধুনিক প্রযুক্তির দম্ভকেই নিশানা করা হয়, সুমেরীয় জাদুকর গেমাল নিশারত-এর বাক্স ধরে রেখেছিল ‘বায়োস্কোপ’-এর জাদু, পাঁচ হাজার বছর আগের মৃত্যুমিছিল ফুটে উঠেছিল সাদা কালো ‘সিনেমা’য়। ...প্রাচীন সভ্যতা আর সাইলেন্ট ছবি - দুইয়ের প্রতিই হোমাজ জানান লেখক।
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ লোকজ বিশ্বাস থেকে পড়তে চেয়েছিলেন নিঃসঙ্গ মহাদেশের আত্মার বয়ান, কমলকুমার মজুমদারও আচ্ছন্ন ছিলেন বাংলা-র গোপন ঐতিহ্য নিয়ে। ...কোনো গোলার্ধে নিজের বিশ্বাসকে ভাগ করেন না সত্যজিৎ, তিনি একই সঙ্গে লেখেন ‘শিবু ও রাক্ষসের কথা’ এবং ‘মানরো দ্বীপের রহস্য’।
প্রথম গল্পে আছে একটি লৌকিক গ্রাম্য ছড়ার উল্লেখ (‘রাক্ষসের প্রাণ থাকে মৎস্যের উদরে’), যাকে ভিত্তি ক’রে তৈরি হয়েছে গল্পের প্লট। বোর্নিও দেশের নরখাদক রাক্ষস তো ছিল বাস্তবেই। রূপকথায় যে রাক্ষসের বর্ণনা আমরা পড়েছি (‘কুলোর মতো পিঠ, ভাঁটার মত চোখ, মুলোর মতো দাঁত’), সেটিও হুবহু মিলিয়ে দেওয়া হয় অঙ্ক স্যার জনার্দনবাবুর আকৃতির সঙ্গেই! মাছের পেটের ভেতরেই ছিল তাঁর প্রাণ, কিশোর শিবু আর আধপাগলা ফটিকদা বুদ্ধি খাটিয়ে কব্জায় আনে ছদ্মবেশী ‘রাক্ষস’কে।
‘মানরো দ্বীপের রহস্য’ গল্পে অমৃত ফলের উপাখ্যানই সত্যজিৎ বলেছেন ফিরে। অজানা দ্বীপে এই ফল খুঁজে পেয়েছিল ইংল্যান্ডের জলদস্যুরা, তাদের মৃত্যু ছিল না অনাহার কিংবা অপঘাত ছাড়া! তাদেরই শেষ সদস্য ‘ব্ল্যাকহোল ব্রান্ডন’কে মেরে দ্বীপটিকে নিরাপদ করে প্রফেসর শঙ্কুর দল। গল্পের শেষ লাইনে মাস্টারস্ট্রোক, ‘শেক্সপিয়রের সমসাময়িক এই দস্যুকে নিশ্চিহ্ন করে দিল আমার অস্ত্র।’ ...সত্যিই তো, হিংস্র জলদস্যুদের সমকালেই ইউরোপের শ্রেষ্ঠ নাটকগুলি রচিত হয়েছিল!
শেক্সপিয়রের মতো রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গও সত্যজিৎ নিয়ে আসেন ‘শঙ্কুর কঙ্গো অভিযান’ গল্পে; আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে পুরোনো বন্ধু ম্যাকফারসন-কে তার প্রিয় বইটি ফেরত দেন শঙ্কু, যেটি কিনা কবিগুরুর স্বাক্ষর সহ ‘গীতাঞ্জলি’র প্রথম ইংরেজি সংস্করণ।
প্রাচীন বিদ্যা ও কিংবদন্তী ছিল সত্যজিৎ রায়ের সব সময়ের অবসেশন। ‘ভুতো’ গল্পে আফ্রিকান জাদু ভুডুইজম-এর নিদর্শন পাওয়া যায়, ‘প্রফেসর শঙ্কু ও হাড়’ গল্পে আছে মৃত অস্থিতে প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার কালো জাদু। ‘তারিণীখুড়ো ও বেতাল’ গল্পে জাদুকর সন্ন্যাসী-র কঙ্কাল জীবন্ত হয়ে ভিলেনের কাঁধে চেপে বসে, ‘দুই ম্যাজিশিয়ান’ গল্পে জাদুশিক্ষকের প্রেত তরুণ জাদুকরকে গুপ্ত বিদ্যা শিখিয়ে দিয়ে যান।
এই মহাবিশ্বে অণু পরমাণুর মতো গ্রহ এই পৃথিবী, অজস্র ডটের মধ্যে কয়েকটি ডট বাদে আমরা কিছু নই। এই বেঁচে থাকার আছে কি কোনো তাৎপর্য? ...বিশ শতকের সেরা চিন্তকদের মতো এই প্রশ্ন ছিল সত্যজিৎ রায়েরও।
‘টেরোড্যাকটিলের ডিম’ গল্পে এর কিছুটা উত্তর আমরা পাব। কেরানি বদনবাবু নিজের প্রতিবন্ধী ছেলেকে শোনাবার মতো আর গল্পও বানাতে পারছেন না, এমনই বিষাদ গ্রাস করেছে তাঁকে। আলাপ করতে এসে এক বুজরুক বদনবাবুর ম্যানিব্যাগটা হাতিয়ে নেয়, বদলে দিয়ে যায় অনেক গল্পের সূত্র! ইতিহাসের দিকে তাকালেই আর অভাব থাকে না গল্পের। আমরা তাকাতে পারি সভ্যতার ইতিহাস ছাড়িয়ে প্রাচীন ইতিহাসের দিকে, এমনকি এই গঙ্গা যখন নামেনি, ডাইনোসররা যখন ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবীতে। টাকা খোয়া যাওয়া-র ক্ষতিপূরণ বাবদ ছেলেকে শোনানোর জন্য অজস্র গল্প পেয়ে যান বদনবাবু।
‘শাখা প্রশাখা’ সিনেমায় পাগল মেজদাদা ছোটোভাইকে জানায় সাত সুর ও সাত রঙের কথা, সুর টেনে টেনে বলে, ‘অন্ধকারে আলো, যত সহজ তত ভালো।’ এই বাক্যটি সত্যজিৎ রায়েরও শিল্পভাবনার মূল ‘চাবি’। এক বিস্মিত ছাত্রের মতোই শিল্পের ইতিহাসের দিকে তিনি তাকিয়ে থেকেছেন; সেবাস্তিয়ান বাখের সঙ্গীত, গ্রেগরিয়ান চ্যান্ট, প্রাচ্য ধ্রুপদ, রূপকথা, পুরাণ, গুহাচিত্র কিংবা মন্দিরের কারুকাজ – সব কিছুই হল এই গ্রহে রেখে-যাওয়া দ্বিপদ জাতির সেরা ‘সিগনেচার’, আঙুলের ছাপ! ‘গ্রাস ইজ গ্রিন, স্কাই ইজ ব্লু, রোজ ইজ রেড,’ যেমনটা আবৃত্তি করেছিল পাগল মেজদাদা, একই আবেগে সত্যজিৎ মেতে ছিলেন আজীবন। আধুনিক সভ্যতার বিষময় অগ্রগতির কিনারে রয়েছে একাকী মানুষ, তার নিজস্ব প্রতিরক্ষা যে ‘পাগলামি’, নিজের মতো করে গান শুনে যাওয়া, বীক্ষা লালন করে যাওয়া – এই ‘সত্য’টি তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।
‘সভ্যতার সময়’ তাই কেবল রক্তপাতের ইতিহাস নয়, বরং বিকল্প এক ইতিহাস - যে ইতিহাস প্রাচীন সভ্যতাগুলির, আলতামিরা থেকে দা ভিঞ্চি থেকে পিকাসো-র। এই ইতিহাসকে ছাপিয়ে সত্যজিৎ রায় বলেন আরো বড় যা, সেই ‘মহাসময়ে’র কথা; বলেন এই অন্তহীন সৃষ্টির রহস্য নিয়ে। বলেন আদিম বিশ্বাস ও অবচেতনার কথা, যেখানে সিন্দবাদের গল্পের ‘রক’ পাখিও উড়ে যায়, নেফ্রুদেৎ দেবীর অভিশাপ ফলে যায়, চী চিং-এর ভোজবাজিতে জ্যান্ত হয়ে ওঠে চিনের পবিত্র ‘ড্রাগন’। তিনি আরও বলেন এই চেনা বাস্তব-এর আড়ালে সর্বময় মৃত্যুর অজানা জগতের কথা; ‘কম্পু’ গল্পে তাই হাড়হিম করা যান্ত্রিক স্বর বলে ওঠে ‘মৃত্যুর পরের অবস্থা আমি জানি’, ‘গ্যাংটকে গন্ডগোল’ উপন্যাসে তাই ছদ্মবেশী ভিলেন ফেলুদাদের জানায়, একমাত্র মৃত্যুই জানে সব কিছু, মৃতেরই আছে সব কিছু জানার অধিকার! ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও কোচাবাম্বার গুহা’ গল্পে আদিম মানব গুহার দেওয়ালে লিখে যায়, ‘...আর সবাই মরে গেছে। আমি আছি। আমি থাকব। অনেক জানি। আরো জানব। ...পাথর আমার বন্ধু। পাথর শত্রু।’
‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ গল্পে ভূগোলের মাস্টার বঙ্কুবিহারী চমকে গেছিলেন, যখন ক্রেনিয়াস গ্রহের এলিয়েন নিজের দূরবীনটা দেয় তাঁর হাতে। দূরবীনের কাচে ভেসে উঠেছিল ব্রেজিলের পিরানহা মাছের শিকার, মেরুদেশের রক্তাক্ত যুদ্ধ। বঙ্কুবাবুর কাছে জীবনের প্রায় কোনো অর্থই ছিল না, যতক্ষণ তিনি নিজেকে নিয়ে ভেবে গেছিলেন, নিজের দুঃখে আচ্ছন্ন ছিলেন নিজেই। এই বিশ্ব তখনই তাঁর জন্য সুসহ হয়ে উঠল, যখন তিনি নিজেকে নিজের থেকে সরিয়ে তাকালেন বৃহৎ সৃষ্টির দিকে! বুঝলেন, তিনি কেন্দ্রে নন, বরং পরিধিতে আছেন। এই ‘তুচ্ছতা’তেও আছে এক সীমাহীন স্বস্তি, শুদ্ধ আনন্দ। ...আমরা কেউ বিচ্ছিন্ন নই, একটি ঐতিহাসিকতার দ্বারা গ্রথিত, এক অনন্ত স্পেস টাইমের অংশ। বাঁচার আনন্দ কখনো নিঃশেষ হয় না, শিশুর বিস্ময় যতদিন ছেড়ে না যায়।
আমরা ডুংলুং ডো-তে আছি। আমরা ডুংলুং ডো খুঁজছি।
Powered by Froala Editor