এঁরা সবাই শিল্পী। নিজের মতো করে, নিজের পরিশ্রমে নিষ্ঠায় তৈরি করেন এক একটা রং-এর জগত। কিন্তু প্রথাগত শিক্ষা এদের কারোরই নেই। তথাকথিত ‘সার্টিফিকেট’ নেই। তাই বলে নিষ্ঠায় কোনো কমতি নেই। এমনই ১৭ জন চিত্রশিল্পীকে নিয়ে প্রদর্শনী আয়োজিত হয়ে গেল কলকাতায়। আয়োজন করল ‘ছবিওয়ালা’।
‘একটি স্বশিক্ষিত ও অশিক্ষিতের দল’। নিজেদের এইভাবেই পরিচয় দিতে চান ছবিওয়ালা’র সদস্যরা। এই মানুষগুলো প্রত্যেকেই নিজের ভালবাসার জায়গা থেকে এই চিত্রশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। নিজের মতো করে তাঁরা আঁকেন; তাঁদের পেন্সিলে-তুলিতে ফুটে ওঠে ভেতরের সমুদ্রের ঢেউগুলো। কিন্তু তাঁদের ‘প্রথাগত’ প্রতিষ্ঠানের ছাপ নেই। নেই কোনো শংসাপত্র। তবে শিল্প কি কখনও একটা কাগজের সার্টিফিকেটের আশা করে?
সেইরকম ভাবনা থেকেই ২০১৯ থেকে শুরু ‘ছবিওয়ালা’র। এর সঙ্গে শুরু থেকেই যুক্ত রয়েছেন শিল্পী সৌরভ মিত্র। প্রহরের সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে তিনি বলেন- “আমাদের এখানে সবাই স্বশিক্ষিত। কেউই আর্ট কলেজ বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে আঁকা শিখিনি। এবার অনেকেই এই মানুষদের ঠিক ধর্তব্যের মধ্যে ফেলেন না। সেখান থেকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে এর শুরু। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, যেকোনো শিল্পে নিষ্ঠাটাই আসল। সেখানে একটা সার্টিফিকেট কিছু নির্ধারণ করতে পারে না।”
‘ছবিওয়ালা’র এই চিত্র প্রদর্শনীও সেই ভাবনা থেকেই উঠে এসেছে। ফেব্রুয়ারির ১১ থেকে ১৩ তারিখ আয়োজিত হয় এটি। এই নিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ করল অনুষ্ঠানটি। নানা মাধ্যম, নানা চিন্তাভাবনা ফুটে ওঠে কলকাতার গ্যালারি গোল্ডে। সেখানে যেমন ছিল পেনসিল স্কেচ, তেলরং; তেমনই ছিল অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইন্টিং। জানালেন অয়ন সিকদার। এই বছরের ১৭ জন শিল্পীর মধ্যে তিনি একজন, এবং তরুণতমও বটে। ছবিওয়ালা’র হাত ধরে প্রথমবার তাঁর ছবি জায়গা করে নিয়েছে কোনো প্রদর্শনীতে। সেন্ট জেভিয়ার্সের পদার্থবিদ্যার দ্বিতীয় বর্ষের এই ছাত্রের বক্তব্য, “আমরা যারা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কোনো প্রতিষ্ঠানে পড়তে পারিনি, বা যারা কারোর ওপর ভরসা না রেখে নিজেদের মতো এঁকে চলেছেন, তাঁদের কাছে এটা একটা বড়ো জায়গা। এরকম জায়গায় প্রদর্শনী হবে, আর তাতে আমার আঁকা ছবি জায়গা পাবে, সেটা কখনও ভাবিনি। নানা রকমের ছবি এখানে উঠে এসেছে। দর্শকরাও এসেছেন। দেখেছেন। ভাল লাগছে।”
তবে শুধু কলকাতার প্রদর্শনীর মধ্যেই আটকে নেই ছবিওয়ালা। বাংলার নানা জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছেন তাঁরা। করছেন ‘স্ট্রিট আর্ট এক্সিবিশন’। রাস্তার ধারেই সার দিয়ে রাখা ছবি। সেটাই প্রদর্শনী। সৌরভ ও অয়নের মুখেও গ্যালারি গোল্ডের পাশাপাশি উঠে এল সেই প্রসঙ্গও। পরবর্তীকালে জেলায় জেলায় এমন প্রদর্শনীর আয়োজন করারও ভাবনায় তাঁরা। সৌরভ জানান, “বাংলার অনেক জায়গায়, যেখানে ছবি প্রদর্শনের কোনো বন্দোবস্ত নেই, সেখানে ছবিওয়ালাকে নিয়ে যাওয়ার ভাবনা রয়েছে। সেই সঙ্গে গ্রামে গ্রামে আঁকার ওয়ার্কশপেরও কথা ভাবা হচ্ছে।” অন্য কোনো কিছু নয়, এখানে শিল্পই হয়ে উঠুক একমাত্র বিচার্য বিষয়। যেখানে জুড়ে থাকবেন শিল্পী। জুড়ে থাকবে তাঁর নিষ্ঠা, সাধনা। এখানে সবাই আসলে ‘ছবিওয়ালা’…