খ্যাতির লোভ যেন 'অশ্লীলতা', চাইতেন তাঁর আত্মহত্যার সাক্ষী থাকুক বিটি রোড

নমস্কার, আমি ভাস্কর চক্রবর্তী বলছি। আপনারা সবাই কেমন আছেন? কেমন আছে আমাদের বাংলার মাটি? কেমন আছে বাংলাভাষা? কেমন আছে কলকাতা? আমি বিশ্বাস করতাম, প্রত্যেক কবিরই নিজস্ব একটা শহর থাকে। সেই শহর যতটা ইট কাঠ পাথরের, ততটাই নিজের ভিতরের। যেমন আমার ভিতরে একটা আধো অন্ধকার গলি ছিল। সেই গলিতে আলোর বিপরীতে আমি হেঁটে যেতে দেখতাম একজন লম্বা মতো লোককে। নিজের ছায়াকে সঙ্গী করে মাথা নিচু করে হেঁটে যেত সে। কেমন আছে সেইসব গলি? শুনেছি গলিগুলোয় আলো ভরে গেছে এখন। শুনেছি সেই সব আলোর ধার ঘেঁষে আজকাল জেগে থাকে উঁচু উঁচু সব ফ্ল্যাটবাড়ি। কত সব স্বপ্নের আনাগোনা চলে ঘরে ঘরে।

আমার ঘরে দিনরাত একটা মশারি টাঙানো থাকত। ঝিম ধরা একটা মশারি। শুয়ে থাকতে ভালোবাসতাম আমি। সমস্ত ব্যস্ততাকে পাশ কাটিয়ে আধশোয়া হয়ে কাটিয়ে দিতে বেশ লাগত আমার। আপনারা আমার সম্বন্ধে কিছুটা জানেন বোধহয়! জানেন বোধহয়, ভাস্কর চক্রবর্তী এরকম ছিল, সেরকম ছিল। একটা বিষণ্ণ হলুদ বাল্বের মতো আমার জীবন, এমনটাই জানেন আপনারা। অথবা জানেন না। সেই হলুদ আলোর জীবন, যা হুগলি জেলার মতো ম্লান, তেমন মানুষ ছিলেন ভাস্কর। আবছা মায়াধরা এক হিম কুয়াশা, ঠিক কুয়াশা নাকি সিগারেটের ধোঁয়া, নাকি মনখারাপ! একটা গাছের গুঁড়ির মতো মাটিকে আঁকড়ে ছিলেন ভাস্কর। সত্যিই কি তাই? এসব ভাবতেও ক্লান্তি আসত আমার। রবিবারের ধুন্ধুমার বাজার শেষে মাছের দোকানগুলো, সবজির দোকানগুলো যেমন ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ে সেরকমই এক আনন্দময় ক্লান্তি।

আসলে বিষাদ থেকে আনন্দের দূরত্ব খুব বেশি নয় জানেন। আমরাই অসহায়, এই সামান্য পথটুকু আমরা খুঁজে পাই না। খুঁজে পেলেও এগোতে পারি না, পিছিয়ে যেতে পারি না। এখন আমার খুব পিছিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। খুব ইচ্ছে করে উনিশশো একাত্তর সালে পৌঁছে যেতে। যদি সব বদলে দিতে পারতাম আমি! আপনাদের মনে আছে কী হয়েছিল সেই বছরে? কুখ্যাত সেই বছরে হয়েছিল বরানগর গণহত্যা। টানা তিন দিন ঘর থেকে বেরোইনি আমি। টানা তিন দিন আমি ভালো করে ঘুমোতে পারিনি। ভালো করে খেতে পারিনি। একটা চারমিনার জ্বালিয়ে আর নিভিয়ে দুবার করে খেতাম। ঘনঘন চা খেতাম। আর সাদা পাতার দিক মুখ করে বসে থাকতাম আমি। বন্ধ জানলার দিকে তাকিয়ে, খোলা জানলার দিকে তাকিয়ে কিছুই ভাবতাম না আমি। কিছুই করতাম না সারাদিন। একজন মানুষ অসহায় হয়ে কেমন স্থবির হয়ে যায়, সেই গণহত্যা আমাকে শিখিয়েছিল। মাথার ভিতর বেজে উঠত কিছু লাইন। লিখতাম না। অথবা লিখতাম। আজ আর মনে পড়ে না আমার। শুধু গুলির শব্দগুলো মাঝরাতে কেঁপে উঠত আর আমার জানলায় ধাক্কা লাগত বিষাদের, এটুকু মনে আছে। নিজেকে আমার খুনির মতো মনে হত। নিজেকে আমার খুন হয়ে যাওয়া স্বপ্নের মতোও মনে হত।

বড় কুখ্যাত ছিল সেই তিনটে দিন। বড় কুখ্যাত ছিল সেই বছর। ‘খ্যাতি’ এই শব্দটার সঙ্গে আমার ছিল কয়েক আলোকবর্ষ দূরত্ব। বড় অশ্লীল এই শব্দ। বড় অশ্লীল এই বেঁচে থাকা। মনে হত আমার তখন। আপনাদের এমনটা মনে হয় না, তাই না? আপনারা বেশ আছেন। আপনাদের কত কী আছে! ঝলমলে এক জীবন। তার চেয়েও ঝলমলে আপনাদের ভার্চুয়াল জীবন। প্রতিবাদ, যন্ত্রণা, ভালোবাসা, উল্লাস কেমন মিলেমিশে ঘেঁটে দিয়েছে আপনাদের। তাৎক্ষণিকতার মায়ায় আপনাদের রোজকার জীবন কেমন হইহই করে কেটে যাচ্ছে। ভারী মজা লাগে আমার। নিজেকে বেমানান লাগে। অভীক, সুমন্ত, হিন্দোল এরা সব আসত আমার কাছে। আমি ওদের বলতাম, ছেঁটে ফেলতে হবে। লেখাকে, বড়ো একটা লেখাকে ছেঁটে ছেঁটে চারাগাছ বানিয়ে ফেলতে হবে।

তেমনটাই তো চাইতাম আমি। জীবনের সব বাড়তিগুলো ছেঁটে ফেলতে চাইতাম। ছাঁটতে ছাঁটতে একদিন দেখলাম, নিজেকেই ছেঁটে ফেলতে হবে পুরোপুরি। উনিশশো একাশি সালের এক ভোররাতে আমি আত্মহত্যা করতে বেরিয়েছিলাম। বিটি রোডের বুক চিরে হুহু করে ছুটে চলা ট্রাকের তলায় পিষে ফেলতে চেয়েছিলাম নিজেকে। পারিনি। ভোররাত থেকে পূর্ণ সকাল, আমি শুধু সিগারেট খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছিলাম। অগত্যা জীবনের কাছে ফিরতে হয়েছিল আমায়, নিজের জীবনকে হাতে নিয়ে। মাঝেমধ্যেই আপনাদের মতো তুমুল প্রত্যাশী হতে ইচ্ছে করত আমার। ইচ্ছে করত মন দিয়ে সংসার করতে। বাসবী, আমার অর্ধেক আকাশ যে বাসবী, তাকে আমি কবিতার দুটো লাইনের মধ্যবর্তী স্পেসের মতো ভালোবাসতাম। আমি বিশ্বাস করতাম, প্রতিটি বিশ্বাসের কথা লিখে যেতে নেই। মুখ ফুটে না-বলা, না-লেখা সবটাই ধারণ করে রাখে এক তীব্রতাকে। সেই তীব্রতার সন্ধান আমি করে গেছি আজীবন। আপনারা ভেবে দেখবেন একবার, এভাবেও তো ভালোবাসা যায়, তাই না?

আমি জানি, আমার স্ত্রী, আমার মেয়ে, ওরাও সেই নিঃশব্দ স্পেসের মতো ভালোবাসে আমাকে। মনে রেখেছে আমাকে। ওদের সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে চাইনি আমি এত তাড়াতাড়ি। শেষ শয্যায় আমাকে এক প্যাকেট সিগারেট দিয়েছিল কেউ। চোখ বুজে ছিলাম বলে তার মুখ আমি দেখিনি। দেখতেই চাইনি আমি। আসলে মৃত্যুকে ভালোবেসেও ঠিক যেন আপন করে নিতে পারিনি আমি। আমি শুধু চেয়েছিলাম ভেঙে পড়া কোনো তরুণ কবির স্বপ্নে আমার জন্ম হোক। প্রচণ্ড ভিড়ে একলা হতে হতে ক্লান্ত পায়ে ফুটপাথের এক অন্ধকার কোণে দাঁড়িয়ে সে যখন সিগারেট ধরাবে, সেই ধোঁয়া উড়তে উড়তে চলে যাবে বরানগরে, আমাদের বাড়ির ছাদের ঘরে। বারংবার ফিরে আসবে সেই সিগারেটের গন্ধ। রাত দশটার ছাদের ঘর সাক্ষী থাকবে ভাস্কর চক্রবর্তীর ফিরে আসার। সেই গন্ধ আপনাদের কাছে পৌঁছোক আর নাই পৌঁছোক, একদিন আপনারাও ঠিক বুঝতে পারবেন, ভাস্কর চক্রবর্তী কোনো একজন কবির নাম নয়। এই বাংলাভাষায় সমস্ত তরুণ কবির নাম ভাস্কর চক্রবর্তী।     

Powered by Froala Editor