কবিতাই অস্ত্র তাঁর, বিশ্বের দরবারে আদিবাসী স্বর পৌঁছে দিচ্ছেন ঝাড়খণ্ডের তরুণ কবি

‘কবিতা আমার কাছে কেবল নিভৃত সাধনার বিষয় নয়। বরং মানুষের মধ্যে গিয়ে, তাঁদের জীবনবোধকে উপলব্ধি করার রাস্তা। তাই বারবার ওদের মাঝখানে চলে যাই। ওদের কথা, যাপন, অভাব-অভিযোগ সবকিছু ছুঁয়ে আসি। সেখান থেকেই জন্ম নেয় আমার কবিতা। শুধু আমার নয়, এই লেখা সবার।’

প্রহরকে বলছিলেন জাসিন্তা। জাসিন্তা করকেট্টা। বাংলার প্রতিবেশী ঝাড়খণ্ডের এই তরুণ কবি শব্দের জন্য বারবার ছুটে গেছেন বাইরে। মানুষই তাঁর কাছে লেখার অনুপ্রেরণা। আজ তাঁর লেখা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে বিদেশে। নানা জায়গায় তাঁর লেখা পড়ানোও হয়। এই বছরের মার্চেও প্যারিসের আন্তর্জাতিক কবি সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন তিনি। কিন্তু এই জায়গায় এসেও, জাসিন্তা ভোলেননি তাঁর ছোটবেলার কথা, এত বছর ধরে দেখে আসা আদিবাসী মানুষগুলোর কথা। এই সবই যে তাঁকে জড়িয়ে রেখেছে, যন্ত্রণা দিয়েছে; সঙ্গে সাহসও…

লড়াইয়ের শুরু সেই ছোটো থেকেই। বাবা ছিলেন পুলিশে কর্মরত। সেই সঙ্গে প্রচণ্ড পানাসক্ত। অনেক দিনই ঘরে ফিরতেন না। জাসিন্তা দেখেছেন, নেশা করে বাবার বাড়ি ফিরে মা’কে মারতে। তখন জাসিন্তা ছোটো, সঙ্গে আরও দুই বোন, কিছু বলার সুযোগ পেতেন না। কিন্তু রাগ কি হত না একদমই? পুরো সংসারটা একা সামলাত মা; আর তাঁকেই কিনা এমন প্রতিদান পেতে হত! তখন থেকেই নিজের কথা বলার জায়গা খুঁজছিলেন তিনি।

পেলেনও একসময়। ক্লাস এইট তখন। হাতে এল মুন্সি প্রেমচাঁদের লেখা। তখন থেকেই অক্ষরের সঙ্গে বন্ধুত্ব শুরু। ঝাড়খণ্ডের সাঁওতালি পরগনায় বড় হওয়ার জন্য হিন্দির সঙ্গে সাঁওতালি ভাষাও জানেন তিনি। রীতিমতো গোগ্রাসে পড়া শুরু। লেখাও শুরু তখনই। নিজের মতো করেই লিখতেন কবিতা। নিজের কথা, মায়ের কথা, বাড়ির কথা; সেই সঙ্গে আশেপাশের কথা। তারপর রাঁচির ‘রাহি’ পত্রিকায় প্রথম লেখা বের হল। যাত্রার সেই শুরু।

‘তরুণ কবি কখন তোমায় বলত লোকে?’ এমন কথা হয়ত মনে আসত জাসিন্তা কেরকেট্টারও। আস্তে আস্তে যাপনে কবিতার জড়িয়ে পড়ারও শুরুয়াত। অক্ষরের সঙ্গেই ঘর সংসার শুরু। সব কিছু যখন চলছে ঠিকঠাক, তখনই সাংবাদিকতার চাকরি পেলেন। কবিতা থেমে গেল হঠাৎ। অস্থিরতা কি ছিল না তখন? হাসলেন তিনি। ‘হ্যাঁ, অস্থিরতা ছিল। কিন্তু আমি তখন কাজের সূত্রেই আরও বেশি মানুষজনের মাঝে যেতে পারছিলাম। তাদের জীবনযাত্রা, কথা, অভাব সমস্তকিছু দেখি। সেই সব আমার জীবনে ছাপ ফেলে মারাত্মক। আমার কবিতাও বাঁক নেয়। তাদের কথা উঠে আসে লেখায়।’

তিন বছর লেখালেখি থেকে দূরে থাকেন। তারপর আবারও ফিরে আসেন, ২০১৩ সালে। চাকরিও ছেড়ে দেন। ছোটো থেকে যে আদিবাসী মানুষদের দেখেছেন, ঘরে নিজের মা’কে অত্যাচারিত হতে দেখেছেন— সেই সমস্তটাই নতুন করে যেন উঠে আসে। তাঁর মায়ের কাহিনি যে ‘আরও পাঁচটা ঘরের কাহিনি’। তাই কবিতাকে নিভৃতের সাধনা বলে মানেননি জাসিন্তা কেরকেট্টা। মানুষের মাঝে থেকে সাধনার চরমে পৌঁছনোর কথা বলেন তিনি।

২০১৬ সালে বেরোয় জাসিন্তা করকেট্টার প্রথম হিন্দি বই ‘আঙ্গোর’। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কলকাতাও। জাসিন্তা’র বইয়ের প্রথম প্রকাশক ‘আদিবাণী’ যে কলকাতারই। প্রথম বই থেকেই তিনি নিজের সুর বেঁধে দেন। তাঁর প্রতিবাদ, আদিবাসী সমাজের সুখ দুঃখের গল্প, লড়াই সমস্ত কিছুই যেন ছুঁয়ে গিয়েছিল ‘আঙ্গোর’। সূচনা থেকেই তাঁর জয়যাত্রা শুরু। ভারতের অন্যান্য ভাষাতে অনুবাদ তো হয়ই, ছড়িয়ে পড়ে বিদেশেও। জার্মানেও অনূদিত হয় বইটি। তারপর আর থেমে থাকেননি জাসিন্তা। তাঁর কবিতাও তুলে এনেছে আরও গল্প।

সাংবাদিকতাকে আজও আঁকড়ে ধরে আছেন তিনি। তবে আর চাকরির জালে জড়াননি নিজেকে। বরং লেখাকে ধরে উড়ে গেছেন দেশ থেকে দেশে। আমেরিকা, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া - নানা দেশ থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছেন তিনি। তাঁর লেখা পড়ানো হয় রাশিয়াতেও।

প্রতিবাদই তাঁর অস্ত্র। তবু, লেখালেখির জগতের অন্ধকার দিকগুলোর প্রতি বিশ্বাস রাখেন না তিনি। আসলে যা দেখেন, যা ভাবেন; সেটাই বলেন। ভেতরে লুকিয়ে রাখার তো কিছুই নেই। দিনের শেষে, লেখাটাই তো আসল। নিজের কথা, বলা ভালো নিজেদের কথাগুলো সবার মধ্যে এভাবেই ছড়িয়ে দিতে চান তিনি।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কবিতাই হতে পারে সেই অস্ত্র, কলমের জোরই সবথেকে বেশি - এই কথাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন জাসিন্তা করকেট্টা। শুধু দেশে নয়, এই কথাগুলো সব জায়গায় ছড়িয়ে যাক। তাতে যদি একজনেরও ভালো হয়, একটুও বদল আসে, তাহলেই নিজেকে সার্থক মনে করবেন জাসিন্তা। পাঠক হিসেবে, আমরাও কি আনন্দিত হব না?

Latest News See More