মৃতদেহ ঠুকরে খেত চিল-শকুনে, শেষকৃত্যের সেই ঠিকানা কলকাতায় রয়েছে আজও

আজকের কলকাতার অন্যতম ব্যস্ত রাস্তা বেলেঘাটা মেইন রোড। সারাদিন রাস্তায় গাড়ির জট লেগেই থাকে। কিন্তু একদিন এখানে মানুষের বসতি বলতে কিছুই ছিল না। দিনের বেলা ছিল ডাকাতদের আস্তানা, আর সন্ধে নামলেই শেয়াল ডাকত। সে আজ থেকে দুই শতাব্দী আগের কথা। সে দৃশ্য কল্পনাতেও দেখতে পারবেন না। কিন্তু 'টাওয়ার অফ সাইলেন্স' তা দেখেছে। শেয়ালদা স্টেশন পেরিয়ে শহরের একপ্রান্তে সেই ভূতের রাজত্বের সাক্ষী আজও নীরবে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার একধারে। তার নামের মধ্যেই যে সেই নীরবতার কথা আছে।

আরও পড়ুন
করোনা-আক্রান্তের মৃত্যু হলে শেষকৃত্য ধাপায়, নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত প্রশাসনের

বিরাট ফটকের ওপারে উঁচু মিনারটা আজও শহরের সমস্ত কোলাহলের সীমানা পেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশটা বদলে গিয়েছে অনেকটা। এখন আর আশেপাশে চিল-শকুনের দেখা মেলে না। কিন্তু একটা সময় তারাও এখানে অপেক্ষা করে থাকত। কখন একটি মৃতদেহ আসবে, পল-বিয়ারারের দল সেটিকে নীরবে তুলে দেবে মিনারের চূড়ায়। আর তারপর সেই মৃতদেহের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে এগিয়ে আসবে মাংসাশী পাখিরা। তখন ডানার ঝাপটে আর অবিরাম চিৎকারে সমস্ত নীরবতা ভেঙে খানখান হয়ে যাবে। এখন আর চিল-শকুনেরা অপেক্ষা করে থাকে না। মৃতদেহও আসে না বললেই চলে। কলকাতায় আর পার্সি মানুষের সংখ্যাই বা কত! সব মিলিয়ে বড়জোর ৪০০ হবে। তবে উনিশ শতকে এই কলকাতা শহরেই এক লক্ষ পার্সি নাগরিক বাস করতেন।

আরও পড়ুন
মৃত্যুর আগেই সাক্ষাৎ নরকযন্ত্রণা – যেসব নৃশংস পদ্ধতিতে শাস্তি দেওয়া হত বিভিন্ন দেশে

কম্পানি বাহাদুরের কৃপায় কলকাতা তখন নতুন কসমোপলিটান। আইনি-বেআইনি নানাধরনের ব্যবসার কেন্দ্রে তখন কলকাতা। আর সেই ব্যবসার টানেই পৃথিবীর প্রায় সমস্ত জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষ এসে আস্তানা তৈরি করছেন এখানে। আর তার মধ্যে অগ্নি-উপাসক পার্সিরা ধনে-বিদ্যায়-ঐশ্বর্যে এগিয়ে ছিল সকলের থেকেই।

আরও পড়ুন
মারা গেছেন দুদিন আগেই, ছবিতে ভেসে উঠল সৈনিকের ‘অশরীরী’ মুখ

পার্সি ব্যবসায়ী দাদাভাই বেহরামজি বানাজি সুরাট থেকে কলকাতা এসেছিলেন ১৭৬৭ সালে। তবে ব্যাপকভাবে পার্সি বসতি গড়ে উঠতে থাকে উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। মূলত প্রত্যেকেই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কলকাতায় তাঁদের উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল একাধিক এন্টারপ্রাইজ। তবে বাঙলা ও বাঙালির সঙ্গে মিলেমিশে যেতে তাঁদের বেশি সময় লাগেনি। অনেকের তো পদবীর শেষে 'বেঙ্গলি' শব্দটাও যুক্ত হয়ে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন
পাঞ্জাবী ধর্মপ্রচারকের থেকে সংক্রমণ ২৩ জনের, আশঙ্কা আরও কয়েক হাজারের

তেমনই একটি পরিবার সোরাবজি পরিবার। কলকাতার পার্সিদের মধ্যে একজন অগ্রণী ব্যবসায়ী ছিলেন নওরোজি সোরাবজি বেঙ্গলি। এদেশের পার্সি জনজাতির মানুষদের একজোট করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। আর সেই সূত্রেই কলকাতায় তৈরি করেছিলেন একটি দখমা। ইংরেজিতে যাকে বলে 'টাওয়ার অফ সাইলেন্স'।

আরও পড়ুন
মৃত্যুর এক সপ্তাহের মধ্যেই পরিণত মমিতে, সমুদ্রে ভাঙা ইয়টে নাবিকের মৃতদেহ

পার্সির মৃতদেহকে কবরে দেয় না, চিতায় পোড়ায় না। মৃত্যুর পর তাদের লোকালয়ের বাইরে একটি উঁচু মিনারের উপর রেখে আসে। সেখানে মাংসাশী পাখির দল আত্মসাৎ করে মৃত মানুষটির শরীর। এভাবেই প্রকৃতির মধ্যে সেই শরীর মিশে যায়। এই মিনারকেই বলা হয় দখমা। বেলেঘাটা অঞ্চলে জঙ্গলের মধ্যে দখমা তৈরির কাজ শুরু হয় ১৮২২ সালে। খরচ পড়েছিল তখনকার দিনে ৩৫ হাজার টাকা। মূল উদ্যোক্তা ছিলেন নওরোজি। সঙ্গে অন্যান্য ব্যবসায়ীরাও এগিয়ে এসেছিলেন। ১৮২৮ সালের ২৮ জানুয়ারি উদ্বোধন হয় টাওয়ার অফ সাইলেন্স। পূর্ব এশিয়ায় এটাই পার্সিদের প্রথম শেষকৃত্যভূমি। রেঙ্গুন, সিঙ্গাপুর, মালয় থেকেও মৃতদেহ বয়ে আনা হত বহুদিন। এখন আর সেই প্রথা নেই বললেই চলে। পার্সিরাও অনেকে বিকল্প সৎকারের ব্যবস্থা করছেন। তাছাড়া চিল-শকুনও তো আর নেই। মৃতদেহ সৎকারের জন্য এই দখমার চূড়াতেও বসানো হয়েছে সৌরচুল্লি। কিন্তু দুশো বছরের ইতিহাস বুকে নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে 'মৌন শিখর'।

আরও পড়ুন
নেতাজির মতো, গুমনামী বাবার মৃত্যুর সঙ্গেও জড়িয়ে আছে রহস্য

কলকাতার বুকে এমন কত ইতিহাস আজও রয়ে গিয়েছে। আমরা রাস্তায় ব্যস্ত চলাফেরার মধ্যে মাঝে মাঝে সেসবের সামনে থমকে দাঁড়ান অনেকেই। কিন্তু ইতিহাসের কতটুকুই বা খোঁজ রাখি আমরা? অনেক অনেক বছর আগে, যখন বেলেঘাটার খালটাও ছিল না, তখন কেমন ছিল এই এলাকা। সেই জঙ্গলের নিশ্ছিদ্র নীরবতার চেহারা কেমন ছিল? আজ আর কিছুই জানা যাবে না। টাওয়ার অফ সাইলেন্সের আশেপাশে তার খানিকটা আভাস হয়তো পেতে পারেন।

তথ্যসূত্র: অচেনা এই কলকাতা, রমাপদ চৌধুরী (সম্পা.), টাওয়ার অব সাইলেন্স, অশোক ভট্টাচার্য
কলকাতায় এখন চারশোর কিছু বেশি পার্সির বাস, শীর্ষ বন্দোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা

Powered by Froala Editor

More From Author See More