বাংলার 'প্রথম' চলচ্চিত্র সমালোচক তিনি, চিদানন্দ দাশগুপ্তকে কতটা মনে রেখেছে বাঙালি?

প্রথম মুভি ক্যামেরা হাতে নিয়ে গোটা দক্ষিণ এশিয়াকে চমকে দিয়েছিলেন হীরালাল সেন। তবু বিশ শতকের প্রথম চারটি দশক ধরে বাংলা চলচ্চিত্রের শৈশবদশা যেন কাটছিল না। এদিকে সাহিত্যের জগতে তখন নানা ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। নাটকের জগতে শিশির ভাদুড়ীর প্রবল প্রতাপের মাঝেই গড়ে উঠেছে গণনাট্যের স্বতন্ত্র ধারা। বিশ্ব চলচ্চিত্রের আসরে গ্রিফিথ, আইজেনস্টাইনদের যুগ পেরিয়ে জার্মানির এক্সপ্রেসনিস্ট সিনেমা, তারও পরে নিও-রিয়্যালিস্ট যুগের সূচনা ঘটে গিয়েছে। বাঙালিকে সেইসব সিনেমা দেখাতে হবে, দেখতে হবে বাংলার চলচ্চিত্র নির্মাতাদেরও। কলকাতায় বসে এই কথাই ভাবছিলেন কয়েকজন তরুণ। এভাবেই সদ্য স্বাধীন দেশে গড়ে উঠল ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি। কিন্তু সিনেমা দেখানো হবে কোথায়? বন্ধুদের মধ্যেই ছিলেন চিদানন্দ দাশগুপ্ত (Chidananda Dasgupta)। ঠিক হল, তাঁর বসার ঘরেই সিনেমা দেখা হবে।

১৯৪৭ সালে ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি তৈরির নেপথ্যে ছিলেন সত্যজিৎ রায়, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, হরিসাধন দাশগুপ্তের মতো তরুণরা। আর অবশ্যই চিদানন্দ দাশগুপ্ত। বন্ধুবর্গের প্রায় প্রত্যেকেই পরে নিজ নিজ ক্ষেত্রে কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন। শুধু চিদানন্দ দাশগুপ্তই যেন খ্যাতির অন্তরালে থেকে গিয়েছেন। বলা ভালো, নিজেকে আপন ভুবনে লুকিয়ে রেখেছেন। অথচ তাঁর পরিচয় কেবল সত্যজিৎ রায় বা হরিসাধন দাশগুপ্তের বন্ধু হিসাবেও নয়। ভাবলে অবাক হতে হয়, বিশ্ব চলচ্চিত্রের বাইবেল নামে পরিচিত ছিল যে ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ পত্রিকা, তার আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে চিদানন্দ দাশগুপ্তর লেখা অসংখ্য প্রবন্ধ। এদিকে বাংলায় সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে মিলে প্রকাশ করে গিয়েছেন ‘ইন্ডিয়ান ফিল্ম কোয়ার্টারলি’ পত্রিকা। বিভিন্ন পত্রিকায় এবং বইয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবন্ধগুলি আজও যে-কোনো সিরিয়াস চলচ্চিত্রপ্রেমীর অবশ্যপাঠ্য।

আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে চেরাপুঞ্জি শহরে জন্ম চিদানন্দ দাশগুপ্তের। বাবা মন্মথনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন একজন ব্রাহ্ম মিশনারি। সেই সূত্রে খুব অল্প বয়সেই নানা শহর ঘুরেছেন চিদানন্দ। তারপর এসে থিতু হয়েছিলেন হাজারিবাগ শহরে। বাবা মন্মথনাথ ছিলেন গান্ধীবাদী আদর্শে দীক্ষিত। কলেজে পড়ার সময়েই চিদানন্দও জড়িয়ে পড়েন স্বদেশি আন্দোলনে। স্বদেশি কার্যকলাপের জন্য তাঁকে কলেজ থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তও নেয় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। তবে পড়াশোনায় মেধাবী চিদানন্দকে সহজে বহিষ্কার করতে চাননি অধ্যক্ষ। তাই তাঁকে একটি মুচলেকাপত্রে সই করতে বলা হয়। এদিকে বাবা মন্মথনাথ বলে দিয়েছেন, মুচলেকায় সই করলে আর ঘরে ঢোকা যাবে না। এইসবের মধ্যেই এসে পড়ল ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক।

তবে এতকিছুর পরেও রাজনীতির স্রোতে ভেসে যাননি চিদানন্দ। খুব তাড়াতাড়ি নিজেকে সরিয়ে এনে ডুব দিয়েছেন সংস্কৃতির জগতে। তবে রাজনৈতিক চেতনার প্রতি দায়বদ্ধতা কোনোদিন ক্ষুণ্ণ হয়নি। তাই গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস এবং দেশভাগের অগ্নিগর্ভ সময়ে তাঁর মনে হয়, সামান্য কিছু নিউজ রিল তোলার মধ্যে দিয়ে এই সময়কে ধরা যাচ্ছে না। সিনেমার মধ্যে কীভাবে সময়কে ধরতে হয়, সেটা বুঝতে হবে। এই ভাবনা থেকেই ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি তৈরি। আর তার কিছুদিনের মধ্যেই প্রত্যেকে অবাক হয়ে দেখলেন ইতালির সাড়া জাগানো সিনেমা ‘বাইসাইকেল থিভস’। নিওরিয়্যালিজমের ধারায় এমন অনবদ্য বুনট মুগ্ধ করল সোসাইটির সবাইকেই। কিন্তু কাকে বলে নিওরিয়্যালিজম? চলচ্চিত্রের এই ধারাটির তাৎপর্যই বা কতখানি?

আরও পড়ুন
গন্ডোয়ানা ল্যান্ডের আগেও ছিল পৃথক মহাদেশ? সম্ভাবনা উস্কে দিলেন দুই বাঙালি

সত্যজিৎ রায়, হরিসাধন দাশগুপ্ত যখন হাতে কলমে ক্যামেরা তুলে ধরছেন, তখন এই সমস্ত তাত্ত্বিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নিমগ্ন হলেন চিদানন্দ। আবার ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির পর সারা দেশজুড়ে চলচ্চিত্র সংসদগুলির ফেডারেশন তৈরিতেও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন তিনি। অবশ্য পরবর্তীকালে নিজেও সিনেমা বানিয়েছেন। সর্বমোট ৭টি সিনেমা পরিচালনা করেছেন তিনি। এর মধ্যে ‘পোট্রেট অফ আ সিটি’, ‘ডান্স অফ লর্ড শিবা’ বা ‘বিলেত ফেরৎ’-এর মতো সিনেমা সমালোচকদের অবাক করেছে। আবার ১৯৯৬ সালে শেষ সিনেমা ‘আমোদিনী’ দর্শকদেরও মন জয় করে নিয়েছে। পাশাপাশি প্রবন্ধ লেখা তো চলেছেই। বাঙালি দর্শককে ভালো সিনেমার রস বুঝতে শিখিয়েছেন ‘বই নয় ছবি’ প্রবন্ধমালায়। একইসঙ্গে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যের অনুবাদও করে চলেছেন। জীবনানন্দের সঙ্গে অবশ্য আত্মীয়তার সম্পর্কও ছিল তাঁর। চিদানন্দের স্ত্রী সুপ্রিয়া দেবী ছিলেন জীবনানন্দের দাদা ব্রহ্মানন্দ দাশগুপ্তের মেয়ে।

আরও পড়ুন
বাঙালির ইংরেজি সাহিত্যচর্চার শেষ আলোকস্তম্ভ ছিলেন তিনি

শেষ বয়সে শরীরে বাসা বেঁধেছিল পারকিনসন্স রোগ। হুইলচেয়ার ছাড়া চলাফেরা করতে পারতেন না। স্মৃতিশক্তিও দুর্বল হয়ে আসছিল। গলার স্বর কমে এসেছিল। তবু পড়াশোনা এবং লেখালিখিতে ক্লান্তি ছিল না কোনোদিন। অসীম প্রাণশক্তির অধিকারী এই মানুষটিকেও শেষ পর্যন্ত সমস্ত কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই বিদায় নিতে হয়। ২০১১ সালে তাঁর মৃত্যুর পরেও খুব বেশি আলোরন দেখা যায়নি বাঙালির মধ্যে। তাঁর অক্লান্ত উদ্যোগের প্রকৃত মূল্যায়ন কোনোদিন হবে কি?

আরও পড়ুন
স্টিফেন হকিং-এর কাছে তিনি ‘গ্রেটেস্ট’, বিস্মৃতির অতলে বাঙালি পদার্থবিদ জে এন ইসলাম

তথ্যসূত্রঃ চিদানন্দ দাশগুপ্ত তাঁর সময় ও সমসাময়িককাল, তারেক আহমেদ, শিল্প ও শিল্পী
There was an intellectual honesty in my father: Aparna Sen, Atanu Roy, UniIndia

Powered by Froala Editor

More From Author See More