একশো দিনের কাজ থেকে এশিয়ান গেমসে পদকজয়! রাম বাবুর স্বপ্নের উড়ান হার মানায় গল্পকেও

বছর তিনেক আগের কথা। করোনা ভাইরাস নামের এক আতঙ্ক আচমকা স্তব্ধ করে দিল সারা দেশকে। লকডাউন আর সামাজিক দূরত্বের মতো সদ্যপরিচিত শব্দগুলির সঙ্গে এক অস্বস্তিকর লড়াই চলছে রোজকার রুটিরাজির। সেই সময়ে ভোপাল থেকে উত্তরপ্রদেশে নিজের গ্রামে ফিরে এলেন এক যুবক। স্বপ্ন অনেক, হাঁটতে হবে বহুদূর। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর দ্রুতপায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সাফল্যের দিকে। আর তখনই ফিরে আসতে হল গ্রামে। অত্যন্ত ‘সৌভাগ্য’ যে মাস কয়েক পরেই গেলেন একশো দিনের কাজ। পিচগলা রোদ্দুরে রাস্তার কাজে ঘাম ঝড়াতে ঝড়াতে নিশ্চয়ই শক্ত হয়ে উঠেছিল তাঁর চোয়াল। পায়ের পেশিতে ভর করেছিল শত অবহেলাকে যোগ্য জবাব দেওয়ার জেদ। হার মানা যাবে না। সরে আসা যাবে না লড়াই থেকে। ওয়েটারের জীবন হোক বা রাস্তার কাজ, লক্ষ্য থেকে সরানো যায়নি রাম বাবুকে (Ram Baboo)। এবছরের এশিয়ান গেমসের (Asian Games) ৩৫ কিমি মিক্সড হাঁটা প্রতিযোগিতায় (Race Walk) মঞ্জু রানির (Manju Rani) সঙ্গে ব্রোঞ্জ পদকজয়ী (Bronze Medal)রাম বাবুর সাফল্যের পিছনে লুকিয়ে আছে সেই অবিশ্বাস্য গল্প।

উত্তরপ্রদেশের শোনভদ্র জেলার বেহুরা গ্রামে তাঁর জন্ম। বাবা জনমজুর, ফসলের সময় কাজ করতেন অন্যের জমিতে। বড়ো সংসার চলে না সেই আয়ে। বছরের বাকি সময় অবস্থা হয়ে ওঠে আরো শোচনীয়। ফলে দারিদ্র্য আর অভাব ছিল রামের ছোট্টবেলার বন্ধু। পড়াশোনাতেও যে আগ্রহ ছিল তা নয়, বরং ভালো লাগত দৌড়তে। স্কুলের বন্ধুরা তাঁর সঙ্গে কিছুতেই দৌড়ে পেরে ওঠে না। ফুটবল হোক কিংবা দৌড়, ক্লান্তি বলে কিছু নেই তাঁর শরীরে। সেটা ২০১২ সাল। মেরি কম, সাইনা নেহওয়াল, সুশীল কুমাররা লন্ডন অলিম্পিক্সে পদক জিতে হয়ে উঠেছেন জাতীয় ‘বীর’। খবরের কাগজের প্রথম পাতায় উঠছে তাঁদের ছবি। কিশোর রাম বাবু লুকিয়ে জমা করতেন সেগুলি, কেটে জমিয়ে রাখতেন খাতার ভাঁজে। দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করা আর পদকজয়ের স্বপ্ন দেখাও শুরু তখন থেকেই।

প্রথমে ইচ্ছে ছিল ম্যারাথন দৌড়ে খুঁজে নেবেন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। শুরু করেন পাঁচ কিমি আর দশ কিমি দৌড়ের প্রস্তুতি। কিন্তু পর্যাপ্ত খাবার? চোট পেলে তার চিকিৎসা? সেই সামর্থ্য কোথায় তাঁর পরিবারের? যা আশঙ্কা ছিল, তাই হল। হাঁটুর ব্যথায় চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে গেল ম্যারাথনের রাস্তা। তখন কোচ প্রমোদ যাদবের পরামর্শে শুরু হল হাঁটা। কারণ, তাতে হাঁটুতে চাপ পড়ে কম। সঙ্গে এটাও বুঝতে পেরেছিলেন স্বপ্ন সত্যি করতে হলে এই গ্রামে পড়ে থাকলে হবে না, যেতে হবে সঠিক প্রশিক্ষণকেন্দ্রে। টক্কর দিতে হবে সমানে-সমানে। শিখতে হবে নির্দিষ্ট কোচের থেকে। ২০১৭-তে মাত্র ১৭ বছর বয়সে বাবু চলে এলেন বেনারসে। 

কিন্তু থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হবে কীভাবে? পরিবার থেকে কিছু টাকা দিলেও সে তো শেষ হয়ে যাবে কয়েকদিনের মধ্যেই। এদিকে বেনারসে ঘরভাড়া মাসে ১৫০০ টাকা। তাহলে কি ফিরে যেতে হবে সব ছেড়ে? না, এক অজানা শহরে লড়াই করে ছিনিয়ে নিতে হবে নিজের জায়গা। একটা হোটেলে ওয়েটারের কাজ নিলেন তিনি। মাইনে মাত্র ৩০০০ টাকা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খাটনি। কখনও কখনও রাত একটা পর্যন্ত কাজের ছুতোয় আটকে রাখা হত তাঁকে। আবার পরদিন সকাল চারটের সময় ছুটতেন প্র্যাক্টিসে। পরিশ্রম নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিল না, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে প্রতি মুহূর্তে অপমান মাথা পেতে নিতে তিনি রাজি নন। যেন তাঁকে মানুষের পর্যায়ে গণ্য করে না কেউ। তাদের যোগ্য জবাব দিয়ে কাজ ছেড়ে ফিরে এলেন গ্রামে। কিছুদিন করলেন পাটের ব্যাগ সেলাইয়ের কাজ। 

আরও পড়ুন
৬১ বছরে টানা পাঁচ দিন দৌড়ের রেকর্ড! শক্তি জুগিয়েছিল কৈশোরের স্মৃতি

২০১৯-এ ভোপালের ‘স্পোর্টস অথোরিটি অফ ইন্ডিয়া’ বা সাই-তে ফের সুযোগ পান বাবু। ৫০ কিমি জাতীয় হাঁটা প্রতিযোগিতায় চতুর্থ স্থানও অর্জন করেন। সবই চলছিল সঠিক ‘ট্র্যাক’-এ। আর তারপরই নেমে এল কোভিড অতিমারি। বন্ধ হয়ে গেল সাই-এর দরজা। নতমুখে ফিরে আসতে হল গ্রামে। কয়েকমাস পরেই বাবার সঙ্গে নেমে পড়লেন ‘মনরেগা’-র একশো দিনের কাজে। রাস্তার জন্য মাটি খোদাইয়ের কাজ যেন ‘সৌভাগ্য’ হিসেবেই দেখা দিল তাঁর কাছে। সৌভাগ্য! যাঁর স্বপ্ন অলিম্পিকসে দেশের জন্য পদক এনে দেবেন, তিনি কিনা মাটি কাটার কাজকে ‘সৌভাগ্য’ বলছেন? হ্যাঁ, আজীবন দারিদ্র্যের সঙ্গে ঘর করে তিনি জানেন পেট ভাত জোটানোটা কত বড়ো লড়াই। সেটুকুর জন্য যে একটা কাজ জুটে গেছে, এর চেয়ে বড়ো সৌভাগ্য আর কী হতে পারে? 

আরও পড়ুন
১০৫ বছরে দৌড়ে জাতীয় রেকর্ড

দেড়মাস সেখানে কাজ করেন বাবু। পেতেন দিনে তিনশো থেকে চারশো টাকার মতো। তারপর লকডাউন একটু শিথিল হতেই ফিরে আসেন ভোপালে। এবার আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ৫০ কিমি হাঁটায় দ্বিতীয় হয়ে বসন্ত রানার কোচিংয়ে চলে আসেন পুনের আর্মি স্পোর্টস ইনস্টিটিউটে। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে ন্যাশন্যাল গেমসে ৩৫ কিমি হাঁটায় জেতেন সোনা। ডাক আসে বেঙ্গালুরুর জাতীয় শিবিরে। 

অবশেষে এল ২০২৩-এর ১৯তম এশিয়ান গেমসের বহু প্রতীক্ষিত দিন। সতীর্থ মঞ্জু রানির সঙ্গে ৩৫ কিমি হাঁটা প্রতিযোগিতায় ছিনিয়ে নিলেন ব্রোঞ্জপদক। ভারতের একশোটির বেশি পদকজয়ের ঐতিহাসিক কৃতিত্বে উজ্জ্বল হয়ে রইল দুজনের নাম। জীবনের শুরুটা ভালো হয়নি রাম বাবুর। কিন্তু লক্ষ্য থেকে সরেননি কিছুতেই। যদিও মূল লক্ষ্য এখনও অনেক দূরের রাস্তা। সামনের বছর প্যারিস অলিম্পিক। হাঁটতে হবে, আরো হেঁটে যেতে হবে। মাটি কামড়ে পড়ে আছেন রামবাবু। পথের শেষ দেখার জন্য। 

ঋণস্বীকার : sports.ndtv.com

Powered by Froala Editor