“মুই ঠিক করবার নি পারিম, পেট আর মুক কারে খিলাই, এ কাজে বুক ভরে তো মোর পেট নি ভরে, অলগ পেট ভরে তো বুক খাঁ খাঁ করে…”
আরও পড়ুন
শিল্পই হোক শিল্পীর একমাত্র পরিচয়, ‘স্বশিক্ষিত’ ছবিওয়ালাদের প্রদর্শনীর সাক্ষী কলকাতা
ছুটির দুপুর। সদ্য পেরোনো কোজাগরীর আলপনা তখনো পায়ে পায়ে মুছে যায়নি। এ-হাট ও-হাট ঘুরে, খানিক টাটকা সবজি, দুধ, কলাই ডালের বড়ি এসব জোগাড় করে, ততোধিক টাটকা বাতাস বুকে নিয়ে ক্লান্ত পা দু’খানা যেন আড় ভাঙতে চাইছে না। মাটির দাওয়ায় বিছানো মাদুর, পিঁড়ি। খড়িমাটি আর চালের গুঁড়োয় আঁকা লক্ষ্মীর পা দরজা থেকে উঁকি দিচ্ছে। আর এসবের মাঝেই চাক ঘুরছে। বিরামহীন। আর তার সঙ্গে ঘুরছে এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের চাকা। আসলে বিরোধ এখানে নেই। পথ একটাই। ঘটি-বাটি সবকিছুই মাটির কাছে বাঁধা পড়ে আছে। এখানে রক্তে মাটির টান। তার সঙ্গে কোনো আপোস নেই। তবু বাস্তব কখনো চড়া রোদ ফেললে এমন উদাস সুর ভাসে বৈকি! উত্তর দিনাজপুর কালিয়াগঞ্জের কুনোর হাটপাড়া গ্রাম। এখানে সকলেই মাটির মানুষ। মূলত রাজবংশী সম্প্রদায়ের এই মানুষেরা জীবিকা বুনেছেন পোড়া মাটির শিল্পে। প্রায় সমস্ত পরিবারই এই কাজে যুক্ত৷ এ এক মাটির গ্রাম। মাটিই তাদের বুকের টান, পেটেরও। যদিও দুইয়ের মধ্যে সদ্ভাব ঘটে না সব সময়। তবুও সেই মাটিতেই পা গাঁথা।
মানুষের জীবনের নানা ক্ষেত্রে, কৃষ্টিতে, আচার-ব্যবহারে বারবার ঘুরে ফিরে আসা এই মাটিকে অস্বীকার করার উপায় নেই। মৃৎ-শিল্পের ইতিহাসও সুপ্রাচীন। বাংলার মাটি খুঁড়ে যত অরূপরতন মিলেছে তার প্রায় আশি ভাগই এই মৃৎ-শিল্প কেন্দ্রিক। তবে পাঁচমোড়া, ঘূর্ণি কিংবা বিষ্ণুপুরের পাশে -'তত বিখ্যাত নয় এ হৃদয়পুর।'
আরও পড়ুন
লেবুর বীজে সরস্বতী প্রতিমা, নতুন কীর্তি অশোকনগরের শিল্পীর
যদিও এমন তুলনা টানতেই চাইছি না। বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া এই ছোট্ট গ্রাম তার ভিতর দিয়ে বয়ে আসা চিরাচরিত প্রথায়, স্বকীয়তায় যেন কোল পেতেই রেখেছে। একবার বসে পড়লেই হল, গ্রামে পৌঁছে, চলে যাওয়া যায় যে কোনো দিকেই। যে কারো ঘরের দাওয়া অচিরেই আপন করে নেবে। গপ্পো চলতে চলতে কাজও এগোবে। ততক্ষণে ঘরের মানুষটি ভিতর থেকে যত্ন করে পাঠিয়ে দেবে চা। তারপরই বসে পড়বে মাটি মাখার কাজে। ছড়ানো উঠোনে ভাটির আগুনে মাটি পুড়ছে ধিকি ধিকি। একে একে ফুটছে - পীর ঘোড়া, জোড়া হরিণ, পঞ্চ প্রদীপ, গণেশ, ধূপদানী, হাতি, ফুলদানি, ঝাড়লন্ঠন, আরো কত কী!
আরও পড়ুন
রঙের বদলে সোনা দিয়েই ছবি আঁকেন শিল্পী, মূল্য কোটিরও ওপরে
দেখতে দেখতে ঘোর লেগে যায়। কালিয়াগঞ্জ সদর থেকে তরঙ্গপুর হয়ে হাট কালিয়াগঞ্জ। পাশে পাশে সঙ্গ দেবে বিগতযৌবনা শ্রীমতি নদী৷ তাকে ছুঁয়ে আদিগন্ত উঁচু-নিচু ঢালুপথ, ইটভাঁটা, পোড়ো মন্দির, নয়ানজুলি আলের রেখার পরিচিত আউটলাইন। এরপরই হাসিমুখে পথ আগলে দাঁড়াবে একখানা সাঁকো। ঝিরি ঝিরি বইছে বাঁশডুমনি নদী। অতীতে নাকি আস্ত একখানা বাঁশ ডুবে যেত তার বুকে, সেই থেকে এই নাম। স্থানীয় জমিদার নাকি গ্রামের প্রায় ছত্রিশজন শিল্পীকে এই নদী দান করেছিলেন। এখন ছবি খানিক বদলেছে, নদীর বদলে বিল বলাই ভালো। তবে আজো তার শীর্ণ বুক থেকেই কাদামাটি সংগ্রহ করেন অরুন রায়, রঞ্জিতা রায়, বিদ্যুৎ রায়রা। এভাবেই এ নেশায় বুদ হয়ে আছেন সকলে। থেমে নেই খুদেরাও। এই প্রজন্ম স্কুলে যায়, ফিরে এসে কাজে হাত লাগায়। হই হই করে চলে মাটির তাল তুলে আনা, পরিমাণ মতো জল মেশানো। আসার পথে ছিপ ফেলে মাছ ধরতে বসা একঝাঁক হাসিমুখ চোখ এড়ায় না, মাঝদুপুরে যেন গুপ্তধনের খোঁজে নেমেছে খুদেবাহিনী। একটা ছবি ধরে রাখতে চাইলে সার দিয়ে একে অন্যের ঘাড়ে মাথায় উঠে বসে পড়ে রাস্তা জুড়ে।
আরও পড়ুন
ছুটন্ত ট্রেন আর প্রিয় মানুষের বাড়িয়ে দেওয়া হাত, পর্দার বাইরেও অপেক্ষা সেই ভরসারই
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মিশে আছে এই মাটির টান। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এরা এই পেশা ছাড়ার কথা ভাবতে পারে না। তবে ব্যতিক্রমও ঘটেছিল। ২০০৯ সাল। নামডাকে প্রথম সারির শিল্পী দুলাল রায় চাননি ছেলে সমরেশ এই পথে হাঁটুক। ততদিনে পুরস্কারের খ্যাতি, আলো ছড়িয়েছে তার ঘরে, সরকারি অনুদানে বাকিদের চেয়ে আর্থিক অবস্থাও তার ভালো, তবু জেদ করেই ছেলেকে পাঠালেন প্রথাগত বাণিজ্যের পাঠ নিতে। কিন্তু শিকড়ের টান যাবে কোথায়? লোকশিল্পের আজন্ম লালিত সত্ত্বা তাকেও টেনে আনল এই মাটিরই কাছে। মগজে পুঁথিগত জ্ঞান আর পেটে শিল্পের খিদে এই দুইকে সম্বল করে এম বি এ ছেড়ে সমরেশ নেমে পড়ল এই কাজে। তার পূর্বপুরুষদের ঘাম রক্তের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই পোড়ামাটির শিল্পেই ফের সমর্পণ।
আরও পড়ুন
চিত্রশিল্পীর স্মরণে মেলা, ব্যতিক্রমী উদ্যোগ বাংলাদেশের গ্রামে
শুরুর পথ অমসৃণ হলেও অসীম ধৈর্য, দক্ষতা, পরিশ্রম আর তৎপরতায় গড়ে উঠল টেরাকোটা ইন্ডাস্ট্রি। কাজে লেগে গেল অনুরোধে ফিরে পাওয়া সেই এম বি এ তে ভর্তির টাকা। এ যেন ঘরের মানুষের হাত ধরে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়া। সহজ ছিল না মোটেই। কাঁধে ঋণের বোঝা নিয়েই পথ চলা শুরু। প্রথম ফরমায়েশ এলো গড়ে দিতে হবে একশো খানা মাটির গয়না। যার খরচ প্রায় হাজার দশেক অথচ হাতে এলো পাঁচ হাজার টাকা। ফলস্বরূপ সমস্ত অর্ডার বাতিল। ফের ঘুরে দাঁড়ানো। চাকা যে থামালে চলবে না। এ গ্রামের জল-হাওয়া তো সেই কথাই আবহমান ধরে বলে আসছে। এ এক প্রাচীন কৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই। আজ আর ফিরে তাকাতে হয় না। প্রায় দেড়- দু লাখ টাকার মাটির গয়না, ঘর সাজাবার সামগ্রী, পাড়ি দেয় দেশের নানা রাজ্যে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ইউরোপ অস্ট্রেলিয়াতেও। লোকায়নের সাথে বিশ্বায়নের মেলবন্ধন। প্রকৃত অর্থেই আজ - "দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায় "…
আরও পড়ুন
সাধারণ শিল্পী থেকে রাতারাতি বিশ্বের দরবারে, হোয়াটসঅ্যাপই জীবন বদলে দিয়েছে নারায়ণনের
কালিয়াগঞ্জবাসী হিসেবে এ বড় গর্বের। গ্রামের মানুষের এই গুণী হাতের কদর সারা বিশ্ব করুক এ চাওয়া তো আমাদের সবার। তবে আজো অনামী- অখ্যাত শিল্পীদের গলার সেই আক্ষেপের সুর মোছা যায়নি। এ যদি মুদ্রার এক পিঠের গল্প হয় তবে অন্য পিঠে কিন্তু সেই অভাব রয়েইছে।
দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেলের দিকে। হালকা লাল আভায় চারদিক আরো মায়াময়। চাকে বসানো এক তাল মাটি তখন শিল্পীর হাতের আশ্চর্য ছোঁয়ায় আকার পাচ্ছে। দেহ পাচ্ছে। এরপর তাকে নামিয়ে অন্য তাল নিয়ে কাজ শুরু হবে। পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর স্ত্রী, সহজ হাসিমুখে আমায় দাওয়ায় রাখা বাকি কাজ গুলো দেখাচ্ছেন- তারই হাতের আদরে গড়ে উঠেছে কুপি, কলসি, সরা, হাঁড়ি, পুতুল, খেলনা। ক্লান্তি নেই। তারও কি দম ফেলবার জো আছে? এরই মাঝে কখনো ফিরে ফিরে গিয়ে জল এগিয়ে দিচ্ছেন, কাঁধের ওপর আলগোছে ফেলে রাখা গামছা দিয়ে কপালের, পিঠের ঘাম মুছে দিচ্ছেন, পাছে তার মানুষটার কাজে কোনো ব্যাঘাত ঘটে। এসব দৃশ্যে সত্যিই অনেকটা শ্বাস থাকে।
আরও পড়ুন
আঁকার জন্য শাস্তি স্কুলে, সেদিনের ছোট্ট শিশুই আজ বিখ্যাত শিল্পী
সামনেই দীপাবলি। আলোর উৎসবে সেজে ওঠার রসদ যে যাবে এই আঁতুড় থেকেই। উঠোনে সার দিয়ে শুকোতে দেওয়া মাটির প্রদীপ। তার ওপর চলবে তুলি বোলাবার কাজ, রঙ হবে। হাত লাগাবে ছেলে-মেয়েরাও। এ-ঘর ও-ঘর মিলে কাজ চলবে রাত অবধি। তারপর সেসব চাহিদা অনুসারে দূরদূরান্তে পাঠিয়ে, স্থানীয় কুনোর হাটে বেচাকেনা সেরে তবে আলো জ্বলবে এই ঘরগুলোর মুখে।
আরও পড়ুন
ছবি আছে, ক্রেতা নেই— দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই প্রবীণ কোলাজ শিল্পীর
পুরো প্রক্রিয়াটাই চলে কতগুলো ধাপ মিলে। প্রথমে নদী থেকে তুলে আনা মাটিকে পুড়িয়ে পাকা করা হয়। বাড়ির মেয়ে বৌ-রা জ্বালানী সংগ্রহের কাজ করে। এই শিল্পের মেরুদন্ড হল চাক। রোদে মাটিকে হালকা শুকিয়ে ছুরি, বাটালি বা হাতুড়ি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয় কারুকাজ। এরপর কস নামক এক ভেষজ রঙের সঙ্গে মিশিয়ে আরেকপ্রস্থ শোকাবার পালা। সেজন্য লাগে পাট বা পাতলা কাপড়ের নুড়ি। তারপর তাকে পোড়াবার জন্য তোলা হয় ভাটিতে। দশ-বারো দিনের কাজ ভাটিতে সাজিয়ে তবেই নতুন কাজে হাত দেওয়া। সব মিলিয়ে লাভ কেমন হয়? সত্যি বলতে স্থানীয় হাটে দাম পায় কম, ফলে এই নেশাকে, এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাদের নির্ভর করতে হয় সারাবছর ধরে চলা বিভিন্ন মেলার ওপর। প্রসারের তাগিদেই শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি-বর্ধমান এসব জায়গায় পাঠানো হয় শিল্পীদের কাজ।
বিমূর্ত থেকে মূর্ত হওয়ার এই খেলা চলছে, নরম প্রাচীন পলিমাটির বুকে নানা ছাঁচ, অলঙ্করণে মাটি থেকেই নতুন জন্মের মতো উঠে আসছে সৃষ্টি তখন এর মাঝে মাঝে এই সহজ, একসঙ্গে জুড়ে থাকার সমীকরণ মুগ্ধ করছিল বারবার। অকারণ শান্তি দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এভাবেই তো হয়। নইলে বোধহয় কিছুই হয় না।
হাতে অনন্ত সময় নিয়ে তো কোথাও যাওয়া হয় না। তাই মন না চাইলেও ঝাঁপ বন্ধ করতে হয়। তবে ফিরে আসা জারি থাকবে এখানে। এই মাটিই ডাক পাঠাবে ঠিক। হালকা অন্ধকার মেখে দাঁড়িয়ে বাঁশডুমনির সাঁকো, পিছন পিছন আসতে থাকে ছেড়ে আসা গ্রাম। টের পাই চাকা ঘুরছে।
ছবি: লেখিকা