৮ই ডিসেম্বর, ১৯৮০। রাত এগারোটা প্রায়। সারাদিনের কাজ সেরে নিউইয়র্কের এক স্টুডিয়ো থেকে ফিরছেন ‘বিটলস্’-এর অন্যতম কিংবদন্তী মুখ জন লেনন। দল ভেঙে গেলেও গান নিয়ে ব্যস্ততা আছেই! পাশে স্ত্রী ইয়োকো ওনো। পৃথিবী জুড়ে লক্ষ লক্ষ ভক্ত ছড়িয়ে আছে লেননের। সেরকমই একজন পাগল ফ্যান অপেক্ষা করছে লেননের সঙ্গে দেখা করার জন্য সকাল থেকেই। যদিও তার আগেই স্ত্রীয়ের সঙ্গে স্টুডিও যাওয়ার সময়েই একবার সাক্ষাৎ হয়েছে লেননের সঙ্গে তার। হাসিমুখে লেননের থেকে সইও চেয়ে নিয়েছে তাঁর 'ডাবল ফ্যান্টাসি' অ্যালবামে। তারপরেও অপেক্ষা করে গিয়েছে সেখানেই। বেশ রাতে রেকর্ডিং সেরে ক্লান্ত লেনন যখন নামলেন গাড়ি থেকে, তখনই সেই পাগল ফ্যান গুলি চালাল আচমকা। পরপর পাঁচবার। সারা পৃথিবী চিনল মার্ক চ্যাপম্যানকে, কুখ্যাত ঠান্ডা মাথার একজন ‘সাইকিক’ খুনি হিসেবে।
আরও পড়ুন
অসুখের মধ্যেই প্রাণের সুর, রবীন্দ্রনাথ বেঁধে দিলেন ১২ জন সঙ্গীতশিল্পীকে
“দিব্যি ভাল ব্যবহার করেছিলেন তিনি। ঠান্ডা মাথায় ধৈর্য নিয়ে আমার সব কথা শুনলেন। অ্যালবামে সই করলেন। এমনকি একবার জিজ্ঞেসও করলেন যে আমার আর কিছু চাই কিনা? বেশ ভালো ও ভদ্র মানুষ! কিন্তু রাত্রে তিনি ঘরে যাওয়ার জন্য যখনই ঘুরেছেন, তখনই আমার মাথার মধ্যে কেউ একজন বলে উঠল, “এবার করো ওটা। করেই ফ্যালো!” আমি স্রেফ সেই কথাটা শুনে আদেশ পালন করলাম— ‘বুম’! পাঁচ বার।” পুলিশের সামনে জিজ্ঞাসাবাদের সময় খুনের সময়ের ঘটনা এভাবেই জানিয়েছিল চ্যাপম্যান।
আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের ভাইপোর কাছে শিখেছেন গান, মুক্তিযুদ্ধের সময় কনসার্টের আয়োজকও তিনিই
তার বছর দশেক আগেই ভেঙে গিয়েছে দুনিয়া কাঁপানো মিউজিক ব্যান্ড ‘বিটলস্’। কিংবদন্তিতে পরিণত হওয়া ‘বিটলস্’-এর প্রবল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও ভেঙে যাওয়ার পরে সস্ত্রীক নিউ ইয়র্কে পাড়ি দেন লেনন। ম্যানহাটনের বিখ্যাত ‘দ্য ডাকোটা’ বহুতল রাতারাতি শিরোনামে উঠে আসে তাঁর আবাসস্থল হিসেবে। তবে আমেরিকা পাড়ি দিয়ে পাগল ব্রিটিশ ভক্তদের হামলে পড়া থেকে সাময়িক মুক্তি পেলেও, অন্য সমস্যায় জেরবার হতে হচ্ছিল লেননকে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন সরকারের খোলামেলা সমালোচনা ও বিরুদ্ধতা করেছিলেন তিনি। সেই সুবাদে প্রায়ই এফবিআই-এর জেরার জন্য হাজিরা দিতে হত তাঁকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনও চোখে চোখেই রাখতে বলেছিলেন লেননকে। তবু সেই সব চোখরাঙানি এড়িয়ে এভাবে হামলা হতে পারে তাঁর উপর, তা বোধহয় কোনও তুখোড় চিত্রনাট্যকারেরও ভাবনার অতীত ছিল।
আরও পড়ুন
জম্মুর যুবক কুন্দনলালে মুগ্ধ স্বয়ং কবিগুরু, প্রথম অবাঙালি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী তিনিই
১৯৫৫ সালে টেক্সাসে জন্ম নেওয়া মার্ক চ্যাপম্যানের বাবা ছিলেন আমেরিকান এয়ারফোর্সের সার্জেন। ছোট থেকেই মায়ের উপর বাবার অকথ্য অত্যাচার দেখতে দেখতে চোখ সওয়া হয়ে গিয়েছিল মার্কের। ক্ষতি হতে থাকে পড়াশোনাতেও। এমনকি সংবাদমাধ্যমে চ্যাপম্যান এও বলেছিল যে, লেনন ছাড়াও পল ম্যাককার্টনি, এলিজাবেথ টেলর বা তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগনের সঙ্গে তার বাবাকেও ‘মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়ে’ হত্যার ইচ্ছা ছিল তার!
আরও পড়ুন
ফুলশয্যার রাতে, স্ত্রী’র কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে চাইলেন তরুণ জীবনানন্দ
১৪ বছর বয়স থেকেই শুরু হয় ড্রাগসের নেশা। স্কুলেও যাওয়া হত না নিয়মিত। অন্য ছাত্রদের ‘বুলিং’-এর শিকার হয়ে তৈরি হয়েছিল স্কুলের প্রতি ভীতি। প্রায়ই আটলান্টার রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যেত নেশাসক্ত চ্যাপম্যানকে। ১৯৭১ সালে খ্রিস্টান প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মের একটা ভিন্নতর শাখা ‘প্রেসবাইটেরিয়ান’-এর আশ্রয় নিয়ে চ্যাপম্যান চলে আসে জর্জিয়া। সেখানে থাকতে থাকতে শুরু হয় গান শোনা এবং বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস পড়া। জে.ডি. স্যালিঙ্গারের ‘দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই’ উপন্যাসের মূল চরিত্র হোল্ডেন কলফিল্ডের সঙ্গে রীতিমতো একাত্ম হয়ে পড়েছিল সে। কলফিল্ডের নিঃসঙ্গতা, যন্ত্রণা, সমাজ বিচ্ছিন্নতা তার সঙ্গে একাত্ম বোধ করতে সাহায্য করেছিল তাকে। আর একই রকম ভাবে তাকে ভাবিয়েছিল বিটলস্ এবং জন লেনন। সেই সময় কাছের বন্ধুদের কাউকে কাউকে চ্যাপম্যান প্রায়শই বলত তার বিটলস্-এর দলে যোগ দেওয়ার স্বপ্নের কথা। এলএসডির নেশার পর উপরের দিকে তাকিয়ে মার্ক চ্যাপম্যান নিজের নাম বলত— জন লেনন!
আরও পড়ুন
হিন্দিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন বিশ্বভারতীতে, উঠছে বিতর্ক – কতটা যুক্তিযুক্ত?
ভেঙে যাওয়ার আগে বা পরে, বরাবরই সংবাদের শিরোনামে থেকেছে বিটলস্— সে সঙ্গীতের জন্যই হোক কিংবা বিতর্কের জন্য। সেই সময়েই ১৯৬৬ সালে একটি ব্রিটিশ পত্রিকায় লেনন একটি সাক্ষাৎকারে দাবি করেন যে, জনপ্রিয়তার নিরিখে বিটলস্ হয়তো যিশুখ্রিস্টের থেকেও এগিয়ে। এই ঘটনাই ক্ষেপিয়ে তোলে ধর্ম অন্ত প্রাণ চ্যাপম্যানকে। এমনকি তার হাই স্কুলের বন্ধুরাও জানিয়েছেন, সেই সময় নাকি চ্যাপম্যানকে লেননের ‘ইম্যাজিন’ গানের সুরে গুনগুন করে গাইতেও শোনা যেত, ‘ইম্যাজিন ইফ জন ওয়্যার ডেড’!
আরও পড়ুন
সঙ্গীত জগতেও আঘাত করোনার, প্রয়াত আফ্রিকান স্যাক্সোফোন শিল্পী দিবাংগো
১৯৭৭ সালে প্রবল ডিপ্রেসন নিয়ে হাওয়াই চলে আসে চ্যাপম্যান। সেখানেই বিয়ে করে একজন ট্র্যাভেল এজেন্ট গ্লোরিয়া অ্যাবেকে। তবুও থিতু হওয়া সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। বরং অ্যান্টনি ফসেটের লেখা ‘জন লেনন: অ্যাট এ টাইম’ বইটি চ্যাপম্যানের আক্রোশ বাড়িয়ে দেয় আরও এবং সে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, লেনন বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়েছেন আর তাঁকে শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব ঈশ্বর সঁপে দিয়েছেন চ্যাপম্যানেরই হাতে। ১৯৮০ সালের অক্টোবরে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েই নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে চ্যাপম্যান। চাকরির শেষ দিনে হাজিরা খাতায় সইয়ের জায়গায় নিজের নাম লিখেছিল, ‘জন লেনন’!
আরও পড়ুন
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্লাস এবার অনলাইনেও, ঐতিহ্য ও প্রযুক্তির মেলবন্ধনে ‘কলাকার’
৮ই ডিসেম্বর লেননকে গুলি করার পর পুলিশ আসা অবধি সেখানেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছিল চ্যাপম্যান। আদালতে আইনজীবীরা মস্তিষ্ক বিকৃতির অজুহাতে চ্যাপম্যানকে নিষ্কৃতি দেওয়ার আর্জি জানালেও, চ্যাপম্যান নির্বিকারভাবে জানিয়েছিল যে, সে ঠান্ডা মাথাতেই এই কাজ করেছে। স্বয়ং ঈশ্বর নাকি তার কানের কাছে ফিসফিস করে এই আদেশ দিয়েছিলেন তাকে! মার্কিন কারাগারে এখনও বন্দি চ্যাপম্যানের পরবর্তী শুনানি চলতি বছরেরই আগস্ট মাসে। এখনও অবধি প্রতিটা শুনানির আগে লেননের স্ত্রী ইয়োকো ওনো চিঠি লিখে আর্জি জানিয়েছেন, কোনোভাবেই যেন মুক্তি না দেওয়া হয় লেননের খুনিকে। সবমিলিয়ে লেননের মৃত্যুর ৪০ বছর পরেও অপরাধ বিজ্ঞানীদের অপরিসীম কৌতূহল জিইয়ে রেখেছে মার্ক ডেভিড চ্যাপম্যান, যে মনে করে, যিশু ক্ষমা করেছেন তাকে।
Powered by Froala Editor