শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্লাস এবার অনলাইনেও, ঐতিহ্য ও প্রযুক্তির মেলবন্ধনে ‘কলাকার’

বাগিচায় ধীরে ধীরে সন্ধে নামল। গোটা শহর শুনশান। এক ধাক্কায় ফিরে যেতে হয় সেই পুরনো তেলের কুপির দিনগুলোয়। এভাবেই শান্ত হয়ে যেত সবটা। তারপর কোথা থেকে ভেসে আসত একটা সুর। তানপুরা বেজে চলেছে। আস্তে আস্তে সেই তান ধরে সুর বয়ে আসত। গলার কাজে পার হত একেকটা সময়। আজ আর সেই পরিবেশ নেই। সেই রাজাও নেই, রাজপাটও নেই। ঝাড়বাতি নিভে গেছে কবে। কিন্তু সেই সুর আজও মোহিত করে রেখেছে সকলকে। গঙ্গার পাশাপাশি ভারতের সনাতন ঐতিহ্যের ধারা হয়ে বয়ে চলেছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত।

বছরের নানা সময় বিভিন্ন জায়গা এই শুদ্ধ সুরের রাগে ভেসে যায়। শত শত বছর পেরিয়েছে, কিন্তু সেই চমক, সেই ঢং, সেই মেজাজ এখনও বদলায়নি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই নদীর তীরে বসেই কত সাধক তপস্যা করেছেন। সিদ্ধিলাভ করেছেন, আবারও ডুব দিয়েছেন সেখানে। আর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কথা আসলে প্রবলভাবে এসে পড়ে গুরু-শিষ্য পরম্পরা। কিংবদন্তি গুরুর কাছে নাড়া বেঁধে পড়ে আছেন সাধক শিষ্য; পরবর্তীতে তিনিও হয়ত কিংবদন্তি হয়ে উঠবেন। ভারতের ইতিহাস জুড়ে এই চিত্র ফুটে উঠেছে। আজও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গড়ে ওঠার এবং পথ চলার পেছনে রয়েছে এই পরম্পরাই। রয়েছে নিষ্ঠা, ভক্তি; আর কঠোর তপস্যা…

লকডাউনের এই আবহে সবাই ঘরে বন্দি। রোগের কালো ছায়া যাতে আমাদের শরীরে ও মনে প্রভাব না ফেলতে পারে, তার চেষ্টা করেই যাচ্ছি সবাই। গোটা বিশ্ব জুড়ে একই হবি। সেখানে এমন বহু মানুষ আছেন, যারা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়ে উৎসাহী। এই পরম্পরার অংশ হতে চান, সেই শুদ্ধতার স্পর্শ পেতে চান। তাদের জন্যই একটি উদ্যোগ শুরু করেছে ‘কলাকার’ সংস্থা। এই সংস্থার যাবতীয় কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সুর, সঙ্গীত। এরাই আয়োজন করেছেন ‘মেহফিল, গুরু-শিষ্য পরম্পরা’ বলে একটি ফেসবুক লাইভ অনুষ্ঠান। যার উদ্দেশ্য দুটি; পণ্ডিত এ কাননের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন, এবং দেশ-বিদেশের যারা এই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বহমান ধারায় নিজেকে সামিল করতে চান তাঁদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন। তাঁদের কাছে এই পরম্পরার গুরুত্ব, গল্প সমস্তকিছু পৌঁছে দেওয়া। সেই কাজেই যুক্ত হয়েছেন নামী-গুণী শিল্পীরা।

এখনকার সময় কোনো গানের শিক্ষক এসে ছাত্র বা ছাত্রীকে গান শিখিয়ে যান। প্রায় সব ঘরে ঘরেই এই জিনিসটি দেখা যায়। এটা কিন্তু গুরু-শিষ্য পরম্পরা নয়। এখনও কিছু জায়গায় এই পরম্পরাটি রয়ে গেছে এখনও। সেইজন্যই আগের বাক্যে ‘প্রায়’ শব্দটির ব্যবহার। মূলত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতের মধ্যেই এটি সীমাবদ্ধ। আর অনেক পণ্ডিত, সঙ্গীতজ্ঞ, শিল্পীদের মতে, এই জিনিসটি না থাকলে সেই চিরন্তন ভক্তি আসে না। এটি যে কঠোর তপস্যার প্রক্রিয়া। গুরুর কাছে শিখতে গেলাম, গুরুও আসন পেতে বসিয়ে শেখাতে শুরু করে দিলেন তেমনটা তো নয়। বরং অনেক কৃচ্ছসাধনের মধ্য দিয়ে যেতে হয় শিষ্যকে। গুরু প্রথমেই শেখাতে শুরু করেন না। সামান্য একটু সুর, বা বন্দিশ ধরিয়ে দিতে পারেন। এই পুরো সময় শিষ্যের শেখার চেষ্টা, লেগে থাকার মানসিকতা, নিষ্ঠা, সাধনা সমস্ত কিছু প্রত্যক্ষ করতে থাকেন তিনি। একসময় যখন তাঁর মনে হয় যে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, তখন শুরু হয় শিক্ষা। সেটা স্রেফ গান শেখানো হয়; নিজের এতদিনের সমস্ত শিক্ষা, সাধনা শিষ্যকে উজাড় করে দেন গুরু। ভগবানকে পাওয়ার এই সাধনা এভাবেই এগোতে থাকে। গুরু তখন স্রেফ সঙ্গীতে আবদ্ধ হয়ে থাকেন না; শিষ্যের অভিভাবকের মতো হয়ে যান।

এভাবেই এগিয়েছেন চন্দ্রা চক্রবর্তী। সঙ্গীত রিসার্চ একাডেমির প্রাক্তন স্কলার চন্দ্রা নিজেও একজন প্রতিষ্ঠিত স্বনামধন্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী। পণ্ডিত এ কাননের কাছে নাড়া বেঁধেছিলেন। তিনিই ‘কলাকার’-এর প্রাণকেন্দ্র। গুরুজি কানন সাহেবের জন্ম শতবর্ষ উপলক্ষে ‘কলাকার’-এর তরফ থেকেই অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ছিল তাঁর। কিন্তু করোনা এসে থাবা বসাল সবটায়। তার ওপর লকডাউন। কিন্তু উদ্যোগ তো থেমে থাকে না। প্রযুক্তি আমাদের সেই জায়গা করে দিয়েছে। তাই কয়েকজন মিলে ‘কলাকার’-এর তরফ থেকে ফেসবুকেই শুরু করলেন আয়োজন। সেটাই ‘মেহফিল, গুরু-শিষ্য পরম্পরা’। সেখানে যেমন থাকবে পণ্ডিত এ কাননকে নিয়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীদের স্মৃতিচারণ; তেমনই থাকবে ক্লাস। গুরু-শিষ্যের এই পরম্পরা, এই নাড়া বাঁধা যাতে সমস্ত মানুষের কাছে পৌঁছে যায়; এই ধারাটি যাতে মুছে না যায় তারই চেষ্টা চলছে।

দেশ বিদেশের শ্রোতারা যেমন অধীর আগ্রহে উপস্থিত হচ্ছেন এই অনলাইন আড্ডায়, তেমনই থাকছেন শিল্পীরা। উস্তাদ রশিদ খান, উস্তাদ সুজাত খান, পণ্ডিত শুভঙ্কর ব্যানার্জী, পণ্ডিত তন্ময় বোস, ডক্টর পণ্ডিত রণজিৎ সেনগুপ্ত, মুরাদ আলী খান প্রমুখরা তো থাকছেনই; সেই সঙ্গে থাকছেন রূপঙ্কর, শ্রাবণী সেনরাও। আছেন অনেক নবীন প্রজন্মের শিল্পীরাও। সবাই মিলে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই বহমান ধারার পাশেই এসে বসেছেন। আছেন শ্রোতারাও। এই মেহফিলে যাতে সবাই সেই সনাতন ঐতিহ্যের স্পর্শটুকু নিয়ে ঘুমোতে যেতে পারেন, এই আকালেও আশার সন্ধান করতে পারেন, তারই প্রচেষ্টা। সঙ্গীতের এমনই উজ্জ্বল আলো আমাদের প্রতিটি প্রজন্মকে ঘিরে ধরুক তেমনই প্রত্যাশা চন্দ্রা চক্রবর্তী ও ‘কলাকার’-এর।