রবীন্দ্রনাথের ভাইপোর কাছে শিখেছেন গান, মুক্তিযুদ্ধের সময় কনসার্টের আয়োজকও তিনিই

গত শতাব্দীর ষাটের দশক। বাংলায় তখন স্বর্ণযুগের সময়। শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান— এসব দিকে তো বটেই, সঙ্গীত জগতেও উঠে আসছেন একের পর এক প্রতিভা। তৈরি হতে থাকে নতুন গান। গণ আন্দোলনেও ভূমিকা নেয় গান। একের পর এক নক্ষত্রকে আমরা পেয়েছি এই সময়। কিন্তু এমন অনেকে আছেন, যাঁরা সেই সময় প্রবলভাবে উপস্থিত থাকলেও আমরা সেভাবে মনে রাখিনি। প্রশান্ত ভট্টাচার্য সেই স্মৃতির আড়ালে চলে যাওয়া মানুষদের অন্যতম।

রবীন্দ্রসঙ্গীত, যাত্রা, গণসঙ্গীত, লোকগীতি— সমস্ত মাঠেই একসময় দাপিয়ে বেরিয়েছেন তিনি। দীর্ঘদিন কাজ করেছেন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে। তবে প্রশান্ত ভট্টাচার্য’র সঙ্গীত শিক্ষার শুরু বেশ ছোটো বয়স থেকেই। বাড়িতে চিরকালই ছিল গানের পরিবেশ। মায়ের কাছেই প্রথম সাত সুরের হাতেখড়ি। দিদিদের সঙ্গে চলত গানের ক্লাস। তারপর জীবনে পেয়েছেন একের পর এক গুরুকে। পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, সুচিত্রা মিত্রের কাছে সঙ্গীতের পাঠ নিয়েছিলেন দীর্ঘদিন। গান শিখেছিলেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছেও, যিনি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো।

পরবর্তীকালে অল ইন্ডিয়া রেডিও’র অন্যতম পরিচিত স্বর হয়ে উঠেছিলেন প্রশান্তবাবু। ‘অনুরোধের আসর’ তাঁকে বড় পরিচিতি দেয়। তাঁর দরাজ গলায় রবীন্দ্র সঙ্গীত তখনকার মানুষেরা হয়তো ভালোভাবেই মনে করতে পারবেন। ২৫ বছরেরও বেশি সেখানে কাজ করেছিলেন প্রশান্তবাবু। অল ইন্ডিয়া রেডিও’র সঙ্গীত সম্মেলন, জওয়ানস অফ ইন্ডিয়ান আর্মি অনুষ্ঠানেও গিয়েছিলেন। এমনকি জামশেদপুরে এআইআর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনিই ছিলেন প্রথম শিল্পী।

তবে এসবের বাইরেও আরও দুটো ক্ষেত্রে প্রশান্তবাবুর ভূমিকা উল্লেখের দাবি রাখে। গণসঙ্গীত, এবং যাত্রা। ১৯৭০। পৃথিবীও উত্তাল, উত্তাল বাংলাও। একদিকে চলছে নকশাল আন্দোলন, আরেকদিকে ওপার বাংলায় চলছে স্বাধীনতার লড়াই। এই দুটোতেই জড়িয়ে পড়েন প্রশান্ত ভট্টাচার্য। সত্তরের দশকে যেসব জায়গায় আগুন জ্বলছিল, সেসব জায়গায় সমবেতভাবে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। প্রতিবাদের সুর পৌঁছে দিয়েছিলেন সেখানে। ’৭১ সালে ওপার বাংলার শিল্পী আব্দুল জব্বর, আপ্পেল মাহমুদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বাংলায় কনসার্ট আয়োজন করেছিলেন তিনি। সেখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ পৌঁছে যেত ওপার বাংলায়। গণসঙ্গীতকে গুরুত্ব দিতেন প্রশান্তবাবু। গুরুত্ব দেন আজও।

তবে যাত্রায় তাঁর অবদানের কথা অনেকেই মনে করে থাকবেন। সত্তরের উত্তাল সময়ই যাত্রার সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। নিজের ভাবনা, সমাজের ভাবনা, লোকশিল্প সবকিছু যাত্রায় উঠে আসে। ২০০-রও অধিক যাত্রায় সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন তিনি। যাত্রায় গান অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। আর সেখানেই তিনি প্রথম নিয়ে আসেন আধুনিকতার ছোঁয়া। সেজন্য পুরস্কারও পেয়েছেন বিস্তর। ‘লেডি ডক্টর’ সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনার জন্য পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। প্রসঙ্গত, ‘লেডি ডক্টর’ ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের প্রথম সাঁওতালি সিনেমা। এছাড়াও, ১৯৮৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘ডিস্টিংগুইশড অ্যাওয়ার্ড’, ১৯৮০-তে অল ইন্ডিয়া ক্রিটিক কাউন্সিলের তরফ থেকে সেরা সঙ্গীত পরিচালকের সম্মান-সহ নানা পুরস্কার পেয়েছেন।

একটা সময় চুটিয়ে যিনি যাত্রা করেছেন, আজকের যাত্রার সামগ্রিক রূপকে তিনি কীভাবে দেখেন? উত্তরে খানিক চুপ করে থাকেন প্রশান্তবাবু। একটা সময় যাত্রার রমরমা যে আজকে অনেক কমে এসেছে, সেই কথাটাই স্বীকার করে নিলেন তিনি। যাত্রার প্রচলিত কথা ছিল ‘ষষ্ঠী থেকে জ্যেষ্ঠী’। দুর্গাপুজোর ষষ্ঠী থেকে শুরু করে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত চলত যাত্রা। একটা যাত্রা মঞ্চস্থও হত অনেকবার। আজ সেই সময় আর নেই বলে মনে করেন সদ্য ৮০ বছর অতিক্রম করা প্রশান্তবাবু।

চিরকাল জোর দিয়ে এসেছেন সঙ্গীত শিক্ষার প্রতি, চর্চার প্রতি। আজও তিনি একই কথা বলেন। এখনকার সময় একটা অংশের এই চর্চার অভাবকেই দায়ী করেন তিনি। প্রশান্তবাবু এখনও মনে করেন, গণ সঙ্গীতের প্রাসঙ্গিকতা আছে। তাঁর মতে, আজকের এই সময় আবার সবার এক জোট হওয়া প্রয়োজন। সমস্ত কিছু সুবিধা-অসুবিধা ভুলে, গানের মধ্যে দিয়ে, সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে নিজের কথাকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়াতেই তিনি বিশ্বাসী।